কলকাতা মানেই শুধু হাওড়া ব্রিজ, এয়ারপোর্ট, নন্দন-রবীন্দ্রসদন, কফি হাউস নয়। জনপ্রিয় ধারণার যে কলকাতা, সেই কলকাতার বাইরে আজ রোববার.ইন ঢুঁ মারল রিপন স্ট্রিটে। ২৫ ডিসেম্বর সান্তা ক্লজ আসবেন তো বটেই, কিন্তু চার্লি চ্যাপলিনের মৃত্যুও হয় এই তারিখেই। এই কলকাতায়, রিপন স্ট্রিটের অচেনা গলিতে, ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে সেলিম জোকারওয়ালার বাড়ি থেকে বেরচ্ছেন সান্তা ক্লজ, চার্লি চ্যাপলিনও। তিনি তাই এই ক্রিসমাসে তাঁর জীবনকে খানিক জানা, বোঝা, পরখ করা।
রিপন স্ট্রিট। বাঁদিকে রাস্তা ধরলে বাঁহাতে ২০০ বছরের পুরনো কলিঙ্গা ব্যাপটিস্ট উপাসনালয়। ব্রেগানজার পুরনো বন্ধ দোকান। উল্টোদিকে রিপন নার্সিং হোম। ড্রাই ফ্রুটস, চায়ের দোকান, জুতোর সেলুন পেরিয়ে, সেন্ট অগাস্টিন স্কুলের গা দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে সরু গলি। বাঁহাতে পাইস হোটেল। ভাত-রুটি-মাংস (চিকেন-বিফ দু’রকমই)। মাংসের বড় পাত্রে মাঝে মাঝে গোল করে কাটা টমেটো ভেসে থাকে। এই রাস্তা ধরে ডানদিকে খানিক হাঁটলেই পড়ে বেডফোর্ড লেন। এখানেই থাকে সান্তা, থাকেন চার্লি চ্যাপলিন। একটা বাড়ি থেকেই তাঁরা বেরিয়ে পড়েন এই শহরে, মফসসলের নানা রাস্তায়। রুজি-রোজগারে। তাঁদের অবিকল নকলনবিশি নিয়ে। সেই সান্তার সঙ্গে, সেই চ্যাপলিন ও জোকারের সঙ্গে সামান্য আলাপ।
সেলিমদা, এই পেশায় আপনি কবে এলেন?
১৯৯২ সালের আগস্ট মাস সেটা। আমি ডেকরেশন করতাম অনেক দিন ধরেই। সেটাই আমার রুজি-রোজগার। কাজ করতাম গ্র্যান্ড হোটেলে। ওখানকার ব্যাঙ্কোয়েট ম্যানেজার একদিন আমাকে বললেন, একটা দোকানের ডেকরেশন করতে।
কীসের দোকান সেটা?
লিন্ডসে স্ট্রিটের একটা জামাকাপড়ের দোকান। আমি সেখানে গিয়ে সব দেখে-বুঝে সাজিয়ে দিলাম। নিজের খুব পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু মালিক বাগড়া দিলেন। বললেন, পুজো কাছাকাছি চলে এসেছে, শোরুম ভালোই সাজিয়েছেন, কিন্তু শুধু সাজালে তো চলবে না, এমন কিছু করুন, যাতে ভিড় লেগে যায়! খুবই মনখারাপ হল, এত চমৎকার সাজালাম, আর লোকটা কিনা বলছে, এতে হবে না!
রেগে গিয়েছিলেন নিশ্চয়ই?
খুবই। সেটাই তো স্বাভাবিক। সেই রাগ থেকেই বলেছিলাম, ‘একটা জোকার দাঁড় করিয়ে দিন না, তাহলেই ভিড় লেগে যাবে!’ কোথাও তিনি চটে যাবেন, তা নয়, বললেন, ‘তুমি জোগাড় করে দাও।’ বললাম, ‘জোকার আমি কোথায় পাব, সে তো সার্কাসে পাবেন। সার্কাসে গিয়ে খোঁজ করুন।’ উনি নাছোড়বান্দা, বললেন, ‘আপনি এনে দিন।’ বাড়ি এলাম বিমর্ষ হয়ে। ভাইপো আর ভাইকে নিয়ে বসলাম। বললাম, একটা চেষ্টা করে দেখি। দর্জি থেকে কাপড় তৈরি করে নেব। জোকারের মতো রং-টংও লাগাব। শোরুমে দাঁড়িয়ে মানুষকে হাসাব– হাসানো তো এমনিও পুণ্যের কাজ। দেখি কীরকম লাগে! ওরা রাজি হল।
আপনি তাহলে জোকার সাজলেন? শোরুমে দাঁড়ালেনও? কী হল তারপর?
বুঝতে পারলাম ‘ধামাকা’ হয়ে গিয়েছে! এক্কেবারে নতুন একটা জিনিস দেখতে পেল যেন পথচলতি লোকজন। প্রচণ্ড ভিড় হল। এতই ভিড় যে রোজই প্রেসের লোকেরা আসছেন, কথা বলছেন, ছবি তুলে নিয়ে যাচ্ছেন– কাগজে ছাপাও হচ্ছে সেসব।
’৯২ সালটা তাহলে আপনার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া বছর?
হ্যাঁ, ১৯৯২ সাল। পয়লা অগাস্ট। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আমার জীবনটা এবার অন্যরকম একটা কিছুর খোঁজ করছে।
শোরুমের বাইরের এই ব্যাপারটা কতদিন চলল?
একমাস। তারপর ওরা বলল, এবার নতুন কিছু করুন। মাথায় খেলতে লাগল কী করব! মনে এল চার্লি চ্যাপলিনের কথা। তাই-ই করলাম। কালো প্যান্ট, কালো কোট, সাদা টি-শার্ট আর লাঠি দিয়ে চার্লি চ্যাপলিন সাজলাম। গরমকাল, ভারী কোট, ভেতর ভেতর ঘামছি, কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু ঘোরের মতো, তখন তো আর আমি সেলিম নই– চার্লি চ্যাপলিন।
কিন্তু পোশাকে তো না হয় চার্লি হওয়া গেল, অভিনয়ের জন্য কীরকম প্রস্তুতি নিলেন?
তখন ক্যাসেটের যুগ। চাঁদনির এক ক্যাসেট পার্লার থেকে কিনে আনলাম ‘গোল্ডরাশ’ আর ‘মেরা নাম জোকার’ সিনেমা দুটো। রোজ দেখতাম সেই ছবি দুটো। রাজ কাপুর আর চার্লি চ্যাপলিন ঠিক কী কী করছেন, খুঁটিয়ে দেখতাম তখন। প্র্যাকটিস করতাম কখনও ওই বানানো পোশাক পরে, কখনও এমনিই।
এই সময়টায়, যখন অনেক কাগজে ছাপা হল আপনাদের কথা, আরও কোম্পানি থেকে অফার আসেনি কাজের?
এসেছে। অনেকে জানাতেন, তাঁদের স্টলের বাইরে লোক লাগবে। পেপসি কোম্পানি, ফ্রুটি কোম্পানি থেকেও। কখনও বিজ্ঞাপনের ছবির জন্যও বলেছে। আমি বুঝতে পারলাম, এটা একটা দারুণ ব্যবসা। কিন্তু শুধু একা পারব না। টিম লাগবে। তাই একটু একটু করে শুরু করলাম শেখানো। একটা টিম তৈরি করা। এখন আমাদের প্রায় ৫০ জনের টিম। সারা কলকাতায় আমার চ্যাপলিন, জোকার বা সান্তা যায় নানা কাজে। এখন যদিও প্রচুর কাজ করছি না। গুণগত মান বজায় রাখার জন্যই। কিন্তু কলকাতায় যেহেতু ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টে নাম হয়ে গিয়েছে, তাই সে দিকের কাজ বেড়েছে। এই ক্রিসমাস এলেই যেমন হাজার হাজার সান্তা বেরয় রিপন স্ট্রিটের গলি থেকে। বেরয় চ্যাপলিন, আর জোকারও।
এই প্রশ্নেই আসতাম, সান্তা ক্লজের দিকে আপনি ঝুঁকলেন কবে? চার্লি আর জোকার তো জানলাম।
সেই ’৯২ সালেই। ’৯২ সালের ডিসেম্বরে, শীত জাঁকিয়ে পড়েছে, আর মনে হল, কেন সান্তা সেজে বাচ্চাদেরকে গিফট দিচ্ছি না! যেমন ভাবা, তেমন কাজ। চার্লি, জোকার তো রইলই, সান্তা যোগ দিল তাদের সঙ্গে। কলকাতার রাস্তায় বাচ্চাদের হুড়োহুড়ি পড়ে গেল সান্তার থেকে গিফট নেওয়ার জন্য। তখনও আরেক ঝাঁক অর্ডার এল– রেস্তরাঁ বলুন, বার বলুন, ছোটদের জন্মদিনের পার্টি বলুন– সান্তা সেই থেকে আমার সঙ্গে জুড়ে আছে।
আপনি সান্তা, চ্যাপলিন আর জোকার– তিনটেই নিজের মতো করে তৈরি করেছেন। সারা বছরে কার সবথেকে বেশি ডিমান্ড?
সান্তা শুধু ডিসেম্বরে। বাকি সময়টায় চ্যাপলিন আর জোকার। তবে, আরও নানা ক্যারেক্টার এনেছি। আইরন ম্যান, দ্বারপাল, মিকি মাউস।
এই চরিত্র করতে গিয়ে আপনার সবথেকে আনন্দের স্মৃতি কী?
ওবেরয় গ্র্যান্ড থেকে আমাকে বলা হল, প্রতি ররিবার করে একজন করে চ্যাপলিন পাঠান। চিফ গেস্টদের ঘরে ওরা বেল বাজাবে, একটা করে ফুলের তোড়া দেবে আর হাসাবে। নানা পাটেকরকে খুব হাসিয়েছিলাম। গোবিন্দাকেও। তবে গোবিন্দা উল্টে আমাদেরকেও হাসিয়েছিলেন। দারুণ অভিনেতা তো, উনিও জোকার, চ্যাপলিনের অভিনয় করে দেখালেন আমাদের। সেসবও অনবদ্য! ‘চ্যাপলিন’ নামের যে বাংলা সিনেমা, সেখানেও অভিনয় করেছি রুদ্রনীলের সঙ্গে। রুদ্রনীলকে বলেছিলাম, ‘আমি অরিজিনাল চার্লি চ্যাপলিনের কপি, আপনাকে আমার থেকে শিখতে হবে।’ শাম্মি কাপুর বলেছিলেন, ‘প্রথমে চার্লি চ্যাপলিন, তারপরেই সেলিম জোকারওয়ালা।’
কখনও সমস্যায় পড়তে হয়নি এইসব চরিত্র করতে গিয়ে? রাস্তায় কিংবা অন্য জায়গায়?
একবার গ্র্যান্ড হোটেলে বেল দিলাম। ভেতরে অমিতাভ বচ্চন-জয়া বচ্চন ছিলেন। রেগে গিয়েছিলেন খুবই। অর্জুন ওবেরয়কে ফোন করে বলেছিলেন, ডিলাক্স ফাইভ স্টার হোটেলে এসব কী! তারপর এই ব্যাপারটা থেমে যায়। কেউ খুব ভালোবাসে, কেউ বিরক্ত হয়। আমাদের কাজ এইরকমই।
…………….
এ সাক্ষাৎকার যখন নিচ্ছি, তখন অদূরেই ক্রিসমাস। বাইরে ভিড় লেগে আছে সত্যিই। নানা সংবাদমাধ্যমের। মনে পড়ে যাচ্ছে, ১৯৯২ ডিসেম্বর যখন এ দেশে মুছে ফেলা হচ্ছে বাবরি মসজিদের স্মৃতি, তখন খাস ধর্মতলায় এক সেলিম, সান্তা সেজে বিতরণ করছেন ভালোবাসার দু’চার মুহূর্ত। আপনাদের এ-ও বলার কথা, মাত্র কিছুক্ষণ আগে, সেলিমদার বাড়ির দোরগোড়ায় একটি খাঁচায় টিয়া সার্কাস দেখাচ্ছিল উল্টে। খাঁচার গায়ে এঁটে ছিল পাউরুটি। এত ভিড়ে, কথা বলার মধ্যে, যাতে তার ডাক এসে না পড়ে, সরিয়ে ফেলা হল তাকে। এই ক্রিসমাসের ভিড়ে যেভাবে তাঁর আস্তানা থেকে হারিয়ে যান চ্যাপলিন। ও হ্যাঁ, বলতে ভুলেই গিয়েছি, আজ চ্যাপলিনের মৃত্যুদিন।