‘ভাই ছুটি’, কবিপত্নী মৃণালিনী দেবীকে নিয়ে গানে, কথায় সাজানো আলেখ্য। মৃণালিনীকে লেখা কবির চিঠিগুলির মধ্যে দিয়ে খুঁজে পাই এক কর্তব্যপরায়ণ স্বামী এবং স্নেহশীল পিতাকে, সে এক ‘ঘরোয়া’ রবীন্দ্রনাথ। আমার সঙ্গে অনুষ্ঠানে ছিল, রবীন্দ্রভারতী প্রদর্শ-শালার তৎকালীন অধ্যক্ষ ইন্দ্রাণী ঘোষ, চৈতি ঘোষাল, গানে রোহিনী রায়চৌধুরী। কাদম্বরী দেবীকে নিয়ে আমার যে গবেষণা কাজটি আছে শঙ্খ ঘোষের তত্ত্বাবধানে, সেটির শিরোনাম ‘শ্রীমতী হে’, মঞ্চে এই অনুষ্ঠান বারে বারে করে থাকি, একটি সিডিও বেরিয়েছিল ওই নামে হিন্দুস্থানের রেকর্ডস থেকে। সেটি আবার করেছিলাম দূরদর্শনের জন্য। সিডি-তে যারা অংশগ্রহণ করেছে তারাই ছিল দূরদর্শনের অনুষ্ঠানে। এই ধরনের কাজ করার একটি বিশেষ উদ্দেশ্য আছে।
১৯.
‘ক্লোজ আপ’ এবং ‘কথায় কথায়’ আমাদের আরও দুটো জনপ্রিয় অনুষ্ঠান।
‘ক্লোজ আপ’ চলচ্চিত্র জগতের বিশিষ্ট মানুষজনদের সাক্ষাৎকারমূলক অনুষ্ঠান, নামেই তা বোঝা যাচ্ছে। আমার নেওয়া যেসব ইন্টারভিউ রয়েছে তার মধ্যে খুবই চ্যালেঞ্জিং ছিল তিনটি– কারণ এর আগে তাঁরা কেউই আসতে রাজি হননি স্টুডিওতে। আমার অনুরোধে এঁরা এলেন এবং অনায়াসে, স্বচ্ছন্দে অভিজ্ঞতার ঝুলি উজাড় করে দিলেন। এই তিনজন হলেন– সুপ্রিয়া দেবী, অপর্ণা সেন, মুনমুন সেন। ব্যক্তিগত সম্পর্কের খাতিরে ওঁদের যে আনতে পেরেছিলাম, সে আমার পরম সৌভাগ্য।
বেনুমাসির তখন হাঁটতে বেশ কষ্ট, স্টুডিওর ওই লম্বা করিডর পেরতে অসুবিধে হচ্ছিল বুঝতে পারছি কিন্তু মুখের হাসি অম্লান। প্রত্যেকটি অনুষ্ঠান দু’টি পর্বে বিন্যস্ত। পারলে অপর্ণা সেনের তিনটি এপিসোড ধরতাম, তাঁর প্রতিভা বহুমুখী। একটি পর্বে অভিনেত্রী, অন্য পর্বে সম্পাদক, পরিচালক– এভাবে ভাগ করলাম শেষে। তাপস পালের ক্লোজ আপেরও দু’টি পর্ব। হই হই করে ওর সিনেমার গান গেয়েছিল, মনে আছে। দেবাশিস সেনগুপ্ত তখন ক্লোজ আপ প্রযোজনা করত।
চলচ্চিত্রকার গৌতম ঘোষকে আনতে পেরেছিলাম এক ক্লোজ আপে, এনেছিলাম পরিচালক অনীক দত্তকেও। আর যেসব অভিনেতার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, তাদের মধ্যে আছে, শাশ্বত চ্যাটার্জি, শঙ্কর চক্রবর্তী, রুদ্রনীল ঘোষ। মূলত মঞ্চ অভিনেত্রী হলেও পর্দায় তাঁর কাজ কিছু কম নয়, চিত্রা সেন। তাঁকে নিয়েও ক্লোজ আপ করেছি।
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, অনন্য এক অভিনেত্রী, তাঁর সাক্ষাৎকারও নিয়েছি তবে ক্লোজ আপে নয়, সে অনুষ্ঠানের শিরোনাম ‘কথায় কথায়’। অনেক কথার মাঝে যখন উত্তম কুমার বিষয়ে কিছু বলতে বলেছি তখন, ছোট ছোট ঘটনার উল্লেখ করেছেন বটে কিন্তু তার সঙ্গে বলেছেন, ‘‘উত্তমদার কথা বলতে গেলে ছ’ সাতটা এপিসোড লেগে যাবে, এটুকু সময়ের মধ্যে বলা যাবে না।’’
মাধবী মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে অনুষ্ঠানের শুটিং হয়েছিল তাঁর লেক গার্ডেন্সের বাড়িতে। বাইরের ঘরে ‘চারুলতা’র একটা পোস্টার ছিল মনে আছে, তাকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে সেখানে দাঁড়িয়ে মুখবন্ধ করেছিলাম।
সংগীতশিল্পী আরতি মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে ‘কথায় কথায়’ অনুষ্ঠানও মনে রাখার মতো। প্রবল ঝড়বৃষ্টির দিনে কলকাতার রাস্তা যখন বানভাসি তখন কোনওরকমে জল পেরিয়ে গাড়ি এসে পৌঁছল আরতিদিকে নিয়ে। মেক আপ রুমে অপেক্ষা করছিলাম, একটা সময় মনে হচ্ছিল হয়তো আজ আর রেকর্ডিংটা করা যাবে না। কিন্তু কথা দিয়েছেন যে, তাই এসেছেন দুর্যোগ সত্ত্বেও। তৈরি হলেন ওঁর সেই চিরাচরিত সাজে, জরিপাড় সাদা গাদোয়াল শাড়িতে। যদিও একটু যেন মনক্ষুণ্ণ ভাব কারণ আগে থেকে আমি কী প্রশ্ন করব, কিছুই বলছি না বলে। আমি বললাম, ‘চলই না, ফ্লোরে গিয়ে বসি, তারপর খানিক গল্প করা যাবে।’ কথাটায় যে আশ্বস্ত হলেন না, বুঝতে পারলাম। ক্যামেরার টেলি লাইট অন হওয়ার পর ব্যাপারটা দাঁড়াল একেবারে অন্যরকম! ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ভূমিকা করে তারপর যখন তাঁর দিকে ফিরলাম তখন দেখি সেই মিষ্টি হাসিটা ঠোঁটের কোণে, তারপর আমায় আর পায় কে ! অবলীলায় গল্প জুড়ে দিলাম, আরতিদি তখন সহজ, স্বতঃস্ফূর্ত, কথার ফাঁকে ফাঁকে গান গাইছেন, কিছুক্ষণ আগের অস্বস্তিটা উধাও! দূরদর্শনের প্রথম যুগের অনুষ্ঠানে যেমন দেখেছি এত বছর পরেও কণ্ঠে তেমনই তারুণ্য, বয়স যাকে ছুঁতে পারেনি।
………………………………………………….
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, অনন্য এক অভিনেত্রী, তাঁর সাক্ষাৎকারও নিয়েছি তবে ক্লোজ আপে নয়, সে অনুষ্ঠানের শিরোনাম ‘কথায় কথায়’। অনেক কথার মাঝে যখন উত্তম কুমার বিষয়ে কিছু বলতে বলেছি তখন, ছোট ছোট ঘটনার উল্লেখ করেছেন বটে কিন্তু তার সঙ্গে বলেছেন, ‘‘উত্তমদার কথা বলতে গেলে ছ’ সাতটা এপিসোড লেগে যাবে, এটুকু সময়ের মধ্যে বলা যাবে না।’’
………………………………………………….
দূরদর্শনে কাজ করার ফলে বহু বিশিষ্ট মানুষের সান্নিধ্য পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে, সে কথা আগেও বলেছি আবারও পরে বলব, কিন্তু এই মুহূর্তে যাঁর কথা বলতে ইচ্ছে করছে, তিনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। বাংলা শার্ট আর ধুতি পরা যেমন সৌম্যকান্তি চেহারা তেমনই সজ্জন এক মানুষ। কত বড় মাপের শিল্পী কিন্তু কী অমায়িক, বিনয়ী, সুভদ্র এক ব্যক্তিত্ব। ১৯৮৮-তে আমাদের রবিবারের সকালের অধিবেশন চালু হয়। সেই প্রথম দিনের সকালে শিল্পী ছিলেন হেমন্তদা। সেটা ছিল শরৎকাল, রবীন্দ্রনাথের তিনটি শরতের গান গেয়েছিলেন তিনি। আমি ছিলাম সেই অধিবেশনের উপস্থাপক। সে সকাল এক অনবদ্য সকাল। আমার ঘোষণার পর হেমন্তদা গান ধরলেন, ‘আজি শরত তপনে প্রভাত স্বপনে কি জানি পরাণ কি যে চায়…’, শরীর যে তখন খুব ভালো ছিল, তা বলতে পারি না, তবে গলার মাদকতা এতটুকুও কমেনি। হয়তো দূরদর্শনে এটি তাঁর শেষ অনুষ্ঠান। যেটি অমোঘ সত্য, তা হল– পরের বছর ঠিক ওই সময় তিনি চলে গেলেন, খবরের কাগজ লিখল, ‘এই শরতে হেমন্ত নেই’। হয়তো আগে বলেছি, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ছাড়া হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আমাকে ‘বউমা’ বলে ডাকতেন, হরিসাধন দাশগুপ্তের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রে।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কত অজস্র কাজ যে করেছি, তার ইয়ত্তা নেই এবং প্রত্যেকটিই সংগ্রহে রাখার মতো অনুষ্ঠান, অথচ আদৌ তা রাখা হয়েছে কি না, জানা নেই। এর অনেকগুলিই ঘরে বাইরের অন্তর্গত। দু’-একটি অনুষ্ঠানের কথা বলি। ‘ভাই ছুটি’, কবিপত্নী মৃণালিনী দেবীকে নিয়ে গানে, কথায় সাজানো আলেখ্য। মৃণালিনীকে লেখা কবির চিঠিগুলির মধ্যে দিয়ে খুঁজে পাই এক কর্তব্যপরায়ণ স্বামী এবং স্নেহশীল পিতাকে, সে এক ‘ঘরোয়া’ রবীন্দ্রনাথ। আমার সঙ্গে অনুষ্ঠানে ছিল, রবীন্দ্রভারতী প্রদর্শ-শালার তৎকালীন অধ্যক্ষ ইন্দ্রাণী ঘোষ, চৈতি ঘোষাল, গানে রোহিনী রায়চৌধুরী। কাদম্বরী দেবীকে নিয়ে আমার যে গবেষণা কাজটি আছে শঙ্খ ঘোষের তত্ত্বাবধানে, সেটির শিরোনাম ‘শ্রীমতী হে’, মঞ্চে এই অনুষ্ঠান বারে বারে করে থাকি, একটি সিডিও বেরিয়েছিল ওই নামে হিন্দুস্থানের রেকর্ডস থেকে। সেটি আবার করেছিলাম দূরদর্শনের জন্য। সিডি-তে যারা অংশগ্রহণ করেছে তারাই ছিল দূরদর্শনের অনুষ্ঠানে। এই ধরনের কাজ করার একটি বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। বাজার চলতি কল্পিত কদর্য গল্পগুলির বিরুদ্ধাচরণ করা, সঠিক তথ্যের মাধ্যমে সত্যটিকে প্রচার করা।
……………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………..
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করতাম তার মধ্যে একবার করলাম রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট নারী চরিত্র নিয়ে, ‘নন্দনেরই নন্দিনী’। ‘রক্তকরবী’র নন্দিনী থেকে ‘নটীর পূজা’র শ্রীমতী এমন অনেক চরিত্রই ধরা পড়েছিল সেখানে। আমার সঙ্গে ছিল কবি মন্দার মুখোপাধ্যায় এবং রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী রাজশ্রী ভট্টাচার্য।
ঘরে বাইরের বাইরেও বারবার বিষয় হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, সেসব অনুষ্ঠানের কথা বলব পরবর্তী পর্বে।
……………………………. পড়ুন কেয়ার অফ দূরদর্শন-এর অন্যান্য পর্ব ……………………………
পর্ব ১৮: হুইল চেয়ারে করে দূরদর্শনে শেষ অভিনয় করতে এসেছিলেন তৃপ্তি মিত্র
পর্ব ১৭: বাংলা টেলিভিশনে সেই প্রথম ‘মা ও মেয়ে’ নিয়ে সিরিজ অনুষ্ঠান
পর্ব ১৬: রবীন্দ্রনাথের স্থাপত্যচিন্তা নিয়ে তথ্যচিত্র সেই প্রথম
পর্ব ১৫: ট্রেনে শুটিং-এর সময় সলিল চৌধুরী গেয়েছিলেন, ‘এই রোকো, পৃথিবীর গাড়িটা থামাও’
পর্ব ১৪: দূরদর্শনের জন্য প্রথম তথ্যচিত্র করা আসলে ছিল অ্যাডভেঞ্চার!
পর্ব ১৩: সেন্ট পল ক্যাথিড্রালকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে সারা দুপুর সাপ্তাহিকীর শুটিং হয়েছিল!
পর্ব ১২: দূরদর্শন ভবনের উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রী স্মিত হাসি নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন দুই উপস্থাপকের দিকে
পর্ব ১১: প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আততায়ীর হাতে নিহত, গোলযোগের আশঙ্কায় দূরদর্শনের বাইরের গেটে ঝুলছিল তালা!
পর্ব ১০: সাদা-কালো থেকে রঙিন হয়ে উঠল দূরদর্শন
পর্ব ৯: ফুলে ঢাকা উত্তমকুমারের শবযাত্রার বিরাট মিছিল আসছে, দেখেছিলাম রাধা স্টুডিওর ওপর থেকে
পর্ব ৮: যেদিন বীণা দাশগুপ্তার বাড়ি শুট করতে যাওয়ার কথা, সেদিনই সকালে ওঁর মৃত্যুর খবর পেলাম
পর্ব ৭: ফতুয়া ছেড়ে জামা পরতে হয়েছিল বলে খানিক বিরক্ত হয়েছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস
পর্ব ৬: ভারিক্কিভাব আনার জন্য অনন্ত দাস গোঁফ এঁকেছিলেন অল্পবয়সি দেবাশিস রায়চৌধুরীর মুখে
পর্ব ৫: দূরদর্শনে মান্য চলিত ভাষার প্রবর্তক আমরাই
পর্ব ৪: রবিশঙ্করের করা দূরদর্শনের সেই সিগনেচার টিউন আজও স্বপ্নের মধ্যে ভেসে আসে
পর্ব ৩: অডিশনের দিনই শাঁওলী মিত্রের সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছিল শাশ্বতীকে!
পর্ব ২: স্টুডিওর প্রবল আলোয় বর্ষার গান গেয়ে অন্ধকার নামিয়ে ছিলেন নীলিমা সেন
পর্ব ১: খবর পেলাম, কলকাতায় টেলিভিশন আসছে রাধা ফিল্ম স্টুডিওতে