দু’জনের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও শ্রদ্ধা দেখার মতো ছিল। বাড়ির রান্নাবান্নার দায়িত্ব সবসময়ে শান্তির ওপর থাকলেও, সংসারের বাকি কাজ তাঁরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিলেন। বাজার করা ছাড়াও, চা-টোস্ট করা, ফল কাটা, টেবিল সাজানো, খাওয়াদাওয়ার পর টেবিল ও রান্নার জায়গা পরিষ্কার করা, বিছানা করা, মশারি টাঙানো– এসব কিছুই করতেন অরুণ। আজ থেকে ৬০-৭০ বছর আগে এরকম কাজের ভাগ তাঁদের মধ্যবিত্ত বাড়িতে চালু ছিল, ভাবা যায়! তাও আবার বুদ্ধিজীবী ও বিখ্যাত কবির বাড়ি বলে কথা!
১০.
১৯৭৯ সাল। ‘শুধু রাতের শব্দ নয়’ কাব্যগ্রন্থের জন্য ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ পেলেন কবি অরুণ মিত্র। কবি মনে করতেন সাহিত্যক্ষেত্রে এসব পুরস্কার প্রায় অর্থহীন, কারণ টলস্টয়কে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়নি, যদিও সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ প্রবর্তনের পর বছর দশেক টলস্টয় জীবিত ছিলেন। যাই হোক, ১৯৭৯-এ রবীন্দ্র পুরস্কারের অর্থমূল্য ছিল ১০,০০০ টাকা এবং টানাটানির সংসারে সেই টাকাটা তাঁর খুব কাজে লাগবে ভেবে খুশি হয়েছিলেন অরুণ। জীবনসঙ্গী শান্তিকে কিছু উপহার দিতে চেয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাঁকে কী দিলে ভালো হয়। কী চাইবেন ভেবে না পেয়ে, শেষমেশ কবিপত্নী ও লেখিকা শান্তি মিত্র-র উত্তর ছিল, ‘একটা টাটা নেটের মশারি আনলে ভালো হয়’!
অরুণ-শান্তিকে নিয়ে লিখব কখনও ভাবিনি। তাঁদের একমাত্র নাতনি উর্বীর সহপাঠী ও বন্ধু হওয়ার সুবাদে ছাত্রাবস্থায় তার দাদা-দিদাকে অনেক দেখেছি, তাঁদের স্নিগ্ধোজ্জ্বল উপস্থিতি শ্রদ্ধা জাগিয়েছে। কিন্তু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই দিনগুলোতে তাঁদের সেভাবে জানার কোনও চেষ্টা করিনি। হেলায় হারিয়েছি সঙ্গসুধালাভের সুযোগ।
তখন জানতামই না যে, শান্তি ছিলেন অরুণের সব লেখার প্রথম পাঠক। নিজেও লিখতেন, ছোটগল্প ও কবিতা। দেশভাগ নিয়ে ১৯৫১-তে তৈরি প্রথম ছবি, নিমাই ঘোষের ‘ছিন্নমূল’-এ শান্তি অভিনয় করেছিলেন ঋত্বিক ঘটকের বিপরীতে। আরও দু’-একটা ছবিতে কাজ করেন তিনি। ভালো গানের গলা ছিল। লেখালিখি এবং অভিনয়ে মন ও সময় দিতে পারলে হয়তো বাঙালি পাঠক/দর্শক তাঁকে চিনত। কিন্তু ছোটবেলায় চূড়ান্ত বঞ্চনা-অনাদর ও পরে নানা সাংসারিক দায়িত্বের চাপে সে অবসর তাঁর হয়নি।
তাঁর একমাত্র প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ সবুজ চুড়ি-র (প্রকাশক ‘নান্দীমুখ’) কথা জানতে পারি, যখন আমি দুই বাংলার লেখিকাদের একটা গল্প সংকলন (দ্য স্ট্রিম উইদিন, প্রকাশক ‘স্ত্রী’) সহ-সম্পাদনা ও অনুবাদের কাজ করছি বন্ধু স্বাতীর সঙ্গে। সেটা ১৯৯৮ সাল। সে বছরেই চলে যান শান্তি। তার দু’বছরের মধ্যে অরুণ।
শান্তি-অরুণের প্রয়াণের অনেক বছর পর মেয়ে ও নাতনির মুখে তাঁদের কথা শুনতে শুনতে, লেখা পড়তে পড়তে একটু যেন কাছে এসেছেন দু’জন। তাঁদের জীবনের অনেকগুলো গল্পই বুকের মধ্যে ধাক্কা দিয়ে গিয়েছে। আবার কোনওটা শুনে প্রাণ খুলে হেসেওছি। যেমন, বাড়ির বাজার করে আনা কর্তার সঙ্গে গিন্নির কথোপকথন। একদিন অরুণ কাঁচা বাজার করে আসার পর বেগুনগুলো হাতে নিয়ে শান্তি নাকি বলেছিলেন, ‘তোমাকে এত করে বলি হাল্কা বেগুন এনো, ভারিগুলো ভালো হয় না।’ অরুণের সুরসিক জবাব ছিল, ‘কী করব বলো, যখন বাজার করি তখন যেন আমার ওপর গামা পালোয়ান ভর করে, যাই তুলি তা-ই খুব হাল্কা মনে হয়!’
এই বেগুন কেনার গল্পটা ওঁদের দাম্পত্যজীবনের মধ্যভাগের, যখন প্যারির স্যবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট উপাধি পেয়ে দেশে ফিরে ১৯৫২ সালে অরুণ মিত্র এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপনার কাজ নিয়ে সেখানেই থিতু হন স্ত্রী, ছেলে রণধীর ও মেয়ে উমাকে নিয়ে। তবে যশোরের অরুণের সঙ্গে পাবনার শান্তির আলাপ হয়েছিল কলকাতায় এর বছর ২০ আগে, ১৯৩০-এর গোড়ার দিকে।
অরুণ তখন রিপন কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে পারিবারিক পরিস্থিতির চাপে স্নাতকোত্তর পাঠ মাঝপথে থামিয়ে ১৯৩১-এ চাকরি নিয়েছেন আনন্দবাজার পত্রিকায়। সেখানেই আলাপ লেখক-সাংবাদিক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদারের সঙ্গে, কয়েক বছরের মধ্যে যিনি হয়ে ওঠেন অরুণের পিতা ও পথপ্রদর্শক। ততদিনে, অর্থাৎ ১৯৩০-এর শেষের দিকে সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদারের ভাগনি শান্তি ভাদুড়িকে ভালোবেসে বিয়ে করার অপরাধে অরুণ মিত্রের জন্মদাতা ত্যাগ করেন তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রকে। পাত্রী এক ব্রাহ্মণ কন্যা বলেই কি সন্তানের ওপর এতটা বিরূপ ছিলেন কায়স্থ পিতা? সেটা একটা বড় কারণ ছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু একমাত্র কারণ বোধহয় নয়।
সম্ভবত শান্তিকে ভদ্রলোকের বাড়ির বউ করার মতো ‘নিষ্কলঙ্ক’ মনে হয়নি তাঁর কারণ, ছেলের বউয়ের বড় হওয়ার ধরনটা ‘সম্মানজনক’ ছিল না। একজন সৎ উকিলের নয় মেয়ের মধ্যে সবার বড় ছিলেন শান্তি। বাড়িতে খাবার জুটত না বলে আট-দশ বছর বয়স থেকে দিদিমা ও মামাদের আশ্রিতা হয়ে এ বাড়ি-সে বাড়ি ঘুরে বড় হয়েছেন শান্তি। অনেক লাঞ্ছনা-গঞ্জনার মধ্যে প্রায় উচ্ছিষ্ট খেয়ে বড় হওয়া। স্নেহ পেয়েছিলেন একমাত্র মেজমামিমার কাছে। অকৃতদার বড়মামা সত্যেন মজুমদার ছুটিতে দেশে গিয়ে কিশোরী বড় ভাগনির অবস্থা দেখে একবার কলকাতায় নিয়ে এসে ওঁর কোনও বন্ধুর বাড়িতে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। সেখানে কোনও অসুবিধা হওয়ায় ভর্তি করে দিলেন একটি স্কুলের বোর্ডিং-এ। ওই সময় হয়তো কোনও স্বদেশি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়েছিলেন শান্তি, সম্ভবত বিপ্লবী-বামপন্থী সুহাসিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের যোগসূত্রে। তবে এই ব্যাপারে ধূসরতা রয়েছে, আর কিছু জানা যায় না।
কিছুদিন পর বোর্ডিং থেকে বড়মামা নিয়ে এলেন কালীঘাটের কাছে নিজের ভাড়া বাড়িতে, যে বাড়িতে অষ্টপ্রহর বহু বিশিষ্ট মানুষের আনাগোনা ছিল। প্রগতি সাহিত্য আন্দোলন ও ফ্যাসিবিরোধী লেখক-শিল্পী সংঘের দিক্পালরা আসা-যাওয়া করতেন। আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাসে সেসব আড্ডার কথা লেখা আছে। কিন্তু যে অন্দরের ইতিহাসগুলো লেখা থাকে না, তারই একটা টুকরো এখানে রাখছি।
নানা ঘাটের জল খাওয়া এবং তারপর গৃহিণী-বিহীন একটা বাড়িতে এত পুরুষমানুষের আনাগোনার মধ্যে কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা রাখা কোনও মেয়ের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা আজও দস্তুর, সেই ১৯৩৭-’৩৮-এর কথা তো ছেড়েই দিলাম। ছেলের মুখদর্শন বন্ধ করার আগে অরুণের বাবা একবার সত্যেন মজুমদারের সদানন্দ রোডের সেই বাড়িতে এসে আপাদমস্তক চাবকে গিয়েছিলেন তাঁর সদ্য-বিবাহিত সাবালক ছেলেকে! সে ঘটনা শান্তির মুখে শুনেছেন তাঁদের মেয়ে উমা। সেদিন নিঃশব্দে মার খেয়েছিলেন অরুণ। যশোরের বাড়ি যাওয়া বন্ধ হয়েছিল তাঁর। কিন্তু অরুণ-শান্তি জেনেছিলেন, ‘কিছু নাই ভয়, জানি নিশ্চয় তুমি আছ আমি আছি।’ অরুণের মা যখন মৃত্যুশয্যায় সম্ভবত তখন যশোর যেতে পেরেছিলেন তাঁরা।
সত্যেন মজুমদারের সঙ্গে তাঁর ছেলে ও ছেলের বউ হিসেবে থেকেছেন দু’জনে অনেক বছর, ভাগনি-ভাগনি জামাই হয়ে নয় কিন্তু। শান্তির দু’-তিনজন ছোট বোনকেও নিজেদের কাছে নিয়ে এসে দায়িত্ব নেন এই দম্পতি, যাঁদের মধ্যে ছিলেন পঞ্চম বোন তৃপ্তি, যাঁকে আমরা একডাকে ‘তৃপ্তি মিত্র’ নামে চিনি। বছর দশেক বাদে অরুণ যখন ডক্টরেট করতে প্যারি গেলেন ১৯৪৮ সালে, তখনও দুই ছেলেমেয়ে ও বাকিদের নিয়ে শান্তি তাঁর শ্রম দিয়ে ওই বাড়ি আগলেছিলেন।
দু’জনের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও শ্রদ্ধা দেখার মতো ছিল। দু’জনেই খুব সংগীত-প্রিয় মানুষ। এলাহাবাদের সংসারে শান্তি অর্গান বাজিয়ে গান গাইতেন, কোথাও শেখেননি কিন্তু। অনাড়ম্বর জীবনে যখন টাকার ব্যবস্থা করতে পেরেছেন, স্ত্রীকে অর্গান কিনে দিয়েছেন অরুণ। বাড়ির রান্নাবান্নার দায়িত্ব সবসময়ে শান্তির ওপর থাকলেও, সংসারের বাকি কাজ তাঁরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিলেন। বাজার করা ছাড়াও, চা-টোস্ট করা, ফল কাটা, টেবিল সাজানো, খাওয়াদাওয়ার পর টেবিল ও রান্নার জায়গা পরিষ্কার করা, বিছানা করা, মশারি টাঙানো– এসব কিছুই করতেন অরুণ। আজ থেকে ৬০-৭০ বছর আগে এরকম কাজের ভাগ তাঁদের মধ্যবিত্ত বাড়িতে চালু ছিল, ভাবা যায়! তাও আবার বুদ্ধিজীবী ও বিখ্যাত কবির বাড়ি বলে কথা!
শুনেছি এই সাংসারিক কাজগুলো অসম্ভব নিখুঁত করে করতেন অরুণ। মশারি টাঙানোর সময় নাকি খাটের চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখতেন চারিদিক সমান টানটান হয়েছে কি না! ফল কাটার বেলাতেও প্রতিটা টুকরো সমানভাবে কাটা নিয়ে খুবই খুঁতখুঁতে ছিলেন, যাতে সবাইকে সমান ভাগ দেওয়া যায়। এই করতে গিয়ে এত দেরি হত, যে কখনও কখনও ধৈর্য হারাতেন শান্তি।
শেষ জীবনে যখন খুবই অসুস্থ শান্তি, তাঁর মাথার মধ্যে জট পাকিয়ে গিয়েছে অনেক কিছু, সে সময়ে তাঁরা গড়িয়াহাটের কাছে মেয়ের বাড়িতে। তখন মানুষজনকে চিনতে পারা ও কথা বলা বন্ধ হয়ে গিয়েছে শান্তির। চিরকাল যাঁকে প্রথম পড়ে শুনিয়েছেন নিজের সব লেখা, তাঁর খাটের পাশে বসে বৃদ্ধ অরুণ প্রতিদিন শান্তিকে পড়ে শোনাতেন খবরের কাগজ। মাঝেমাঝে কোনও খবর শুনে শিশুর মতো হাততালি দিয়ে উঠতেন তাঁর বহুকালের দোসর। তা দেখে পরম তৃপ্তি পেতেন অরুণ। এই দৃশ্যের মধ্যেই যেন ধরা থেকে যায় তাঁদের সখ্যের গভীরতা, যেখানে শব্দ অচেনা ঠেকলেও, সুর চিনতে ভুল হয় না।
কৃতজ্ঞতা ও ছবি সৌজন্য রণধীর মিত্র, উমা বসু
…পড়ুন দোসর-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৯। আন্ডারগ্রাউন্ডেই বেশি সময় কেটেছে, তবুও মাহমুদ-রশীদা সংসারে ছিল অজানা সাধনার বকুলগন্ধ
পর্ব ৮। হিন্দু কোড বিল-এর বিভিন্ন ধারা নিয়ে খাবার টেবিলে বসে আলোচনা চলেছে সবিতা ও ভীমরাওয়ের
পর্ব ৭। সেই আলোভরা দিনের খোঁজে তিন কমরেড
পর্ব ৬। যে তিন ‘অনাত্মীয়’ মেয়ে সংসার পেতেছিলেন দিগন্ত-রেখায়
পর্ব ৫। উমাদি-চিনুদা-নিরঞ্জনবাবুর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল গভীর মনের মিল ও মতাদর্শ ঘিরে
পর্ব ৪। যাঁদের ‘ইমেজ’ ধরে রাখার ব্যাপার নেই, পার্টনার-ইন-ক্রাইম হয়ে ওঠার মজা আছে
পর্ব ৩। বাণী-শ্যামলীর প্লাস্টার অফ প্যারিসে ঢালাই হওয়া বন্ধুত্ব
পর্ব ২। অমলেন্দুকে বিয়ে করেও সিঁদুর পরেননি কেন— ইন্টারভিউতে শুনতে হয়েছিল নাসিমাকে
পর্ব ১। ‘গীতাঞ্জলি’ আসলে বাংলা অনুবাদে বাইবেল, এই বলে জাপানিদের ধোঁকা দেন সুহাসিনী