১৯৮৭ এর কেতন মেহতার ছবি ‘মির্চ মাসালা’-র শেষ দৃশ্য। সোনবাইয়ের ভূমিকায় স্মিতা পাটিল। ভারতের সিনেমা জগতের সেই মানুষ যিনি সোনবাইয়ের মতোই বারবার ‘না’ বলতে পারতেন। বলিউডের মেয়েদের জন্য, নায়িকাদের জন্য বেঁধে দেওয়া নানা ফরমুলায় যিনি অবলীলায় বারবার ‘না’ বলেছেন। না বলেছেন রুপোলি পর্দার গতে বাঁধা নারী চরিত্র হতে। উল্টে রুপোলি পর্দায় তুলে এনেছেন রোজকার জীবনের নারী চরিত্রদের।
চারের দশকের গুজরাতের এক গ্রাম। তৎকালীন সুবেদারের সন্ত্রাসে তটস্থ! সুবেদার যখন ইচ্ছে গ্রামে এসে ইচ্ছামতো লুট করে যায়, পছন্দমতো মেয়ের ওপর তার ‘হক’ জাহির করে। সেই সুবেদারকে সজোরে ‘না’ বলে একটি দলিত মেয়ে, সোনবাই। সেই মেয়ের ‘না’ নিয়ে গ্রামে হুলস্থুল পড়ে যায়। সুবেদার জানায়, এই মেয়ে তার কাছে না এলে সে সারা গ্রাম উজাড় করে দেবে। গ্রামে পঞ্চায়েত বসে। পঞ্চায়েত নিদান দেয় সোনবাইকে সুবেদারের কাছে সঁপে দেওয়া হবে। সোনবাই একবগ্গা ভাবে জানায়, ‘না’। আশ্রয় নেয় মশলা কারখানায়। সুবেদার সেপাই সান্ত্রী নিয়ে কারখানামুখো হয়। গ্রামের মুখ্য কারখানার দরজায় এসে সোনবাইকে আদেশ দেয় সুবেদারের কাছে যেতে। আশ্বস্ত করে সুবেদার ছেড়ে দিলে যদি তার মরদ তাকে ঘরে নিতে রাজি না হয়, তাহলে গ্রামের সবাই তার মরদকে বুঝিয়ে বাধ্য করবে। সোনবাই সাফ জানিয়ে দেয়, ‘না’। বলে এমনকী, তার মরদ বললেও সে যাবে না। সুবেদারের লেঠেল বাহিনী কারখানার দরজা ভাঙতে শুরু করলে হাতে তুলে নেয় কাস্তে। কারখানার দারোয়ান আবু মিঞা রুখে দাঁড়িয়েও শেষ রক্ষা না করতে পারলে সুবেদারের দিকে ধেয়ে আসে একদল মেয়ে। সোনবাইয়ের কারখানার সহকর্মীরা। সুবেদারের চোখে ছুড়ে মারে মুঠো মুঠো লঙ্কার গুঁড়ো। সুবেদার মাটিতে পড়ে গেলে পর্দা জুড়ে থাকে কাস্তে হাতে সোনবাইয়ের মুখ। পর্দা কালো হয়ে গেলেও ভাসতে থাকে সোনবাইয়ের সজোরে ‘না’ বলতে থাকা দুই চোখ, লঙ্কার গুঁড়োর লাল আর সম্মিলিত মেয়েদের প্রতিরোধের চিৎকার। যেন পর্দা জুড়ে লিখে যায় ‘না’। ক্ষমতার সামনে ‘না’ বলতে পারার স্পর্ধা।
১৯৮৭ এর কেতন মেহতার ছবি ‘মির্চ মাসালা’-র শেষ দৃশ্য। সোনবাইয়ের ভূমিকায় স্মিতা পাটিল। ভারতের সিনেমা জগতের সেই মানুষ যিনি সোনবাইয়ের মতোই বারবার ‘না’ বলতে পারতেন। বলিউডের মেয়েদের জন্য, নায়িকাদের জন্য বেঁধে দেওয়া নানা ফরমুলায় যিনি অবলীলায় বারবার ‘না’ বলেছেন। না বলেছেন রুপোলি পর্দার গতে বাঁধা নারী চরিত্র হতে। উল্টে রুপোলি পর্দায় তুলে এনেছেন রোজকার জীবনের নারী চরিত্রদের। যারা খেতে, কারখানায় কাজ করে, যাদের জীবন জটিল, যারা দৈনন্দিন জীবনে নিজেদের মতো করে বাঁচার লড়াই করে, যে মেয়েরা প্রতিবাদ করে, রুখে দাঁড়ায়, সংগঠিত হয়। বাবা-মা সমাজতন্ত্রী পার্টিতে (পরবর্তীকালে তাঁরা জয়প্রকাশ আন্দোলনে সক্রিয় হন) থাকাকালীন যে মেয়েদের হয়তো স্মিতা চাক্ষুষ করেছিলেন বেড়ে ওঠার সময়, হয়তো বা যে মেয়েদের সঙ্গে দিন কাটিয়েছেন, গল্প করেছেন সাংস্কৃতিক টিমের সঙ্গে গ্রামে গ্রামে ঘুরে নাটক করার সময়– সেই অভিজ্ঞতা, সেই রাজনীতিই স্মিতাকে শিখিয়েছে পিতৃতান্ত্রিক নানা নিয়মকে ‘না’ বলতে। শিখিয়েছে বক্স অফিসের অঙ্কের তোয়াক্কা না করে একের পর এক ছকভাঙা ছবি করতে। হিন্দি সিনেমার লক্ষ্মী মেয়ের চরিত্র ছেড়ে ঝামেলাবাজ, অবাধ্য মেয়ে হয়ে উঠতে।
আটের দশক অবশ্য দেশজুড়ে সাধারণ মেয়েদেরও অবাধ্য, ঝামেলাবাজ হয়ে ওঠার সময়। ১৯৭২-এ মহারাষ্ট্রের গড়চিরোলিতে এক আদিবাসী মেয়ে, মথুরা, থানায় এক পারিবারিক সমস্যার অভিযোগ জানাতে গেলে তাঁকে থানাতেই ধর্ষণ করে দুই পুলিশ। পুলিশের বিরুদ্ধে মথুরা অভিযোগ করে। ১৯৭৮-এ সর্বোচ্চ আদালত রায় দেয় মথুরা যেহেতু যৌন সম্পর্কে অভ্যস্ত তাঁর নিশ্চয়ই সম্মতি ছিল। দেশজুড়ে ক্ষোভে ফেটে পড়ে মেয়েরা। সংগঠিত হয়ে মথুরার হয়ে ধিক্কার জানায় আদালতের এই রায়কে। মহারাষ্ট্রে তৈরি হয় ‘ফোরাম এগ্রেইনস্ট রেপ’। সেই সংগঠিত মেয়েদের লড়াইয়ের আগুনে রাজনীতিকরণ হয় মেয়েদের ‘না’ বলার অধিকারের। আন্দোলনের চাপে বদল হয় তৎকালীন ধর্ষণ বিরোধী আইন। মেয়েদের সম্মতির প্রশ্ন আইনি স্বীকৃতি পায়। বলা হয়, কোনও মেয়ে যদি ‘না’ বলে, আদালত সেটাকে ‘না’ বলেই ধরবে। একই সঙ্গে, পুলিশি হেফাজতে ধর্ষণ ‘দণ্ডনীয় অপরাধ’ হিসেবে গণ্য হয় এবং ধর্ষণ প্রমাণ করার দায় অভিযোগকারিণীর থেকে অভিযুক্তের ওপর বর্তায়। মেয়েদের এই একসঙ্গে এসে মথুরার হাতে হাত ধরে একটি রায়কে নাকচ করার লড়াই স্বীকৃত করে আমাদের ‘না’ বলার অধিকারকে। দেশজুড়ে নারী আন্দোলনের এক নতুন জোয়ার আনে। স্বতন্ত্র নারী আন্দোলনের। যে-আন্দোলনের ডাকে দেশজুড়ে মেয়েরা সংগঠিত হয়। রাষ্ট্রের ছত্রছায়াকে নাকচ করে, পার্টির ফরমানকে নাকচ করে, বিদেশি পুঁজিকে সজোরে ‘না’ বলে দিকে দিকে গড়ে ওঠে মেয়েদের নিজস্ব রাজনৈতিক সংগঠন। সেই নারীবাদী আন্দোলনের জোয়ারেই দিকে দিকে গড়ে ওঠে নিপীড়িত মেয়েদের আশ্রয় স্থল, নিপীড়িত মেয়েদের সহায়তা কেন্দ্র। সমাজ সেবার আদলকে ভেঙে মেয়েদের সংহতির রাজনীতিতে তৈরি হয় ‘Women’s Centre’. গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হয়ে বাড়ির চৌকাঠ ডিঙিয়ে বেরিয়ে আসা মেয়ে, কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্তার বিরুদ্ধে লড়তে চাওয়া মেয়ে, ধর্ষণের বিরুদ্ধে লড়তে চাওয়া মেয়ে, পণপ্রথাকে না বলতে চাওয়া মেয়ে– আটের দশকে নানা মুষ্টিবদ্ধ হাত এক করতে থাকার কেন্দ্র হয় ওঠে বোম্বের এই ‘‘women’s centre’’. সেই মুষ্টিবদ্ধ হাতের সংগঠিত হওয়ার মধ্য দিয়েই পরিণত হতে থাকে ভারতের স্বতন্ত্র নারী আন্দোলন। সেন্টারে আসা নানা মেয়েদের জীবন সংগ্রাম থেকেই রাজনীতিকরণ হতে থাকে লিঙ্গ হিংসার প্রশ্নের। লড়াই গড়ে ওঠে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। এই পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। কখনও কারও বাড়ির এককোণে, তো কখনও অন্য কোনও সংগঠনের কিছু সময়ের জন্য ধার দেওয়া অফিস ঘরে যখন ‘‘women’s centre’’ কোনও রকমে ঠাঁই হাতড়ে চলছে, তখন এগিয়ে আসেন স্মিতা পাটিল।
জানান, তাঁর সদ্য মুক্ত মারাঠি ছবি ‘উমবার্থা’ (হিন্দিতে ‘সুবাহ’) ছবির প্রিমিয়ারের টাকা তুলে দেবেন উইমেন্স সেন্টারকে একটা ঘর কেনার জন্য। নারী আন্দোলনের কর্মীদের স্মৃতিচারণে পাওয়া যায় কীভাবে গোটা অনুষ্ঠানের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন স্মিতা। স্মিতার মৃত্যুর পর ১৯৮৭-এর নারীবাদী আন্দোলনের তখনকার অন্যতম পত্রিকা ‘মানুষী’তে নারী আন্দোলনের কর্মী, সোনাল শুক্লা লেখেন, ১৯৮৩-তে সেই সময়ে একটি দুর্ঘটনায় রেলপথ বন্ধ হয়ে গেছিল। একই সঙ্গে বর্ষায় শহরের বেশিরভাগ এলাকা জলমগ্ন থাকায় সেন্টারের বেশিরভাগ স্বেচ্ছাকর্মীর পক্ষেই এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করা মুশকিল হয়ে পড়েছিল। স্মিতাকে শুধু কী কী লাগবে– একটা লিস্ট ধরিয়ে দিলেই হত, তিনি নিজেই দিনের শেষে জানিয়ে দিতেন কতটা করতে পেরেছেন, কী কী বাকি আছে। ‘উমবার্থা’ ছবির নায়িকার পরিচালনায় চলা মেয়েদের শেল্টার হোমের মতোই স্মিতার হাত ধরে নতুন করে প্রাণ পায় ‘‘women’s centre’’. ছবির মেয়েদের বেঁধে বেঁধে থাকার রাজনীতিতেই বাস্তবে রূপ পায় নারী আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল। আরও আরও সোনবাইদের ‘না’ বলার জমি তৈরি করে। আরও আরও মেয়েদের সংগঠিত হওয়ার ভিত তৈরি করে। স্মিতা আমৃত্যু সেই ‘‘women’s centre’’-এর সদস্য থাকেন। সাথী থাকেন তাঁর ভাঙাগড়া নানা পথ চলার। পরে অবশ্য ব্যক্তিগত জীবনের টানাপোড়েনের ফল নারী আন্দোলনের কিছু সাথীদের সঙ্গে তাঁর বন্ধু বিচ্ছেদ হয়। সে আরেক গল্প।
আজ যখন আবারও শহর উত্তাল হয়েছে মেয়েদের ‘no means no’ স্লোগানে, পিতৃতন্ত্রিক নিয়মাবলিকে ছুড়ে ফেলে রাতের দখল নিচ্ছে মেয়েরা, রাষ্ট্রের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে শহরে গ্রামে মফসসলে সংগঠিত হচ্ছে, সিনেমা পাড়ার মেয়েরাও সজোরে ‘না’ বলছে, সংগঠিত হচ্ছে একে-অপরের ‘না’ বলাকে আরও জোরালো করতে, সরব হচ্ছে মর্যাদাপূর্ণ কর্মক্ষেত্রের দাবিতে, ঘরে-বাইরে সমানাধিকারের দাবিতে, তখন এই মুষ্টিবদ্ধ হাতগুলো বারবার মনে করাচ্ছে সেই চার দশক আগের সিনেমার দৃশ্য। মশলা কারখানার সেই মেয়েদের সোনবাইয়ের হাতে-হাত রেখে লড়াইয়ের ছবি। ‘না’ বলতে পারার স্পর্ধা। আর মনে করাচ্ছে, সেই মেয়েটির কথা যে চার দশক আগে পর্দার সামনে-পিছনে সংগঠিত করছিল অবাধ্য মেয়েদের ‘না’ বলতে পারার লড়াই।
যে উন্মত্ত জনতার ঢেউ রবীন্দ্রনাথকে প্রয়াণের পর ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, সেই ঢেউ হয়ে ওঠা জনতার অন্তর্গত মানুষগুলি কি জানতেন, তাঁদের এই মানুষটির প্রতি বিশ্বের মানুষের গভীর শ্রদ্ধার কথা! কয়েক মাস পড়ে, এই সংখ্যাটি কি হাতে নিয়ে দেখেছিলেন ভিড়ের মানুষেরা?