শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে পরিচয়ের বহু আগে থেকেই– থার্ড ক্লাসের ছাত্র যখন, তখন থেকেই ডায়েরি লেখার অভ্যেস মহেন্দ্রনাথের। শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে আসার পর মাস্টারমশাইয়ের ডায়েরি লেখার অভ্যেসই ‘কথামৃত’-র আকর। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের বক্তব্যের ধারাবিবরণী লেখেননি তিনি। সামনে বসে নোটও নেননি। বাড়ি এসে নিজস্ব সাংকেতিক বাক্যে লিখে রাখতেন ‘তাঁর’ কথা। শুরুতে ভাবেননি এমন একটা বই লিখবেন। নিজের জন্যই নিজের মতো করে লিখে গেছেন সেই সাংকেতিক দিনলিপিমালা। শ্রীরামকৃষ্ণও কী জানতেন না মাস্টারমশাই কী করতে চলেছেন ভবিষ্যতে? নইলে স্বামী শিবানন্দকে কেন তিনি নোট নেওয়া থেকে বিরত করে বলবেন– ও কাজের জন্য অন্য লোক ঠিক করা আছে।
তিনি নিখাদ মাস্টারমশাই। বাঙালি মাস্টারমশাইদের আর্কেটাইপ ভেঙে গিয়েছে গত পঞ্চাশ বছরে। তাই অনুরোধ করি, আরেকটু পিছিয়ে যান। যখন বাংলার সুশিক্ষিত যুবকেরা শিক্ষকতাকে নিছক ‘বিদ্যাদানের পেশা’ নয়, দেশ গড়ার কাজ হিসেবে বেছে নিতেন। আমরা বলছি, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের কথা। এ সেই সময়ের কথা, যখন উত্তর কলকাতার একাংশকে ‘বাংলার এথেন্স’ বলতেন কেউ-কেউ। সংকুচিত অর্থে হলেও বাংলার কলকাতা-কেন্দ্রিক উচ্চ ও মধ্যবিত্ত সমাজে একটা আলোড়ন যে শুরু হয়েছিল, তা অস্বীকারের কোনও জায়গা নেই। তাকে ‘নবজাগরণ’ বলা হবে, না কি অন্য কোনও নামে ডাকা হবে সে প্রশ্ন স্বতন্ত্র। তবে ওই উত্তর কলকাতায় পায়ে-হাঁটা দূরত্বে বসতবাড়ি ছিল রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, শিবনাথ শাস্ত্রী, কেশবচন্দ্র সেন, নরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির একঝাঁক প্রতিভাবান বাঙালির। ভূগোলটা আরেকটু টেনে বাগবাজারে গিরিশ ঘোষের বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে গেলে ম্যাপিংটা আরও পরিষ্কার হবে। সেই সঙ্গে খেয়াল করে দেখার মতো, এই বাঙালি মনীষার একটা বড় অংশ শিক্ষকতাই করেছেন– বিদ্যাসাগরমশাই যার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। ঋজু, যুক্তিবাদী, পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের জ্ঞানভাণ্ডার প্রকৃত অর্থে আত্মস্থ করে শিক্ষা ও নারীমুক্তি নিয়ে ভাবিত। মোকাম কলিকাতার এই আলোকোজ্জ্বল এই মেধাবী-গোলার্ধের শিবনারায়ণ দাস লেনে ১৮৫৪ সালে জন্ম হয় মাস্টারমশাই মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত-র। অবিশ্যি যে কোনও রোয়েদাদেরই অন্তর্গত সংকট আছে– আলো কলকাতার অন্যত্রও জ্বলেছিল, তা সে খিদিরপুরে দত্তবাড়ির মধুসূদনকেই ধরুন বা দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। নতুন জেগে ওঠা সমাজের আলোচনায় এই বিবিধের সমাহার কিন্তু নতুন কোনও ঘটনা নয়। বরং নানা রঙের আলোয় সেজে ওঠা এবং কোথাও বেশ কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে ফের অন্য কোথাও হোঁচট খেয়ে পিছিয়ে আসাটাই এই সময়ের যুগধর্ম হওয়ার কথা।
মাস্টারমশাই শিবনারায়ণ দাস লেনে জন্মালেও পরে তাঁদের বাসস্থান হবে ১৩/২ গুরুপ্রসাদ চৌধুরী লেনে (এখন ১৪ নম্বর), যাকে আমরা ‘কথামৃত ভবন’ বলে চিনি। মাস্টারমশাইয়ের কথা বলতে গিয়েই উঠে এল ‘কথামৃত’-র কথা। তাঁর সারাজীবনের সাধনাতেই তাঁর পরিচিতি হবে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’ বাঙালির চিরকালের অন্তরের ধন, আর রসিক পাঠকের কাছে ‘আনপুটডাউনেবল’ তো বটেই। এই একুশ শতকে এসে আমরা কোন দর্শনের কথা পাই ‘কথামৃত’-এ ? ২০১৩ সালে মণীন্দ্র গুপ্ত একটি প্রবন্ধে আমাদের সে-কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন:
‘এই দর্শন বাহির ও ভিতরের মর্ম খুলে দেখায়– আমরা প্রাণীরা, পাথরেরা, জ্যোতিষ্কেরা, সবাই একই ম্যাজিকে তৈরি। আমরা সত্য-মিথ্যা, আলো অন্ধকার, বিদ্যা-অবিদ্যার পারে বসে বাচ্চাদের মতো খেলেছি– আমরা পুরুষ সাজি, মেয়ে সাজি, যুবক সাজি, বৃদ্ধ সাজি, দপদপ করে জ্বলি, টিমটিম করে নিভে যাই। কে জানে হয়তো শূন্যও আমরা, আকাশও আমরা।
জগৎ দলে মেলে, জগৎ সংবৃত হয়ে আসে। টানা হাসির শব্দ শোনা যায়, কান্না ক্ষতে গুমরে ওঠে।’
মণীন্দ্রবাবু শ্রীরামকৃষ্ণ দর্শনের যে-সারাৎসার আমাদের জন্য নির্মাণ করলেন তার মূল অবলম্বন, লেখাই বাহুল্য– ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’, যার প্রণেতা মাস্টারমশাই মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত।
শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্তমণ্ডলীর একটা বড় বৈশিষ্ট্য হল তাঁরা প্রায় প্রত্যেকে প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যায়তনের জলহাওয়ায় বড় হয়ে উঠেছেন এবং অনেকেই যথেষ্ট কৃতী ছাত্র। মাস্টারমশাই মহেন্দ্রনাথ গুপ্তও রীতিমতো ভালো ছাত্র বলেই পরিচিত ছিলেন। তিনি হেয়ার স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় দ্বিতীয় হন, প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ফার্স্ট আর্টস এবং বিএ পরীক্ষায় যথাক্রমে পঞ্চম ও তৃতীয় হন। কলেজে ইতিহাস, দর্শন, ইংরেজি সাহিত্য, বিজ্ঞান পড়েন। শোনা যায়, গ্র্যাজুয়েশনের সময় অঙ্ক পরীক্ষার নির্ধারিত দিনে তিনি না কি পরীক্ষাই দেননি। নইলে হয়তো রেজাল্ট আরও ভালো হতে পারত। কলেজের শেষের দিকেই ব্রাহ্মসমাজে তাঁর যাতায়াত শুরু হয়। বিশেষ করে কেশবচন্দ্র সেনের বক্তৃতায় তাঁর বিশেষ রুচি ছিল। প্রসঙ্গত, বলে রাখি বিএ পড়তে-পড়তেই কেশবচন্দ্র সেনের নিকটাত্মীয়া নিকুঞ্জদেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।
…………………………………………
মাস্টারমশাই মহেন্দ্রনাথ গুপ্তও রীতিমতো ভালো ছাত্র বলেই পরিচিত ছিলেন। তিনি হেয়ার স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় দ্বিতীয় হন, প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ফার্স্ট আর্টস এবং বিএ পরীক্ষায় যথাক্রমে পঞ্চম ও তৃতীয় হন। কলেজে ইতিহাস, দর্শন, ইংরেজি সাহিত্য, বিজ্ঞান পড়েন। শোনা যায়, গ্র্যাজুয়েশনের সময় অঙ্ক পরীক্ষার নির্ধারিত দিনে তিনি না কি পরীক্ষাই দেননি। নইলে হয়তো রেজাল্ট আরও ভালো হতে পারত।
…………………………………………
ডিগ্রি পরীক্ষার পর মহেন্দ্রনাথ সামান্য কিছু দিন কলকাতার একটি সদাগরি অফিসে কাজ করে চলে যান যশোরের নড়াইল হাইস্কুলের হেডমাস্টার হয়ে। সেখান থেকে মেট্রোপলিটন স্কুলের শ্যামবাজার ব্রাঞ্চের হেডমাস্টার হয়ে আসেন। মেট্রোপলিটন স্কুল ছিল বিদ্যাসাগরমশাইয়ের প্রতিষ্ঠা করা। তাঁর সঙ্গে মহেন্দ্রনাথের অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল। তিনি এই স্কুলের বিভিন্ন শাখায় কাজ করেছেন। পরিস্থিতি এমন হয় যে এক সময় তিনি না কি একই সঙ্গে তিনটি স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। কিন্তু এরই মধ্যে ১৮৮২ সালে মহেন্দ্রনাথের অন্তর্জগতে একটা বড়সড় বিপ্লব ঘটে যায়। তাঁর জীবনে আসেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস। যিনি প্রথম সাক্ষাতে মহেন্দ্রনাথকে বিরাট প্রশ্রয় না দিলেও মহেন্দ্রনাথ বুঝছিলেন এই মানুষটিই তাঁর সাধনের উড়ালবিন্দু। শ্রীরামকৃষ্ণ কলকাতার ‘ইংলিশম্যান’দের বেশ ব্যঙ্গ করলেও ইংরেজি-শেখা বাঙালিরা, শ্রীরামকৃষ্ণের ভাষায়, আফিম খাওয়া ময়ূরের মতোই দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুরের সামনে গিয়ে হাজির হতেন। কিন্তু ঠাকুর মানুষ চিনতেন। তাই মাস্টারমশাইকে চিনতে তাঁর ভুল হয়নি। স্পষ্ট জানিয়েছিলেন– ‘তোমায় চিনেছি– তোমার ‘চৈতন্যভাগবত’ পড়া শুনে। তুমি আপনার জন, এক সত্তা– যেমন পিতা আর পুত্র।’ এরপর আর ঠাকুরকে বাদ দিয়ে মাস্টারমশাইয়ের অস্তিত্ব থাকে কী করে।
সংকট আরেকটা ঘটল ১৮৮৬ সালে। সেবছর পরীক্ষায় শ্যামবাজার মেট্রোপলিটন স্কুলের রেজাল্ট অন্যবারের চেয়ে খারাপ হওয়ায় বিদ্যাসাগরমশাই মহেন্দ্রনাথের কাশীপুরে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে নিত্য যাওয়া-আসা নিয়ে কটু মন্তব্য করায় মাস্টারমশাই স্কুলের চাকরি থেকে পদত্যাগ করলেন। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই রিপন কলেজে অধ্যাপনার কাজও মিলে গেল। কিন্তু বিদ্যাসাগরমশাইয়ের স্কুল পরিচালনায় এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে এখনও অনেকেই অবাক হন। এমনিতে মহেন্দ্রনাথ ছাত্রাবস্থা থেকেই বিদ্যাসাগরের ব্লু-আইড বয়। মাস্টারমশাইয়ের কথাতেই নরেন্দ্রনাথ দত্তকে তিনি বউবাজার ব্রাঞ্চের হেডমাস্টার করেছিলেন এবং বিদ্যাসাগরমশাইয়ের জামাই সূর্যকুমারের রোষে নরেন্দ্রনাথের চাকরি যাবার সংবাদটিও মহেন্দ্রনাথের মাধ্যমেই নরেন্দ্রনাথকে জানানো হয়। এমনকী, ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’-র তৃতীয় খণ্ডের শুরুতেই বিদ্যাসাগরমশাইয়ের বাদুড়বাগানের বাড়িতে ৫ অগাস্ট ১৮৮২ সালে ঠাকুরের আসার যে-কাহিনি লিপিবদ্ধ আছে সেই সাক্ষাৎকার আয়োজনে মহেন্দ্রনাথের নিজের কোনও ভূমিকা কী ছিল না ? কিন্তু সমস্যা হল বিদ্যাসাগরের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের দার্শনিক অবস্থানগত দূরত্ব ছিল। নইলে শ্রীরামকৃষ্ণ নিজে থেকে তাঁর বাড়ি এসে যখন বললেন– ‘আজ সাগরে এসে মিললাম। এতদিন খাল বিল হদ্দ নদী দেখেছি, এইবার সাগর দেখ্ছি।’ প্রত্যুত্তরে বিদ্যাসাগরমশাই কিন্তু সুভাষণের রাস্তাতেও না হেঁটে হাসিমুখে ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট জানিয়ে দেন– ‘তবে নোনা জল খানিকটা নিয়ে যান।’ তাঁদের এই দূরত্ব মূলত দার্শনিক একথা বলেছি– বেদান্ত দর্শনে বিদ্যাসাগরের আস্থা ছিল না, সেকথা নিজেই লিখেছেন তিনি।
শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে পরিচয়ের বহু আগে থেকেই– থার্ড ক্লাসের ছাত্র যখন, তখন থেকেই ডায়েরি লেখার অভ্যেস মহেন্দ্রনাথের। শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে আসার পর মাস্টারমশাইয়ের ডায়েরি লেখার অভ্যেসই ‘কথামৃত’-র আকর। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের বক্তব্যের ধারাবিবরণী লেখেননি তিনি। সামনে বসে নোটও নেননি। বাড়ি এসে নিজস্ব সাংকেতিক বাক্যে লিখে রাখতেন ‘তাঁর’ কথা। শুরুতে ভাবেননি এমন একটা বই লিখবেন। নিজের জন্যই নিজের মতো করে লিখে গেছেন সেই সাংকেতিক দিনলিপিমালা। শ্রীরামকৃষ্ণও কী জানতেন না মাস্টারমশাই কী করতে চলেছেন ভবিষ্যতে? নইলে স্বামী শিবানন্দকে কেন তিনি নোট নেওয়া থেকে বিরত করে বলবেন– ও কাজের জন্য অন্য লোক ঠিক করা আছে।
১৮৮২-র ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮৮৬ সালের ১৫ অগাস্ট ঠাকুরের মহাসমাধি পর্যন্ত যে সময়কাল তাই ‘কথামৃতে’র টাইমলাইন। তবে ঘড়ির কাঁটা কী কাল মাপতে পারে ! ‘কথামৃত’ বস্তুত টাইমলেস। মাস্টারমশাই ঠাকুরের মহাসমাধির পরেই অনুভব করেন এইরকম একটা বই লেখার প্রয়োজনীয়তা। ১১ জুলাই ১৮৮৮ তিনি বেলুড়ে এবং ৫ মার্চ ১৮৯০ কলকাতায় হেম কর লেনে তিনি সারদামণিকে পাণ্ডুলিপি শোনান। শ্রীমায়ের অনুমতি নিয়েই তিনি এই বই প্রচারের কথা ভাবেন।
বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্ট ছিল মাস্টারমশাইয়ের খুবই পছন্দের, কিন্তু তিনি চাইছিলেন এমন একটা বই লিখতে যেখানে ইতিহাস শুধু তথ্যবিবরণী নয়। বরং তাঁর বিশ্বাস ছিল ইতিহাস হবে– ‘হিস্ট্রি অফ ওয়ান’স মাইন্ড অ্যান্ড সোল’। সম্ভবত এই ইতিহাস সম্বন্ধে তাঁর এই অত্যাশ্চর্য আধুনিক বোধই ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’-র সাফল্যের চাবিকাঠি। জীবনী লেখার প্রথাগত আচার ছেড়ে কাঙ্ক্ষিত মানুষটির অন্তরাত্মাকে ছুঁতে চাওয়ার এই প্রচেষ্টাই মাস্টারমশাইকে অন্যদের থেকে আলাদা করে দেয়। আবার, স্মৃতি লেখার আরেকটি সমস্যা হল নিজের কথা বড় হয়ে ওঠা। নিজেকে আড়াল করতে না পারায় অনেক স্মৃতিকথাই শেষ পর্যন্ত নিজের কথায় পর্যবসিত হয়। মাস্টারমশাই সেদিক থেকেও ব্যতিক্রম। ‘কথামৃত’-এ তিনি আছেন নিজের পরিচয় লুকিয়ে। ‘মাস্টার’, ‘মাস্টারমশাই’, ‘মণিমোহন’, ‘ভক্ত’, ‘মহিন্দর’, ‘একজন ভক্ত’, ‘মণি’ ইত্যাদি নামের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে নিয়েছেন। এমনকী, গ্রন্থকারও স্বনামে নয়– ‘শ্রীম’। সারা পৃথিবীর চরিতসাহিত্যের (যদি ক্লাসিক্যাল অর্থে ‘কথামৃত’ চরিতসাহিত্য নয়) হেজিওগ্রাফি হয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা থাকে। মাস্টারমশাই সে-সম্পর্কেও সম্যক জানতেন, তাই এই বই লেখায় তাঁর তাত্ত্বিক ভাবনারও কিছু পরিচয় আমাদের থাকা উচিত। তিনি বলেছেন–
‘‘যে লেখার লেখক নিজ চোখে দেখেছেন, নিজ কানে শুনেছেন ঠাকুরের কথা ও কাজ, আবার সেই দিনই লিখেছেন, তাই ফার্স্ট ক্লাস এভিডেন্স। দু’নম্বর হলো, নিজে দেখেছেন, শুনেছেন, কিন্তু অনেক পরে লিখেছেন। আর তিন নম্বর হলো, যার সংগ্রহ অন্যের কাছ থেকে শুনে। এর সঙ্গে আর এক ক্লাশের এভিডেন্স দেখতে পাওয়া যায় মাঝে মাঝে। একে ফোর্থ ক্লাশ বলা যেতে পারে। লেখকের নিজের দেখা ও শোনা কথা, কিন্তু তৎকালে লিখিত নয়, আর অপরের নিকট হতে সংগ্রহ করা– এই দুইয়ের মিশ্রিত লেখা।
কথামৃত এই ফার্স্ট ক্লাশ এভিডেন্স। আমরা নিজ চক্ষুতে ঠাকুরের যে কার্য দেখেছি এবং নিজ কর্ণে তাঁর যে মহাবাক্য শুনেছি, বাড়ি এসে তাই ডায়রিতে লিখেছি, সেই দিনই। কখনও সমানে কয়েকদিন ধরে লিখেছি।… মূলগ্রন্থে বিবৃত সমস্ত ‘সিনে’ আমরা উপস্থিত ছিলাম।’’
‘কথামৃত’ প্রকাশ নিয়েও বিড়ম্বনা ছিল। সেকালের বিখ্যাত প্রকাশক ‘গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স’ না কি এ-বই ছাপতে চায়নি। পরমহংসদেবের শিষ্য ‘বসুমতী’র উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ও এটি নিয়ে দীর্ঘসূত্রিতা দেখান, তবে তিনি বইটি ছাপা সম্পর্কে মাস্টারমশাইকে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন– ছাপা, কাগজ, গেট-আপ ভালো হতে হবে এবং দাম বেশি রাখতে হবে ইত্যাদি। শেষ পর্যন্ত মাস্টারমশাইয়ের ছাত্র স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ উদ্বোধন প্রেস থেকে ১৯০২ সালে এর প্রথম খণ্ড প্রকাশ করেন। পরবর্তী তিনটি খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৯০৪, ১৯০৮ এবং ১৯১০ সালে। এর আগেই ১৮৯৭ সালে প্রকাশিত হয়– ‘Gospel of Sri Ramkrishna’ (According to M. , a Son of the Lord and disciple)।
স্বামী বিবেকানন্দ প্রথম থেকেই মাস্টারমশাইয়ের কাজের মূল্য বুঝেছিলেন। ১৮৯৭-এর ২৪ নভেম্বর দেরাদুন থেকে লেখা চিঠিতে তিনি বললেন–
“My dear ‘M.’ Many many thanks for your second leaflet. It is indeed wonderful. The move is quite original and never was the life of a great teacher brought before the public untarnished by the writer’s mind as you are doing. The language also is beyond all praise– so fresh, so pointed and withal so plain and easy, I cannot express in adequate terms how I have enjoyed them. I am really in a transport when I read them. Strange, isn’t it? Our teacher and Lord was so original and each one of us will have to be original or nothing. I now understand why none of us attempted his life before. It has been reserved for you this great work. He is with you evidently.
P. S.
Socratic dialogues are Plato all over. You are entirely hidden. Moreover, the dramatic part is infinitely beautiful. Everybody likes it, here or in the West.”
‘কথামৃত’ দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশের সময়েও কিন্তু তিনি শিক্ষকতা ত্যাগ করেননি। বরং ১৯০৫ সালে মর্টন স্কুল কিনে নিয়ে নতুন উদ্যমে স্কুল চালাতে শুরু করেন। তবে ততদিনে তাঁর ধ্যানজ্ঞান ‘কথামৃত’। মর্টন স্কুলে উপরের চারটি ক্লাসে ছাত্রদের ‘কথামৃত’ পড়ানো হত। তা নিয়ে নিন্দেমন্দও কম হয়নি। সেই স্কুলের শিক্ষক ও পরবর্তীকালে ষোলো খণ্ডে ‘শ্রীম-দর্শন’-এর রচয়িতা স্বামী নিত্যাত্মানন্দ (মাস্টারমশাইয়ের চিঠিতে ‘জগবন্ধুবাবাজি’) প্রথম খণ্ডের প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় এ-বিষয়ে বিশদে লিখেছেন।
নিজের লেখা নিজের উদ্যোগে ছাপার ব্যবস্থা করা– বাংলায় এমন বেশ কয়েকটি হয়েছে, তা কখনও অভিধান, কখনও ‘মহাভারত’-এর অনুবাদ; সবেতেই লেখকের প্যাশন স্পষ্ট। কিন্তু মাস্টারমশাইয়ের লড়াইটা ছিল অন্য জায়গায়। একজন যুগপুরুষের অন্তরাত্মাকে স্পর্শ করা এবং তা লিপিবদ্ধ করা। তাঁর লিখনপদ্ধতির বর্ণনাও দিয়েছেন স্বামী নিত্যাত্মানন্দ– ‘শ্রীমর জীবনভর একমাত্র ধ্যেয় ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ। প্রথম দর্শন হইতে তাঁহার চিত্রাবলী শ্রীম মানসপটে অঙ্কিত করিয়া রাখিয়াছেন। আর বাহিরে আছে আত্ম-ডায়েরিতে সেই চিত্রাবলীর সংক্ষিপ্ত স্কেচ, শ্রীমর আবিষ্কৃত বাংলায় শর্টহ্যান্ড অক্ষরে। এই ডায়েরি খুলিয়া শ্রীম সম্মুখে রাখেন। আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধ্যানমগ্ন থাকেন বাহ্যজ্ঞান বিলুপ্ত হইয়া।… শ্রীম বলিতেন, তোমাদের কাছে দূর, আমাদের কাছে যেন কালকের ঘটনা। এক একটা ঘটনা হাজারবার ধ্যান করেছি।’
‘কথামৃত’ চতুর্থ খণ্ড আর পঞ্চম খণ্ডের প্রকাশের মধ্যে বাইশ বছরের ব্যবধান। এর মধ্যে ভবানীপুরের গদাধর আশ্রম থেকে আমহার্স্ট স্ট্রিটের মর্টন স্কুলে আসতে গিয়ে একবার একটি ডায়েরি ভুলবশত এসপ্ল্যানেডে কালীঘাটের ট্রামে ফেলে আসেন। পরে অবশ্য তা পাওয়াও যায়। কিন্তু এই দীর্ঘ সময় সম্ভবত এক পলের জন্যও তিনি নিজের কাজ থামাননি। স্বামী গম্ভীরানন্দ তাঁর ‘শ্রীরামকৃষ্ণ-ভক্তমালিকা’য় মাস্টারমশাই সম্পর্কে লিখেছিলেন– ‘শেষজীবনে যাঁহারা মাস্টার মহাশয়কে দর্শন করিয়াছেন, তাঁহারা জানেন যে, তাঁহার বাসস্থান তখন প্রাচীন ঋষিদের তপোভূমিতে পরিণত হইয়াছিল–– সংসারের প্রবল তরঙ্গোদ্বেলিত স্রোত নিম্বে প্রবাহিত, আর রাজপথের কোলাহলের ঊর্ধ্বে হিমালয়ের নীরবতা বিরাজমান’। ১৯৩২-এর ৪ জুন মৃত্যুর আগের রাতেও তিনি পঞ্চম খণ্ডের প্রুফ দেখছিলেন। পঞ্চম খণ্ড প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর পর, সে বছরের ২৪ অগাস্ট। শ্রীরামকৃষ্ণের মতো প্রজ্ঞাবান মানুষকে প্রজন্মবাহিত করার জন্য তাই কোনও বসওয়েল নয়, মাস্টারমশাইকে প্রয়োজন ছিল।
……………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………….