৬ ডিসেম্বর, বিশিষ্ট অভিনেতা কামু মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুদিন। ‘হীরক রাজার দেশে’ র উদয়ন মাস্টারের পাঠশালায় ছাত্রদের তদারকির দায়িত্বে ছিলেন তিনি। তদারকি, মানে বকাবকি নয়। স্নেহপরায়ণ এক আর্দ্র মানুষ ছিলেন তিনি। ছোট ছোট ছেলেদের ব্যস্ত রাখতে, তিনি কখনও দেখাতেন ম্যাজিক। কখনও গেয়েছেন স্বরচিত ভূতের গান। উদয়ন মাস্টারের সেই পাঠশালারই একজন সৌমিক নন্দী মজুমদার। রইল তাঁর স্মৃতিচারণ।
‘হীরক রাজার দেশে’র উদয়ন মাস্টারের পাঠশালায় দরকার ছিল ১২ জন ছাত্রর। সেই ১২ জন ছেলেদের মধ্যে আমিও ছিলাম একজন। সকলেই ক্লাস ফাইভ থেকে সেভেনের মধ্যে পড়ে। ১৯৭৯ সাল। প্রথম দিকে আমাদের কয়েকটা শুটিং হয়েছিল ‘ইন্দ্রপুরী স্টুডিও’র মধ্যে। এমনই একটা পরিবেশ সেখানে, যে আমরা– কমবয়সি ছেলেপুলের দল, খুব যে মেলামেশা করতে পেরেছিলাম, তা নয়। অল্প শুটিং হত। তারপর হয়তো বসেই থাকতে হল দীর্ঘক্ষণ! ইউনিটের তরফ থেকেই আমাদের নিয়ে আসা, বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হত। আমাদের এই দলটার সঙ্গে বেশিরভাগ সময় থাকতেন ‘পাঠভবন’ স্কুলের মাস্টারমশাই দীপঙ্কর সরকার, শিব চৌধুরীও। আরও কয়েকজন ছিলেন, তাঁরাও অভিভাবকের মতো থাকতেন।
কামু মুখোপাধ্যায়কে আমরা সে অর্থে চিনতে-জানতে পারি ‘হীরক রাজার দেশে’র আউটডোর শুটিংয়ে গিয়ে। মানে, পুরুলিয়ায়। পুরুলিয়ায় উদয়ন মাস্টারের পাঠশালা, দড়ি ধরে মারো টান– ইত্যাদি দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল। আমরা সেখানে থাকতাম প্রায় নতুন এক স্কুলবাড়ির কয়েকটা ঘরে। ৭ দিন ছিলাম পুরুলিয়ায়। পৌঁছনো থেকে শেষ অবধি যাঁরা আমাদের সঙ্গে ছিলেন, মজা করছিলেন, খেলছিলেন, ব্যস্ত রাখছিলেন– তাঁদেরই একজন কামু মুখোপাধ্যায়। আমরা বলতাম, ‘কামুকাকু’!
আমাদের সকালের জলখাবার, দুপুরের খাবার এবং রাতের খাবারের নির্দিষ্ট সময় ছিল। সত্যজিৎ রায়ের কড়া নির্দেশও ছিল যে, বাচ্চাদের খাবারে যেন কোনও অসুবিধে না হয়। অভিনয় ছাড়াও ইউনিটের নানা কাজে ব্যস্ত থাকতেন কামুকাকু, অনেকটাই ব্যবস্থাপনার কাজ– তা সত্ত্বেও আমাদের খাবার সময় উনি এসে হাজির হতেন। যদি দেখতেন, কেউ কম-সম খাচ্ছে, তাহলে খাওয়ার ব্যাপারে বেজায় উৎসাহ দিতেন। মনে আছে, একবার সকালের জলখাবারে লুচি-তরকারি দেওয়া হয়েছে। কামুকাকু দেখলেন, একজন ২টো মাত্র লুচি খাচ্ছে। বললেন, ‘আরে! এই বয়সে মাত্র দুটো লুচি খাচ্ছিস! তাহলে দ্যাখ, লুচি কত বেশি খাওয়া যায়।’ তারপর হঠাৎ একজনের পাত থেকে গোগ্রাসে খেতে শুরু করলেন কামুকাকু। নিমেষে ফুরিয়ে যাচ্ছে একের পর এক লুচি। আমরা তো হতবাক! একজনকে বললেন, ‘তোরা গুনছিস তো?’ একটি ছেলে বলল, ‘হ্যাঁ, প্রায় ৮-১০টা খেয়ে ফেলেছ তুমি!’ কামুকাকু ‘হা-হা’ করে হেসে বললেন, ‘আমি এক্ষুনি পেট থেকে বের করে দিচ্ছি!’ হঠাৎ করে হাত থেকে ৮টা লুচি তিনি বের করে ফেললেন। আমরা ‘আরও ম্যাজিক দেখাও’ বলে লাফাতে লাগলাম। তখন কামুকাকু বললেন, ‘ভালো করে না খেলে দেখাব না।’ ফলে আমরা আর হেলাফেলা করে খেতাম না। অনেকক্ষণ খাওয়া না হলে কামুকাকু বলতেন, ‘কী রে, তোদের মুখগুলো শুকনো শুকনো লাগছে!’ তক্ষুনি কোথা থেকে যে বিস্কুট, চানাচুর চলে আসত, কে জানে! বাচ্চাদের অসম্ভব ভালোবাসতেন। শুধু স্নেহপরায়ণ নয়, দায়িত্বজ্ঞানও জুড়ে ছিল এই অসমবয়সি সম্পর্কে।
সামান্য শুটিংয়েও অনেকটা সময় লেগে যেত তখন। প্রস্তুতি চলত দীর্ঘক্ষণের। তার মধ্যে আলো চলে গেলে আরেক বিপত্তি! কখনও হয়তো দেখা গেল ক্যামেরাটা ঠিক কাজ করছে না। ফলত, ছোটদের খুবই একঘেয়ে লাগত এই সময়টায়। বিরক্ত হতাম। সত্যজিৎ রায় এসব আন্দাজ করেই আগে থেকে আমাদের জন্য খেলার সরঞ্জাম এনে রেখেছিলেন– ফুটবল, ক্রিকেট, লুডো এমনকী, ডাংগুলি। কিন্তু এমনও পরিস্থিতিও হত যখন খেলাধুলো করা যাবে না। এ অবস্থায় ত্রাতা কে? আমাদের কামুকাকু!
‘হীরক রাজার দেশে’র যে চালাটা দেখা যায় উদয়ন মাস্টারের পাঠশালা হিসেবে, অনেক সময় ওই চালাতেই দুপুরবেলায় ইউনিটের অনেকে বিশ্রাম নিতেন। তাঁদের একজন কামুকাকুও। আমরাও ফিরতাম না অনেক সময়, বিশ্রামে ওখানেই। আমাদের মধ্যেই কেউ হঠাৎ খেলবে– এমন ইচ্ছাপ্রকাশ করছে, ফুটবলটা নিয়ে বেরবে বেরবে করছে– সেসময় সত্যজিৎ রায় বললেন, ‘এখন না, ক্যামেরাটা হয়ে যাক, তার পর।’ ছেলেটি মুষড়ে পড়ল। কামুকাকু বললেন, ‘দাঁড়া, তোদের কিছু ম্যাজিক দেখাই।’ কখনও বিস্কুট ভ্যানিশ করে দিলেন, কখনও পাখা। আমাদের বালকচক্ষু চড়কগাছ! যে জাগলারি তিনি ‘ফটিকচাঁদ’ সিনেমায় দেখিয়েছিলেন, তা কিন্তু তিনি অনেকটাই করতে পারতেন। এই ম্যাজিক চলার সময় সত্যজিৎ রায় বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘শুধু কামুর ম্যাজিক দেখলে হবে? আমার ম্যাজিক দেখবে না তোমরা? দ্যাখো আমি কামুর থেকেও ভালো ম্যাজিক দেখাই!’ আমরা প্রত্যেকে সোৎসাহে ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, দেখব দেখব’ বলে উঠলাম। দুর্দান্ত তাসের ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন সত্যজিৎ। তা দেখে কামুকাকু বললেন, ‘কার কাছে যেন মার্বেল গুলি আছে? দাও তো!’ মাটিতে গর্ত। ছেলেরা মার্বেল গুলি নিয়ে খেলছিল। সত্যজিৎ রায় বললেন, ‘তোমরা ব্যাকস্পিন করে মার্বেল গুলি গর্তে ফেলতে পারো?’ আমরা অবাক, বলেন কী! সঙ্গে বললেন, ‘এটা কিন্তু কামু পারবে না!’ সত্যজিৎ রায় মার্বেল গুলি হাতে মাটিতে বসে, গর্তের আগে গুলি ফেলে ব্যাকস্পিন করিয়ে গর্তে ফেললেন! এ দৃশ্য আমার চোখে ভাসছে এখনও। ক্লাস সেভেন তখন আমার, ফেলুদা যা বেরিয়েছে, পড়েছি। আমি বাড়ি ফিরে বাবাকে বলেছিলাম, ‘জানো তো, সত্যজিৎ রায়ই ফেলুদা!’
তখন আমরা ছোট হলেও বুঝেছিলাম, ‘হীরক রাজার দেশে’র শুটিং অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে। ফলে বাসে করে নানা জায়গায় যেতাম, শুটিং না থাকলেও। একবার সেরকম শুটিং স্পটে ক্যামেরায় হঠাৎ বেশ কিছু গরু ঢুকে পড়ল। সত্যজিৎ এতই নির্ভর করতেন কামুকাকুর ওপর যে, এইসব সামলানোর দায়িত্বও ছিল তাঁর ওপরই ন্যস্ত। কামুকাকু দৌড়ে গিয়ে তক্ষুনি গরু তাড়াতে থাকলেন। ওঁর পিছন পিছন আমরাও দৌড়চ্ছি, গরু তাড়াচ্ছি। সত্যজিৎ রায় এই দৃশ্য দেখে হা-হা করে হাসতে থাকলেন আর বললেন, ‘এ কামুই পারে, এ কামুই পারে!’ মনে আছে, সেদিন বেশ ভিড় ছিল শুটিংয়ে। কারণ, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর উৎপল দত্তরও বেশ ক’টা শট ছিল। সেসময় ওঁরা বিপুল স্টার। ফলে শহর থেকে, দূরদূরান্ত থেকে লোক চলে এসেছে শুটিং দেখতে। আমরা ১৩টা ছেলে যখন কামুকাকুর পিছনে দৌড়তে দৌড়তে গরু তাড়াচ্ছি, কামুকাকু মাথা ঘুরিয়ে বললেন, ‘গরু তাড়াচ্ছিস, কয়েকটা মানুষও তাড়িয়ে দে, বড্ড ঢুকে পড়েছে এদিকে!’ আমরা চমকে বলেছিলাম, ‘মানুষও তাড়াব?’ সত্যিই কিছু মানুষ অতি উৎসাহে শুটিং জোনের মধ্যে ঢুকে পড়েছিলেন। হঠাৎই কামুকাকু ‘দূর হাটোওওওওওও’ বলে এমন একটা চিৎকার করলেন যে, হুড়মুড় করে অনেক লোক সরে গেল সেখান থেকে। আবার চলেও এল। সত্যজিৎ খানিক হাল ছেড়ে দিয়েছেন। প্রথমে গরু, তারপরে মানুষ। জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজ কি আদৌ শুটিং হবে?’ কামুকাকু বললেন, ‘আপনি আমাকে আধঘণ্টা সময় দিতে পারবেন?’ সত্যজিৎ বললেন, ‘তুমি কি আধঘণ্টায় লাঠি দিয়ে লোক তাড়াবে? আমাদের বিপদে ফেলবে!’ কামুকাকু হঠাৎ চিৎকার করে বললেন, ‘প্যাক আপ!’– যা বলার কথা সত্যজিৎ রায়ের। সমস্ত কিছু গুটিয়ে তক্ষুনি ইউনিটের সবাই হুড়মুড় করে উঠে পড়লেন বাসে– আমাদের সঙ্গে রবি ঘোষ, তপেন চট্টোপাধ্যায় এবং অবশ্যই কামুকাকু। আলাদা গাড়িতে সত্যজিৎ, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত। তখনও বুঝতে পারছি না, কী হতে চলেছে ব্যাপারটা?
বাস চলতে শুরু করল। ড্রাইভারের পাশে বসে কামুকাকু বাসকে ডিরেকশন দিচ্ছেন। ‘ডানদিকে চলো, বাঁদিকে চলো!’ আমরা বাসের জানলা থেকে দেখলাম, হুড়মুড় করে লোক ফাঁকা হতে আরম্ভ করেছে। লোকজন যেইমাত্র ফাঁকা হয়ে গেল, বাস এসে পৌঁছল শুটিং স্পটে। ‘মানিকদা নেমে পড়ুন, ফাঁকা হয়েছে, শুটিং শুরু করুন।’ বললেন কামুকাকু। ঝটপট করে আমাদের শুটিংও হয়ে গেল।
একবার পুরুলিয়ায় বাসে করে শুটিং দেখতে গিয়েছি, ফেরার পথে বাসের টায়ার পাংচার! পুরনো দিনের বাস। আজকালকার দিনে এত ঝকঝকে-তকতকে নয়। টায়ার পাল্টাতে সময় লাগবে। আমরা অধৈর্য হচ্ছি। বাস থেকে কেউ যাতে নেমে না পড়ে, কামুকাকু বাসে দাঁড়িয়েই ম্যাজিক দেখাতে শুরু করলেন। মাঝেমধ্যে মজা করে বলতেন, ‘যাদের বাথরুম পেয়েছে, শুধু তারাই নামবে।’ আমরা যদিও সক্কলে একসঙ্গে বলতাম, ‘আমার পেয়েছে।’ তখন শুরু হত ধৈর্যের পরীক্ষা, কে কতক্ষণ বাথরুম চেপে রাখতে পারে! যাদের সত্যিই বাথরুম পেয়েছিল, লোক পাহারা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তারপর কামুকাকু বললেন, ‘এবার বাথরুম বন্ধ, শুধু ম্যাজিক।’ দেখলাম, বাসে দাঁড়িয়ে বিস্কুট খাচ্ছেন কামুকাকু, তারপর মাথা থেকে বের করে দিচ্ছেন ঠিক।
‘হীরক রাজার দেশে’র একটা দৃশ্য আছে উদয়ন মাস্টারকে ধরার জন্য পেয়াদা দৌড়চ্ছে। এই শুটিং রাত্রিবেলায়। গাছভরা জঙ্গলের মধ্যে। পাশে টিলা। খবর পেয়েছি আমরা, রাতে শুটিং হবে। সত্যজিৎ রায়ের দেখা পাইনি, কিন্তু দায়িত্বে থাকা আরেকজন– রঞ্জিতকাকুকে আমরা বললাম, ‘আমরাও রাতের শুটিং দেখব।’ একথা কানে গেল কামুকাকুর। বললেন, ‘নিশ্চয়ই দেখবি তোরা।’ উনিই সত্যজিৎ রায়কে রাজি করান এই বলে যে, বাচ্চারা কখনও রাতের শুটিং দেখেনি, ওদের কিন্তু সুযোগ করে দিতে হবে। সত্যজিৎ বলেছিলেন, ‘তুমিই পুরো দায়িত্বটা নাও। একটা বাচ্চাও যেন হারিয়ে না যায়।’
মনে আছে, জেনারেটারের আলোয় শুটিং হয়েছিল। সে জেনারেটারের আলো অনেক সময় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নানা যান্ত্রিক গোলযোগ হয়েছিল, ফলে দেরিও। আমাদেরকে তখন কামুকাকু বলেছিলেন, ‘এই টিলার আশপাশে ভূত ঘুরে বেড়ায়। যদি তোরা নামিস, তাহলে ভূতগুলো এসে সাংঘাতিক ঝামেলা করবে, ধরে নিয়েও যেতে পারে!’ আমরা বলেছিলাম, ‘ভূতগুলো কেমন?’ প্রত্যুত্তরে কামুকাকু অদ্ভুত সব ভঙ্গি করে স্বরচিত ভূতের গান গেয়েছিলেন! বোঝাই যাচ্ছিল, তিনি তক্ষুনি সেসব গান বানিয়েছেন। ওই রাত ভোলা যায় না! শুটিং শেষ হতে হতে সেদিন রাত ১২টা-১টা বেজেছিল। কারও কারও ঘুম পেয়েছিল খুব। ‘ঘুমিয়ে পড়লে ভূতে ধরবে’ এই বলে কামুকাকু জাগিয়েও রেখেছিলেন তাদের।
‘হীরক রাজার দেশে’র শুটিংয়ে সত্যিই কাউকেই ভূতে ধরেনি। ধরেছিল অদ্ভুতে। সেই অদ্ভুত, অপূর্ব লোকটির নাম কামু মুখোপাধ্যায়।
…………………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………………….
আমাদের এই ভাগ হয়ে যাওয়া দুই বাংলার দুই ব্যক্তিত্ব। একজনের হাতে কলম, অন্য জনের গলায় শুধু গান। দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সন্জীদা খাতুন। দু’জনের মধ্যে ছিল এক আশ্চর্য ভালোবাসার সম্পর্ক। আজ, সন্জীদা খাতুনের জন্মদিন উপলক্ষে দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে লেখা সন্জীদা খাতুনের তিনটি অপ্রকাশিত চিঠি, রোববার ডিজিটালে।