বাণীদির শান্তিনিকেতনে থাকতে আসা ৫৯ বছর বয়সে এবং সে সময়ে বছর ৪৫-৪৬-এর শ্যামলীদির সঙ্গে তাঁর প্রথম আলাপ। শেষ জীবনে প্রায় ৩০ বছর শান্তিনিকেতনে কাটানো এবং শ্যামলীদির সঙ্গে প্লাসটার অফ প্যারিসে ঢালাই হওয়া বন্ধুত্ব। দু’জনের বেড়ে ওঠা ও শেষ বয়সেও জীবনচর্যা দৃশ্যত খুবই আলাদা ছিল। কিন্তু দু’জনকে কাছাকাছি এনেছিল বোধহয় এক অন্যরকম জীবনবোধ।
৩.
ব্যতিক্রমী শিল্পী, যুদ্ধবিরোধী ও পরিবেশ আন্দোলনের নির্ভীক কর্মী, এবং বহুজনকে আপন করে নেওয়া এক বিরাট মনের মানুষ শ্যামলী খাস্তগীর, ২০১১-র অগাস্টে চলে যাওয়ার পর ‘শ্যামলী’ নামে একটি স্মরণ-গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল সে বছর ডিসেম্বরে। তাতে প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে আলাপ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে শান্তিনিকেতনে ১৯৮৬ নাগাদ নতুন আসা বাণী সিংহ বলেছেন:
‘প্রথম দেখা পোস্ট অফিসের সামনে। আমি হাঁদার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি– পোস্ট অফিস খুঁজছি। শ্যামলী আমাকে ভেবেছে ফরেনার। ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, কিছু খুঁজছ? বললাম। ও বলল, You are standing right in front of it. বোঝো অবস্থা! তারপর বলেই ফেললাম, আপনি বাঙালি তো? আমিও। এই যে আলাপ, তারপর প্লাস্টার অফ প্যারিসের মতো জোড়া লেগে গেল। যদিও ঝগড়া হত খুব, কত যে বকুনি খেয়েছি!’ (মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায় অনুলিখিত, ‘মন্থন সাময়িকী’ প্রকাশিত গ্রন্থ শ্যামলী)
বাণী ধবধবে ফরসা, সাদা সিল্কের মতো নরম বব কাট চুল। শ্যামলীর তাঁকে শাড়ি পরা ‘বিদেশিনী’ ভাবা কিছুই আশ্চর্যের নয়। আর তাঁদের অনুপম বন্ধুত্বের কথা বলতে গিয়ে এই যে প্লাস্টার অফ প্যারিসের রেফারেন্স টানা– এটা কেবল বাণীর পক্ষেই সম্ভব!
বাণীদির মতো সুরসিক মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। তাঁকে আমি প্রথম দেখি আমার সহপাঠী ও বন্ধু স্বাতীর প্রতিবেশী রূপে। স্বাতী তখন অল্পদিন দিন হল বিশ্বভারতীর ইংরেজি বিভাগে পড়াতে শুরু করেছে। ১৯৯৪ সাল। যে গাছ-গাছালি ঘেরা একতলা পুরনো বাড়ির দুটো ঘর ভাড়া নিয়ে স্বাতী থাকত তখন, তার অন্যদিকের একটা অংশের ভাড়াটে ছিলেন বাণীদি। সঙ্গে তাঁর কয়েকটি চারপেয়ে পোষ্য, যাদের মধ্যে ‘লাকি’ নামের একজনকে পূর্বপল্লি-রতনপল্লি অঞ্চলে প্রায় সবাই চিনত। তাঁর গল্পের ঝুলিতে সবসময় ভীষণ মজার সব ঘটনা থাকত। সে গল্পগুলো শোনার আনন্দ-অনুভূতি এখনও অমলিন, যদিও বেশিরভাগ গল্প ভুলে যাওয়ার জন্য নিজেকে ধিক্কার জানাচ্ছি।
স্বাতীর পরামর্শে এবং আরেক বন্ধু অহনার সৌজন্যে শান্তিনিকেতনের আরেক ব্যতিক্রমী মানুষ, লামীদি বা ঊর্মিলা গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা ‘লামীদির গল্প’ নামের বইটি কিছুদিন আগে পড়ে মন আলো হয়ে গেল। তাতে চমৎকার সব গল্পের মধ্যে লামীদির কুকুরতুতো-বেড়ালতুতো-পাখিতুতো বোন বাণীদিরও কিছু গল্প আছে।
ক’দিন আগে বাণীদির পিঠোপিঠি বোন রাধারাণী/কোয়েলিদির কাছে শোনা একটা গল্প বলার লোভ সামলাতে পারছি না। গল্পটা বাণীদির বিয়ের দিনের। ১৮-১৯ বছর হতে না হতেই ওঁর বিয়ে হয় লর্ড সিন্হা পরিবারের এক সদস্য– ডাক্তার কমল সিন্হার সঙ্গে। বিয়ের মন্ত্র খুব মন দিয়ে বলার গুরুত্ব যখন বোঝাচ্ছিলেন তাঁর কোনও মামা অথবা মেসো, বাণীদি নাকি বলেছিলেন, আর কিছু বলি না বলি ‘সিংহ’ হচ্ছি যখন সিংহের ডাক একবার ডাকবই। তারপর বিয়ের মূল পর্ব শেষ হলে তিনি নাকি সত্যি বিয়ের পিড়িতে বসে সিংহের মতো একবার গর্জন করার চেষ্টা করেন!
বাণীদি শান্তিনিকেতনে বড় হননি শ্যামলীদির মতো, শিল্পী-কন্যা ছিলেন না, কম বয়স থেকে বিশ্বশান্তি-প্রকৃতি-পরিবেশ নিয়ে নানা আন্দোলনে অংশীদার হওয়ার কোনও অভিজ্ঞতাও তাঁর ছিল না। তাঁর পারিবারিক প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। সন্তোষ রাজপরিবারে জন্মেছিলেন বাণীদি ১৯২৭ সালে, পড়েছেন কলকাতার এলিট স্কুলে, দিদিমা-দাদামশাইয়ের শিলং-এর ‘ব্রুকসাইড’ বাড়িতে কেটেছে তাঁর অনেক ছুটি– যে বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন কিছুদিন, ‘শেষের কবিতা’য় যে বাড়ির ছায়া পড়েছে।
তারপর বিবাহিত জীবনের প্রায় ৪০ বছর বাণীদির কেটেছে পাহাড় ও জঙ্গলের কোলে, হাসিমারা অঞ্চলে এবং ভুটানে। স্বামী চা বাগানের ডাক্তার ছিলেন। তাঁর সঙ্গে বনপথে হেঁটে আকাশ দেখা, পাখি চেনা তখন থেকেই। স্বামীর মৃত্যুর পর বাণীদি কলকাতায় নিজের বাড়ি ছেড়ে শান্তিনিকেতনে ভাড়াবাড়িতে যখন থাকতে শুরু করলেন, তখন রোজ বিশ্বভারতীর সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে বসে বই পড়তেন কয়েক ঘণ্টা। বেশিরভাগ বই মহাকাশ ও জীবজগৎকে জানতে চেয়ে। মনে আছে একবার দুপুরবেলা ট্রেনে কলকাতা আসছি। বাণীদি আমার পাশের সিটে। আল বেরুনির লেখা জ্যোতির্বিদ্যার ওপর তাঁর সদ্য-পড়া বইটার কথা গভীর আনন্দের সঙ্গে বলতে বলতে এলেন অনেকটা পথ। সেদিন বাণীদির এক প্রিয় পাত্র, আমার বন্ধু সজল মনে করিয়ে দিল বাণীদির সংগ্রহে থাকা একটা মজার বইয়ের কথা– Yoga for Cats!
বাণীদির শান্তিনিকেতনে থাকতে আসা ৫৯ বছর বয়সে এবং সে সময়ে বছর ৪৫-৪৬-এর শ্যামলীদির সঙ্গে তাঁর প্রথম আলাপ। শেষ জীবনে প্রায় ৩০ বছর শান্তিনিকেতনে কাটানো এবং শ্যামলীদির সঙ্গে প্লাস্টার অফ প্যারিসে ঢালাই হওয়া বন্ধুত্ব। দু’জনের বেড়ে ওঠা ও শেষ বয়সেও জীবনচর্যা দৃশ্যত খুবই আলাদা ছিল। কিন্তু দু’জনকে কাছাকাছি এনেছিল বোধহয় এক অন্যরকম জীবনবোধ।
দু’জনে আঠার মতো লেগে থাকত সেইসব কাজে, যা প্রকৃতি-পরিবেশকে মানুষের আগ্রাসন থেকে বাঁচানো ও বিভেদকামী উন্নয়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য করে যাওয়া একান্ত প্রয়োজন। বিপন্ন মানুষের পাশে থাকতে তাঁরা একসঙ্গে ছুটে গেছেন ভাগলপুরে দাঙ্গার পরে যেমন, তেমনই মহারাষ্ট্র-গুজরাতে জীবন-জীবিকা ধ্বংস হতে-বসা নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনকারীদের প্রতি সংহতি জানাতে। একবার তো গোয়ায় ‘এনরন’ কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে শ্যামলীদির সঙ্গে সে সময়ে সত্তরোর্ধ্ব বাণীদিও গ্রেপ্তার হয়ে যান।
এছাড়া ঘরের পাশে শান্তিনিকেতন অঞ্চলে কত যে চেষ্টা করেছেন দু’জনে প্রকৃতি ও মানুষকে সঙ্গে নিয়ে চলার, তার উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। বসন্তোৎসবের আগে পলাশ নিধন যজ্ঞ থামানো, শাসক দলের সাংসদকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে প্রোমোটারদের রুখতে ‘খোয়াই বাঁচাও’ আন্দোলন অথবা লাহাবাঁধ নামের ঝিল যাতে অ্যামিউসমেন্ট পার্কে পরিণত না হয় তার জন্য জমায়েত– সবেতেই শ্যামলীদি ও বাণীদি একসঙ্গে সামনের সারিতে থেকেছেন স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়ে।
তাঁদের সঙ্গে থাকত একঝাঁক তরুণ-তরুণী, যাদের নিয়ে দিনের পর দিন মিটিং হত কখনও শ্যামলীদি, কখনও বাণীদির বাড়িতে। মনীষা-সজল-অহনা এবং আরও কয়েকজন ছিল এই দলে। শুধু মিটিং নয় অবশ্য, ছোটদের অনেক হুজুগকে প্রশ্রয় দেওয়াও ছিল শ্যামলীদি ও বাণীদির। এছাড়া লোকশিল্পীদের নিয়ে নানা চর্চা, ডানাভাঙা পাখি বা অসুস্থ মানুষ ও জীবজন্তুকে সারিয়ে তোলা– এসবের মধ্যে দিয়ে এঁরা পরের প্রজন্মের কয়েকজনের মধ্যে চারিয়ে দিয়ে গিয়েছেন এক গভীর সহমর্মিতার বোধ। অথচ দু’জনের কেউই প্রচলিত অর্থে শিক্ষক ছিলেন না। আজ যখন স্বাতী রাস্তায় আক্রান্ত কুকুরছানা অর্জুনকে বিশেষ যত্নে তার বাড়িতে শুশ্রূষা করে নিজের বন্ধু করে তোলে, পথ কুকুরদের দেখভালের দায়িত্ব নেয়, আমার বাণীদির কথা মনে হয়। অহনাদের বাড়িতে কতরকম দেশজ পদ্ধতিতে চাষবাস ও শিল্পসামগ্রী তৈরির চেষ্টা হয়। মনীষা প্রতি বছর রতনপল্লী বাজারের কাছে ‘হিরোসিমা দিবস’ উদযাপনের উদ্যোগ নেয় অনেককে সঙ্গে নিয়ে– দেখে মনে পড়ে শ্যামলীদির কথা।
শ্যামলীদির ছেলে আনন্দ তাঁর মায়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে একটা ঘটনার কথা লিখেছেন। সাতের দশকে ওয়াশিংটনে যুদ্ধবিরোধী সমাবেশ হচ্ছে। দশ-বারো বছরের ছেলে তার মায়ের সঙ্গে গেছে সেখানে। কে কোথায় যাবে, কে কখন কারাবরণ করবে– এসব নিয়ে কথা হচ্ছে। অনেকেই ছিলেন সেদিন। আনন্দ-র বয়ানে, ‘কথা উঠল কাউকে গ্রেপ্তার হতে হবে। মা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি অ্যারেস্ট হব। সঙ্গে সঙ্গে আরো দুজন মহিলা এগিয়ে এলেন। ওঁরা তিনজন গিয়ে দাঁড়ালেন, গ্রেপ্তার হলেন।’ (‘মন্থন সাময়িকী’ প্রকাশিত গ্রন্থ শ্যামলী )। কোনও কিছুতে ভয় ছিল না শ্যামলীর।
ছোটবেলা থেকে তাঁর দিদির স্বদেশিয়ানা ও সাহসের কথা সেদিন শুনলাম বাণীদির বোনের মুখে। ১৯৪৩-এর মন্বন্তরের সময়ে দুর্ভিক্ষ-পীড়িত মানুষের জন্য রাস্তায় নেমে যতটুকু সম্ভব করতে চেষ্টা করেছিলেন তখনকার স্কুলছাত্রীটি। কৈশোরে লম্বা চুল ছিল বাণীদির। তিনি নাকি শার্ট-প্যান্ট পরে, চুলটা কায়দা করে লুকিয়ে, চুপিচুপি চলে যেতেন কলকাতায় সুভাষ বোসের বক্তৃতা ও অন্যান্য স্বদেশি নেতাদের মিটিং শুনতে। মনে হচ্ছে এটা ১৯৩৯-’৪০ সালের কথা। যে কোনও মুহূর্তে ধরা পড়ে যেতে পারতেন কিন্তু সেসবের তোয়াক্কা করতেন না ১৩-১৪ বছরের মেয়েটি। এখানেও বোধহয় ছিল শ্যামলীদির সঙ্গে তাঁর একাত্মতা।
কৃতজ্ঞতা: রাধারাণী (কোয়েলী) রায়, ঈশান্তি চৌরাসিয়া, অনুরাধা মুখার্জি, সাহানা নাগচৌধুরি, মণীষা বন্দ্যোপাধ্যায়
…পড়ুন দোসর-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২। অমলেন্দুকে বিয়ে করেও সিঁদুর পরেননি কেন— ইন্টারভিউতে শুনতে হয়েছিল নাসিমাকে
পর্ব ১। ‘গীতাঞ্জলি’ আসলে বাংলা অনুবাদে বাইবেল, এই বলে জাপানিদের ধোঁকা দেন সুহাসিনী
যে উন্মত্ত জনতার ঢেউ রবীন্দ্রনাথকে প্রয়াণের পর ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, সেই ঢেউ হয়ে ওঠা জনতার অন্তর্গত মানুষগুলি কি জানতেন, তাঁদের এই মানুষটির প্রতি বিশ্বের মানুষের গভীর শ্রদ্ধার কথা! কয়েক মাস পড়ে, এই সংখ্যাটি কি হাতে নিয়ে দেখেছিলেন ভিড়ের মানুষেরা?