‘বিরাটি সমূহ পারফর্মারস কালেকটিভ’-এর এই নাটকটি কলকাতার ঐতিহ্যবাহী বেলিয়াঘাটার ব্যারিস্টার বাবুর বাড়িতে পরিবেশিত হয়, যেখানে নাটকের কাহিনির সঙ্গে বাড়ির স্থানিকতা একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সমূহ, একটি ক্যুয়ার পারফরম্যান্স কালেকটিভ, তাদের শিল্পের মাধ্যমে শুধুমাত্র নাট্যকলাকে নয়, বরং সমাজের নানা স্তরের নিপীড়ন, বৈষম্য, অসাম্যকে তুলে ধরে। নাটকের জন্য এই খিলান, এই দোর, এই লাল মেঝে কোনও নাট্যমঞ্চ নয়, বরং এই বাড়িটিই নাটকের চরিত্র, জীবন্ত মঞ্চ রূপে আবির্ভূত হয়, যার মধ্য দিয়ে অতীত এবং বর্তমানের সংঘর্ষ এবং পরিবর্তন চাক্ষুস করা যায়।
ভেতরের প্রতিটি ছবি স্নিগ্ধেন্দু ঘোষাল-এর তোলা
কলকাতার ঐতিহ্যময় বাড়ির খিলান, সোপান, লাল মেঝে– এই প্রাচীন স্থাপত্যের মাঝে ‘কেয়াবাৎ মেয়ে’ নাটকের পরিবেশনা যেন সময়ের গহ্বরে ডুব দেওয়ার আমন্ত্রণ। তবে এটি শুধুমাত্র একটি অতীতের গল্প নয়, এটি এক আধুনিক ও নিরীক্ষামূলক খণ্ডচিত্র, যা বর্তমান সমাজেরই প্রতিফলন।
‘বিরাটি সমূহ পারফর্মারস কালেকটিভ’-এর মঞ্চস্থ এই নাটকটি বেলিয়াঘাটার ব্যারিস্টার বাবুর বাড়ি-তে পরিবেশিত হয়, যেখানে নাটকের কাহিনির সঙ্গে বাড়িটির স্থানিকতা একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সমূহ একটি ক্যুয়ার পারফরম্যান্স কালেকটিভ, তারা তাদের শিল্পের মাধ্যমে শুধুমাত্র নাটককে নয়, বরং সমাজের নানা স্তরের প্রতিনিধিত্বকেও তুলে ধরে।
এই নাটকটা একটি স্থান-নির্দিষ্ট কাজ। এটা অন্য কোথাও মঞ্চস্থ করা সম্ভব নয়। এই পরিবেশনার প্রযোজক DAG এবং এই নাটক একটি অভিজাত মধ্যবিত্ত যৌথ পরিবারের বাসকক্ষ থেকে বিকশিত। এটি গৃহস্থালির বিভিন্ন জায়গাকে নতুন আঙ্গিক দিয়েছে, নতুন স্থানিকতা দিয়েছে। এই নাটকটি শ্রীপন্থের ‘কেয়াবাৎ মেয়ে’ গ্রন্থ থেকে অনুপ্রাণিত, যা সাতটি প্রবন্ধের একটি সংগ্রহ, উনিশ শতকের স্যাটিরিক নাটকগুলির বিরোধিতা করে লেখা। এই নিবন্ধগুলো ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নারীদের জীবনের জটিলতা, সমাজে তাদের স্থান এবং ব্যক্তিগত পরিচিতির অন্বেষণকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। নাটকটি সাহিত্যিক আখ্যানকে মঞ্চে রূপান্তরিত করে, যেখানে উপন্যাসের চরিত্র এবং কাহিনি নতুন নাট্যভাষায় প্রাণ পায়।
নাটকের জন্য এটি শুধু একটি স্থান নয়, বরং এই বাড়িটি একপ্রকার জীবন্ত চরিত্রের রূপে আবির্ভূত হয়, যার মধ্য দিয়ে অতীত এবং বর্তমানের সংঘর্ষ এবং পরিবর্তন প্রতিফলিত হয়। বাড়ির প্রতিটি কোণা, বারান্দা, ছাদ, এবং চারটি কোণ নাটকের চরিত্রদের যাত্রায় অংশগ্রহণ করে, এবং সেটি এমন এক অনুভূতি সৃষ্টি করে যেখানে স্থান নিজেই গল্পের অংশ হয়ে ওঠে।
বর্তমানে, এই সময়ের সাক্ষী হয়ে থাকা বাড়িটির পরিচালনা পদ্ধতিও বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। এটি মূলত বাড়ির মহিলাদের হাতে পরিচালিত হচ্ছে, যারা এর প্রতিটি কোণ এবং দালান ধরে নিজেদের সংগ্রাম, স্বপ্ন, এবং আশা গড়ে তুলেছে। নারীরা তাদের সংগ্রামের মাধ্যমে বাড়ির ইতিহাস ও সংস্কৃতির ধারক হয়ে উঠেছে। বাড়িটির জটিল, কিন্তু সূক্ষ্ম রক্ষণাবেক্ষণ, তাদের জীবনযাত্রার পরিচয়কেই প্রতিফলিত করে। নারীদের হাতেই এই বাড়ির বর্তমান সুরক্ষা এবং রক্ষণাবেক্ষণ, তাদের অভ্যন্তরীণ শক্তি এবং কর্তৃত্বের একটি সূক্ষ্ম চিত্র তুলে ধরে, যা নাটকের মূল বিষয়ের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। এইভাবে, ব্যারিস্টার বাবুর বাড়ি শুধুমাত্র নাটকের স্থান নয়, বরং একটি শক্তিশালী প্রতীক হয়ে ওঠে– একটি ঐতিহ্য ও বর্তমানের মিলনস্থল, যেখানে নারীরা তাদের সংগ্রাম, সম্ভাবনা এবং পরিচয় গঠন করছে।
নাটকের মঞ্চরূপ ও স্থানবদ্ধতার মধ্যে প্রতিটি চরিত্র তাদের যাত্রা এবং সংগ্রামকে আরও জীবন্ত করে তোলে। বিশেষত, ব্যারিস্টার বাবুর বাড়ি-র মধ্যে পুরুষ শাসিত সমাজ এবং নারীর সংগ্রামের যে দ্বন্দ্ব, তা স্পষ্টভাবে উদ্ভাসিত হয়। বাড়ির বাহিরমহল, যেখানে পুরুষের আধিপত্য, এবং অন্তর্মহল, যেখানে নারীদের গোপন সংগ্রাম চলে– এই দু’টির মধ্যেকার সম্পর্ক নাটকের অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। বাহিরমহল, যেখানে পুরুষরা ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে উপস্থিত, সেখানে নারীরা অন্তর্মহলে একটি অব্যক্ত স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে। এই দ্বৈত দৃষ্টিভঙ্গি নাটকটির আখ্যানকে আরও গভীর এবং চিরন্তন করে তোলে।
নাটকের অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে ঊনবিংশ শতাব্দীর নারীদের জীবনের পুনর্জন্ম। এই নাটকে রাসসুন্দরী দেবী, যিনি বাংলা ভাষায় প্রথম আত্মজীবনী লিখেছিলেন, সেই সংগ্রামী নারীকে পুনরায় জীবন্ত করে তোলা হয়েছে। তিনি এমন একসময়ে লুকিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন, যখন নারীদের শিক্ষাগ্রহণ সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার জীবন’ শুধুমাত্র ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ নয়, এটি ছিল নারীর আত্মসম্মান এবং শিক্ষার অধিকার অর্জনের এক নির্ভীক ঘোষণা।
এছাড়া, জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর কাহিনিও নাটকে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। তিনি শুধু একটি ঐতিহাসিক চরিত্র নন; আধুনিক বাঙালি নারীর পোশাক-বিপ্লবের অগ্রদূত। ব্রাহ্মিকা শাড়ির প্রচলন করে তিনি নারীদের জন্য এমন একটি উপযোগী পোশাক নির্মাণ করেছিলেন, যা তাদের চলাফেরা ও জনসমক্ষে আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্রে সুবিধা করে দিয়েছিল। তাঁর এই কাজ নারীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে বিবেচিত হয়। নাটকে তার উপস্থিতি শুধুমাত্র এক ঐতিহাসিক উদ্ভাবক হিসেবে নয়, বরং একজন সামাজিক সংস্কারক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
অন্যদিকে, বিনোদিনী দাসীর সংগ্রাম নাটকের আবেগঘন স্তরকে আরও গভীরতা দিয়েছে। পুরুষতান্ত্রিক থিয়েটার জগতে একজন অভিনেত্রী হয়ে নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করাটা তার জন্য ছিল এক অবিরাম যুদ্ধ। তিনি ছিলেন মঞ্চের উজ্জ্বল নক্ষত্র, কিন্তু স্টার থিয়েটারের প্রতিষ্ঠার পরও তার প্রাপ্য স্বীকৃতি পাননি। পুরুষতন্ত্রের চাপে বারবার অবহেলিত হলেও বিনোদিনী তাঁর শিল্পীসত্তাকে সমৃদ্ধ করেছিলেন এবং বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে এক স্থায়ী ছাপ রেখে গেছেন।
নাটকে এই তিনটি চরিত্রের পুনরুজ্জীবন কেবল অতীতের সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি নয়; এটি বর্তমানের নারী আন্দোলনের এক শিল্পিত প্রতিবিম্ব। নারীর অধিকার, আত্মসম্মান, এবং সামাজিক স্বীকৃতির যে লড়াই ঊনবিংশ শতাব্দীতে শুরু হয়েছিল, তা আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। কেয়াবাৎ মেয়ে তাই কেবলমাত্র ঐতিহাসিক নাট্যরূপ নয়; এটি এক অনিঃশেষ সংগ্রামের সৃজনশীল উপস্থাপনা।
নাটকের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হল রসবতী– বাড়ির কাজের মেয়ে, কিন্তু সে একধরনের বিদ্রোহী কণ্ঠ। রসবতী পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে, যদিও তার কণ্ঠ গোপন থাকে। নাটকে তার সংলাপ শুধু হাস্যরস বা ঠাট্টা নয়, বরং গভীর যন্ত্রণা ও কষ্টের চিহ্ন বহন করছে। রসবতী, যার কণ্ঠ নেই, সে কিনা সমস্ত পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোকে তীব্রভাবে প্রশ্ন তোলে।
নাটকের যে দৃশ্যটি কিছুটা হতাশাজনক, তা হল চতুষ্কোণ চত্বরে চারটি প্রেমের সম্পর্কের উপস্থিতি– একটি বিসমকামী প্রেমিক-প্রেমিকা, একটি সমকামী নারী যুগল, একটি সমকামী পুরুষ যুগল এবং এক বিধবা ও তার প্রেমিক। কিন্তু, নাটকটি কেবল বিসমকামী প্রেমিক-প্রেমিকার গল্পকে প্রাধান্য দেয়, অন্য তিনটি সম্পর্ক যেন কেবল উপস্থিতির জন্য রাখা হয়েছে। এই ধরনের উপস্থাপনাকে ‘ক্যুয়ারবেটিং’ বলা যেতে পারে, যেখানে সমকামী চরিত্রের ইঙ্গিত দেওয়া হলেও তাদের কাহিনির গভীরে প্রবেশ করা হয় না। নাটকের প্রেক্ষাপটে, যদি কল্পিত চরিত্র ব্যবহারের সুযোগ থাকে, তবে রূপান্তরকামী এবং ক্যুয়ার চরিত্রদের অন্তর্ভুক্তি আরও স্পষ্টভাবে করা যেতে পারত।
এই নাটকটি আধুনিক দর্শকদের জন্য বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক, যেহেতু আমাদের সমাজ এখনও নারীর স্বাধীনতা এবং তার অধিকারের ক্ষেত্রে অনেক পথ পাড়ি দিতে বাকি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চিত্র এখনও গভীরভাবে আমাদের মনে স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে। নাটকের শেষ দৃশ্যে একজন বিধবা তার পিতার গিয়ে বলে, সে তার প্রেমিককে বিয়ে করতে চায় না। তার মুখে উঠে আসে একটি গভীর বার্তা: ‘হ্যাঁ, আমি তাকে ভালোবাসি। কিন্তু এখনই বিয়ে করতে চাই না। আগে পড়াশোনা করব।’ এই দৃশ্যটি ঊনবিংশ শতাব্দীর নারীর সংগ্রামের প্রতীক হয়ে ওঠে। এটি একদিকে যেমন সামাজিক নিয়মের বিরুদ্ধে একটি দৃপ্ত ঘোষণা, তেমনি নারীর নিজের জীবনের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দাবি করার এক সাহসী পদক্ষেপ।
নাটকের শেষের দিকে, যেখানে গল্প সমাপ্ত হয়, সেখানে পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো এবং সমাজের চাপের বিরুদ্ধে প্রতিটি চরিত্রের সংগ্রাম নতুন মাত্রা লাভ করে। বিসমকামী দম্পতির পাশাপাশি, সমকামী দম্পতিদের উপস্থিতি সমাজের নতুন মানসিকতার প্রতিফলন হতে পারে, যদিও এটি উপসর্গ মাত্র। তবে, নাটকটি সেই বার্তা দিতে পেরেছে যে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ, না শুধুমাত্র পুরুষ, নারীর জন্য ‘সমান অধিকার’ স্বীকার করতে বাধ্য।
শেষে বলা যায়, কেয়াবাৎ মেয়ে শুধুমাত্র একটি নাট্যপ্রযোজনা নয়, এটি নারী আন্দোলনের একটি সংবেদনশীল শ্রদ্ধাঞ্জলি, যা অতীত এবং বর্তমানের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরি করে। তবে, এটি আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে পারত। আমাদের সমাজ এখনও সম্পূর্ণভাবে ট্রান্স এবং ক্যুয়ার নারীদের গল্পকে স্বীকার করতে প্রস্তুত নয়। যদি নাটকটি আরও বৈচিত্র্যময় গল্পের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন স্তরের নারীদের সমস্যা ও সংগ্রাম তুলে ধরতে পারত, তবে এটি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠত। কিন্তু, নাটকটির যে বক্তব্য রয়েছে তা যথেষ্ট গভীর, তীক্ষ্ণ এবং স্মরণীয়। অতীতের নারীদের সংগ্রামের কণ্ঠস্বর আজও আমাদের মনে করিয়ে দেয়, নারী সংগ্রাম কখনও থামে না। এবং সেই সংগ্রামের কাহিনি মঞ্চে, সিনেমায়, কিংবা জীবনের যে কোনও ক্ষেত্রে শোনানো এবং শোনা উচিত।