এ কথা আমার নয়, তাঁরই বলা। এক শতকে বা এক সহস্রাব্দে একজন শিল্পীই উস্তাদ জাকির হুসেন হয়ে ওঠেন, যিনি একটি সংগতকারী বাদ্যযন্ত্রকে একক বাদ্যযন্ত্রে পরিণত করেন অনায়াসে। দেখলে মনে হয় অনায়াস, কিন্তু এর নেপথ্যে ওঁর একজীবনের অধ্যবসায় ও আয়াস লেগেছিল। সারা পৃথিবীতে তবলাকে একটি একক বাদ্যযন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা খুব সহজ কাজ ছিল না। তাঁর বাজানো, তাঁর জ্ঞান, তাঁর সাধনা নিয়ে বলার জন্য যোগ্য মানুষ আমি নই। আমি তাঁর গুণমুগ্ধ একজন শ্রোতা, পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে থাকা কোটি কোটি শ্রোতার মধ্যে একজন। সেই হিসেবেই আমি নিজেকে দেখতে ভালোবাসি।
প্রচ্ছদ শিল্পী: দীপঙ্কর ভৌমিক
শোকের কথা তো বলছে সকলেই, আমি বরং আজ সৌজন্যের কথা বলি। যে-কোনও মানুষ যখন বড় হন, বৃহৎ হন, তখন তাঁর মধ্যে এমন অনেক গুণাবলি থাকে, যা শিখতে, চাইতে ইচ্ছে করে। তাঁর প্রধান গুণ, যাঁর জন্য তিনি বৃহৎ, তা চেয়েও সবসময় শেখা যায় না। যেমন আমরা যে-কেউ চাইলেই উস্তাদ জাকির হুসেনের মতো তবলায় বোল তুলতে পারব না। সে কেবল পরিশ্রমের ফল নয়, সাধনার ফল নয়, অনুশীলন বা নিয়মানুবর্তিতার ফল নয়, সঙ্গে আছে সেই অলীক জাদুময়তা, সেই ব্যাখ্যাহীন রসদ, যার নাম: প্রতিভা।
জন্মের সঙ্গে সঙ্গে শিরায় রক্ত হয়ে বইতে শুরু করে ছিল। সেইটির সঙ্গে পরিশ্রম, অনুশীলন, চর্চা, নিয়মানুবর্তিতা যোগ করলে তবে একজন জাকির হুসেন হতে পারেন। এক শতকে বা এক সহস্রাব্দে একজন শিল্পীই উস্তাদ জাকির হুসেন হয়ে ওঠেন, যিনি একটি সংগতকারী বাদ্যযন্ত্রকে একক বাদ্যযন্ত্রে পরিণত করেন অনায়াসে। দেখলে মনে হয় অনায়াস, কিন্তু এর নেপথ্যে ওঁর একজীবনের অধ্যবসায় ও আয়াস লেগেছিল। সারা পৃথিবীতে তবলাকে একটি একক বাদ্যযন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা খুব সহজ কাজ ছিল না। তাঁর বাজানো, তাঁর জ্ঞান, তাঁর সাধনা নিয়ে বলার জন্য যোগ্য মানুষ আমি নই। আমি তাঁর গুণমুগ্ধ একজন শ্রোতা, পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে থাকা কোটি কোটি শ্রোতার মধ্যে একজন। সেই হিসেবেই আমি নিজেকে দেখতে ভালোবাসি।
মনে পড়ে যাচ্ছে, প্রথম জাকিরজিকে শুনি আমার সাত বছর বয়সে। কলকাতার মহাজাতি সদনে। তারপর থেকে জাকিরজি কলকাতায় বাজিয়েছেন, কিন্তু আমি শুনিনি, এমনটা হয়নি। শেষ শুনেছিলাম গত বছর। নজরুল মঞ্চে। একক। যখন আমার বয়স ৪৮। অর্থাৎ, দীর্ঘ ৪১ বছর ধরে প্রতি বছর আমি ওঁকে বাজাতে শুনেছি। ঠিক যেমন সপ্রতিভ, স্বতস্ফূর্ততার সঙ্গে বাজিয়েছিলেন প্রথম দিন আমার শৈশবে, আমার মধ্য বয়সে, গত বছর, ঠিক তেমনভাবেই বাজাতে শুনেছি। হয়তো চোখে-মুখে শরীরী বিভঙ্গে শ্রান্তির ছাপ এসেছে, ৭২ বছর বয়সে সেটা স্বাভাবিকের চেয়েও বেশি, কিন্তু বাজনা? তার কোথাও কোনও খামতি হয়নি। মনে আছে, নজরুল মঞ্চে বাজনা শুরু করলেন পাঞ্জাব ঘরানার একটি পেশকার দিয়ে। আমি ঘড়ি দেখছিলাম। পাক্কা ২৮ মিনিট একটি পেশকার প্রস্তুত করলেন তিনি। নামিয়ে রাখলেন, সাজিয়ে রাখলেন আমাদের সামনে। তারপর পরন্ত, উঠান, গৎ, চক্রধার, বাজালেন কত কিছুই। এবং শেষে কয়েকটি ছবি– হরিণের ছুটে যাওয়া, বৃষ্টির ঝরে পড়া, শিবের ডমরু বা কৃষ্ণের শঙ্খ। যার জন্য হয়তো গানবাজনার তুমুল সমঝদারদের বাইরেও তাঁর খ্যাতি একইভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল।
কিন্তু আমি ভাবছিলাম, ভারতে বা সারা পৃথিবীতে ক’জন তবলিয়া আছেন এখন, যিনি ২৮ মিনিট একটি পেশকার বাজালে পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহ চুপ করে শুনবে? মন্ত্রমুগ্ধ হবে? নিজেকে বর্ধিত করে, নিজে শাখা-প্রশাখাকে বিরাটভাবে ছড়িয়ে ফেলেও নিজের শিকড়কে তুমুলভাবে আঁকড়ে থাকার নামই জাকির হুসেন। কিন্তু সেইখানেই শেষ নয়। কোন সৌজন্যের পাঠ তিনি আমাদের শিখিয়ে গেলেন, আজকের ভারতে দাঁড়িয়ে এইটে ভাবার সময় এসেছে। তাঁকে দেখতাম বরাবর নিজের যন্ত্র দু’টি নিজের হাতে করে মঞ্চে উঠছেন। একহাতে তবলা অন্য হাতে বাঁয়া। সে দু’টি নিয়েই তিনি মঞ্চে উঠে দাঁড়াতেন। মাথা সামান্য ঝুঁকিয়ে শ্রোতাদের অভিবাদন গ্রহণ করে বাজাতে বসতেন।
…………………………………………..
সোয়াই গন্ধর্ভ ফেস্টিভ্যালে একবার উস্তাদ সুলতান খাঁ-র সঙ্গে জাকিরজি সংগত করছেন এবং সামনে হাজারও ফ্ল্যাশ থেকে থেকেই জ্বলে উঠছে। বাজনার ব্যাঘাত ঘটছে। একসময় ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। সুলতান খাঁ সাহেবকে থামিয়ে জাকিরজি সরস্বতীর শ্লোক আওড়ালেন সংস্কৃতে। পুরো শ্লোকটি শেষ করে বললেন, আপনারা যদি জেনে থাকেন মা সরস্বতী কে, তাহলে বুঝবেন আমরা তাঁর সাধনা করতে এখানে বসেছি। এই সাধনায় আর যদি ব্যাঘাত ঘটান, আমি আর সুলতান ভাই উঠে চলে যাব। এই হলেন জাকির হুসেন।
…………………………………………..
এক সাক্ষাৎকারে, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পীদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তাঁদের মধুরতম বা সুন্দরতম সফর কোনটি। কেউ বলেছিলেন পাহাড়ি কোনও গ্রামের কথা, কেউ বলেছিলেন বিদেশের কোনও সফরের কথা, কেউ বলেছিলেন কোনও উপত্যকার মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়া হাইওয়ের কথা। একমাত্র উস্তাদ জাকির হুসেন বলেছিলেন, গ্রিনরুম থেকে স্টেজে যাওয়ার পথটুকু! সেটিই সুন্দরতম সফর। সারা পৃথিবী বারকয়েক চষে ফেলা একজন শিল্পী যখন ওই নাতিদীর্ঘ পথটুকুকে ‘শ্রেষ্ঠ সফর’ হিসেবে বেছে নেন, তখন বুঝতে হয় শিল্পই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় পৃথিবী। শ্রোতাদের সঙ্গে হাসিঠাট্টায়, কথোপকথনে, এমন এক আবহ তৈরি করে নিতেন, মনে হত না অত প্রাজ্ঞ একজন শিল্পী মঞ্চে, উচ্চ আসনে আসীন হয়ে আমাদের বাজনা শোনাচ্ছেন। যত বড় প্রেক্ষাগৃহই হোক না কেন, উনি তাঁকে ঘরোয়া আসরে বদলে দিতে পারতেন মুহূর্তে। ছোট ছোট হাসির কথায়। সংযোগে। সংলাপে। কিন্তু এই সদালাপী, সদাহাস্যময় জাকির হুসেনই স্পষ্ট ভাষায় গর্জে উঠতেন, যদি বাজনায় ব্যাঘাত ঘটত কোনও। এ দৃশ্যও আমার নিজের চোখে একাধিকবার দেখা, মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বলে ওঠা, বাজনা চলাকালীন মানুষের কথোপকথন বা লাগাতার সামনে দিয়ে যাতায়াত কক্ষনও মেনে নিতেন না। সরব হয়ে উঠতেন। এবং তখন জাকিরজির চেহারা বদলে যেত।
আমাদের অনেককে মঞ্চে উঠতে হয় অনেক কিছু সয়ে। মেনে। সামনে অনেক কিছু চললেও আমাদের পারফর্ম করে যেতে হয়। জাকিরজি কিন্তু পারফরম্যান্সকে সবার উপরে রাখতেন। মনে আছে, সোয়াই গন্ধর্ভ ফেস্টিভ্যালে একবার উস্তাদ সুলতান খাঁ-র সঙ্গে জাকিরজি সংগত করছেন এবং সামনে হাজারও ফ্ল্যাশ থেকে থেকেই জ্বলে উঠছে। বাজনার ব্যাঘাত ঘটছে। একসময় ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। সুলতান খাঁ সাহেবকে থামিয়ে জাকিরজি সরস্বতীর শ্লোক আওড়ালেন সংস্কৃতে। পুরো শ্লোকটি শেষ করে বললেন, আপনারা যদি জেনে থাকেন মা সরস্বতী কে, তাহলে বুঝবেন আমরা তাঁর সাধনা করতে এখানে বসেছি। এই সাধনায় আর যদি ব্যাঘাত ঘটান, আমি আর সুলতান ভাই উঠে চলে যাব। এই হলেন জাকির হুসেন। যেমন সৌজন্য শিখতে হয়, তেমনই শিখতে হয় সংহতি।
আমরা কি পেরেছি পুরোটা তাঁর কাছ থেকে শিখে উঠতে? যে খ্যাতির শিখরে তিনি আসীন, সেখান থেকে সকলকেই প্রায় ক্ষুদ্র দেখার কথা। অথচ সে খ্যাতি দিয়ে জাকির হুসেনকে মাপা যায় না। মাপতে হয় আত্মীয়তা দিয়ে। মাপতে হয় অনাড়ম্বর এক অহমিকাহীন পোশাক দিয়ে। যা তাঁর আত্মায় মোড়া থাকত। সহশিল্পীদের কী পরিমাণ যে মর্যাদা দিতে জানতেন! তরুণ শিল্পী থেকে বয়স্ক শিল্পী। এই কারণেই জাকির হুসেন অনন্য। কেননা নিজেকে তিনি নুইয়ে রাখতে জানতেন। নিজেকে পরিবেশন করতেন তুলনামূলক ছোট করে। তখনই মানুষ অন্তর থেকে বিনয় প্রকাশ করে যখন সে তার কাজের ক্ষেত্রে নিষ্ঠ, পরিশ্রমী এবং আত্মবিশ্বাসী। জাকিরজি জানতেন, পাশের মানুষটির প্রশংসা করলে, মর্যাদা দিলে, তাঁর নিজের সম্মান আরও বেড়ে যাবে। যেমন সম্মান বেড়ে যাবে, হাজার হাজার শ্রোতার সম্মুখে নিজের ত্রুটিস্বীকারে। ভুলকে ভুল বলে মেনে নিলে।
এ ঘটনার সাক্ষী আমি। নজরুল মঞ্চ। চক্রধার বাজাচ্ছেন। সম-এর আধমাত্রা আগে এসে শেষ হল। আমরা কয়েকজন একটু উশখুশ করে উঠলাম, কারণ জাকিরজির কাছে আধমাত্রাও আধমাইলের সমান। এ হওয়ার কথা নয়। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বাজনা থামিয়ে বললেন, গতকাল বাজাচ্ছিলাম টোকিওতে, পরশু লন্ডনে। তাই আমার শরীরে এখন তিনটে শহরের সময় একসঙ্গে খেলা করছে। একটু যদি ভুলচুক হয়ে যায়, আমাকে মার্জনা করবেন। পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহের সামনে এই যে নতমস্তকে ভুল স্বীকারের সাহস, আসলে ওই ভুলটাকেই তিনি পালক সাজিয়ে তুলে রাখলেন মুকুটে।
এই কারিগরি, এই বিনয়, এই শিক্ষা আমাদের অল্পবিস্তরও কি ছুঁয়েছে? আজ যখন প্রতি মুহূর্তে একে অপরকে পিষে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার দৌড় দেখি শিল্পের যে-কোনও শাখায়, দেখি প্রকাশ্যে একে অপরকে ঈর্ষা, অসূয়া, এমনকী গালমন্দ করতে, তখন ভাবি, আমরা এত বছর ধরে জাকির হুসেনের মতো মানুষের কাছ থেকে কি শিখলাম না কিছুই?
ছোট একটা ঘটনা বলে শেষ করি। আমার একটিমাত্র ব্যক্তিগত স্মৃতি তাঁর সঙ্গে। বছর তিনেক আগের কথা। কলকাতার এক আসরে বাজাতে এসেছেন। আমি সৌভাগ্যক্রমে সামনের সারিতে বসে। সেই সাত বছর থেকে যে মানুষটি আমাকে জাদুতে মুগ্ধ করে রেখেছেন, কখনও সম্ভব হয়নি তাঁর পায়ের পাতা দুটো একবার স্পর্শ করব। সেখানে উপস্থিত ছিলেন অজয়কাকু, পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী। আমি তাঁকে বললাম, একবার কি জাকিরজিকে প্রণাম করার উপায় হয় না? তিনি খুব সহজভাবে বললেন, ‘এসো এসো, এখনই আলাপ করিয়ে দিচ্ছি।’ আলাপ করালেন। নেহাতই স্নেহবশত প্রশংসার বাক্য বললেন আমার সম্পর্কে। জাকিরজিকে প্রণাম করলাম প্রথম এবং শেষবার। প্রণাম করে উঠছি যখন, দেখলাম তিনি আমার পায়ের পাতা ছোঁয়ার জন্য নত হয়েছেন। ভাগ্যিস আমার সংবিৎ তখনও কিছুটা কাজ করছিল। আমি নিচু হয়ে তাঁর জগৎবিখ্যাত হাতের দু’টি পাতা আমার মুঠোয় ভরলাম। আমি বললাম, ‘আপনি এ কী করছিলেন?’ তিনি একটিমাত্র বাক্য বললেন, ‘প্রণামের বিনিময়ে তো প্রণামই করতে হয়।’ আজকে যখন চোখের বদলে চোখ উপড়ে নেওয়ার পৃথিবীতে বাস করছি আমরা, তখন প্রণামের বদলে প্রণামের সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দিয়ে বিদায় নিচ্ছেন উস্তাদ জাকির হুসেন।
এহেন সৌজন্যের একটি কণাও যদি নিজের মধ্যে বপন করতে পারি আমরা, পৃথিবীটা সুন্দর হবে। সামান্যই। তবু তো হবে। আমার প্রণাম উস্তাদজিকে।
………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………