ইউরোপের ফ্যাসবিন্ডার, আলমোদোভারদের পাশাপাশি আমেরিকার জন ওয়াটার্সরা যখন সিনেমাশিল্পে এলেন, পরের পর এমন সব সিনেমা তৈরি হতে থাকল, যেগুলিতে নারীরাই প্রধান, নারীই তথাকথিত ‘হিরো’। নারীকে প্রধান করে সিনেমা তৈরির প্রবণতা অনেক শক্তিশালী অভিনেত্রীদের পর্দায় পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। বেটি ডেভিস, হানা স্কাইগুলা, ইসাবেল আদজানি, ইসাবেল হাপার্ট, জিনা রোল্যান্ডস, ক্লদিয়া কার্দিনালে, রোমি স্নেইডার, সুচিত্রা সেন, কার্মেন মরা প্রভৃতি অভিনেত্রীরা পৃথিবীর নানা প্রান্তের সিনেমায় প্রধান চরিত্র হয়ে উঠলেন। স্প্যানিশ সিনেমাশিল্পে সেই কাজটা খুব সাফল্যের সঙ্গে করেছেন মারিসা পারাদেস।
জীবন অনেক সময় আমাদের এত ছোট ছোট ব্যাপারে ব্যস্ত করে তোলে যে আমরা তার বৃহৎ, গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলি অনুভব করতে ভুলে যাই। ভুল করি। হুমা রোহো-র মনে পড়ছে, সেই বৃষ্টির সন্ধ্যায় সদ্য শো শেষ করে তিনি হলের পিছন-দরজা দিয়ে বেরিয়েছেন। তাঁকে প্রেমিকা নিনা-র খোঁজে দৌড়তে হবে। নিনার প্রতি তিনি মোহাচ্ছন্ন। একটি তরুণ সে-সময় তাঁর গাড়ির কাচে এসে দাঁড়িয়ে বারবার বলছিল, তার একটা অটোগ্রাফ চাই। সেই মুখটি আজও মনে আছে হুমার।
সেদিন সেই তরুণকে অটোগ্রাফ দিতে পারেননি থিয়েটারের জনপ্রিয় অভিনেত্রী হুমা, যিনি আজও ‘আ স্ট্রিটকার নেমড ডিজায়ার’ নাটকের ‘ব্লাঞ্চ’ চরিত্রে অভিনয় করেন অনবদ্য। এখন তিনি জানতে পেরেছেন, সেই অচেনা তরুণটির নাম ছিল ইস্তিবান। সেই তরুণ সেদিনই গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল। এই মুহূর্তে হুমার সামনে বসে তরুণটির মা ম্যানুয়েলা– যে নাকি নিনার অনুপস্থিতিতে স্টেলা চরিত্রে অভিনয় করে বার্সেলোনা শহরে সাড়া ফেলে দিয়েছে। নিনা এবং হুমা– দুজনেরই সন্দেহ, ম্যানুয়েলা এই চরিত্রে আগে অভিনয় করেছে কিংবা তার চরিত্র চুরির তীব্র ইচ্ছে ছিল।
ম্যানুয়েলা সব খুলে বলে। সত্যিই তো স্টেলা চরিত্র তার জানা। সে বহুবার যৌবনে এ-চরিত্রে অভিনয় করেছে। কিন্তু সেদিনের অভিনয় ছিল তার মৃত সন্তানের তুষ্টির জন্য। চরিত্র চুরির কোনও আকাঙ্ক্ষা তার ছিল না। যে হুমার অটোগ্রাফের জন্য ইস্তিবানকে প্রাণ দিতে হয়েছিল, সেই হুমার সঙ্গে মঞ্চ ভাগ করে নেবার তীব্র ইচ্ছা ছিল তার। হুমা আবেগঘন হয়ে পড়েন। সন্তানহারা ম্যানুয়েলার প্রতি তিনি সংবেদনশীল। হুমা তো আর মা হতে পারবেন না! তিনি বয়স্ক লেসবিয়ান। কিন্তু সেদিন হুমা গাড়ি থামাতে পারেননি কেন? কেন একবার গাড়ির কাচ নামিয়ে ইস্তিবানকে অটোগ্রাফ দিতে পারেননি? এর উত্তর আসলে পেদ্রো আলমোদোভারের ‘অল অ্যাবাউট মাই মাদার’ (১৯৯৯) ছবিতে নয়, লুকিয়ে আছে এর ৪০ বছর আগে নির্মিত ‘অল অ্যাবাউট ইভ’ ছবিতে, যেখানে বেটি ডেভিস অভিনীত মার্গো চ্যানিং চরিত্রটি তথাকথিত ‘ফ্যান’ গোষ্ঠী সম্বন্ধে বলছে যে, ফ্যান বা ভক্তেরা আসলে খ্যাঁকশিয়ালের মতো খ্যাতিমান মানুষদের পেছনে ঘুরে বেড়ানোর জন্য বিদ্যমান, তাদের কাজের, শিল্পের গুণগ্রাহিতার জন্য নয়।
হুমার জনপ্রিয়তা হুমাকে নিভৃতি দিয়েছে। তিনি ‘সেলিব্রিটি’, তাঁকে মানুষ ছুঁতে চাইবে, কিন্তু তিনি ধরা দেবেন না। হুমা রোহোর চরিত্রে অভিনয় করার জন্য পেদ্রো আলমোদোভার নির্ভুল ভাবে বেছে নিয়েছিলেন মারিসা পারাদেসকে। মারিসা পারাদেসের চাহনি, অভিনয়-ক্ষমতা এবং সর্বোপরি তাঁর পর্দায় উপস্থিতি এত অননুকরণীয় যে, হুমা চরিত্র আর কারও পক্ষে ফোটানো সম্ভব ছিল না।
শুধু কি হুমা চরিত্র? পেদ্রো আলমোদোভারেরই এই ‘অল অ্যাবাউট মাই মাদার’ (১৯৯৯)-এর আট বছর আগে নির্মিত ‘হাই হিল্স’ (১৯৯১) ছবিতে মারিসা একজন গায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন যাঁর নাম বেকি দেল পারামো। বেকি মাদ্রিদে ফিরেছেন ১৫ বছর পর। তাঁর কন্যা রেবেকা প্রখ্যাত মায়ের উদাসীনতা, ভালোবাসাহীনতা সহ্য করেছে সারাটা জীবন। কিন্তু বেকি যে শিল্পী। সংসার, বিয়ে কিংবা সন্তানপালনে হয়তো তিনি ততটা পটু নন। এতগুলো বছর পর মাদ্রিদের মঞ্চে তিনি গান গাইবেন। বেকির পরনে অলিভ-সবুজের ব্যাকলেস গাউন, দু’হাত টকটকে লাল রঙের দস্তানায় ঢাকা কনুই অবধি। কানে ঘাড় অবধি লম্বা দুল। ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক। সেই ঠোঁটে তিনি ঝুঁকে পড়ে মঞ্চকে চুম্বন করছেন আর মঞ্চে লিপস্টিকের দাগ রয়ে যাচ্ছে। বেকি গাইছেন সেই গান– ‘পিয়েনসা এন মি’ যেখানে বারবার উঠে আসছে একটি কথা যে, ‘আমার সঙ্গে জড়ালে তুমি ব্যথা পাবে!’
অন্য দৃশ্যে তাঁর মেয়ে রেবেকা কয়েদখানার বন্দি হয়ে সে-গান শুনছে রেডিওতে। বেকি মঞ্চে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। কার জন্য? তাঁর একাকী, ব্যথিত একমাত্র কন্যার জন্য। পৃথিবীর সমস্ত ব্যস্ত মায়ের চোখের জল মারিসা পারাদেসের ওই অভিনয়ে মিশে আছে, যাঁরা বহু চেষ্টা করেও সন্তানকে হয়তো বা সময় দিতে পারেন না এবং ক্রমাগত অপরাধবোধে ভোগেন; সে ইঙ্গমার বার্গম্যানের ‘অটাম সোনাটা’ ছবির শার্লট অ্যান্ডারগাস্ট (ইনগ্রিড বার্গম্যান) হোক কিংবা ঋতুপর্ণের ‘১৯শে এপ্রিল’-এ সরোজিনী গুপ্ত (অপর্ণা সেন)!
আর যদি অনেক সময়, সাহচর্য, ভালোবাসা দিয়েও ব্যর্থ হতে হয়? সেই মায়ের অভিনয়ও মারিসা অনবদ্য গড়ে তোলেন। ২০১১ সালে নির্মিত আলমোদোভারের ছবি ‘দ্য স্কিন আই লিভ ইন’-এ মারিলিয়া চরিত্রের মাধ্যমে মারিসা দেখান, কেমন বিপর্যস্ত হতে হয় একজন মাকে, যখন তিনি দেখেন তাঁর দুই পুত্র নষ্টামির দুই পর্যায়ে বিরাজ করে– বড় ছেলে রবার্ট একজন প্লাস্টিক সার্জেন, যে মেয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে নিরাপরাধ একটি ছেলেকে অন্যায় শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে একটি মেয়েতে পরিণত করছে, আর ছোট ছেলে জেল-পালানো জেকা, সেই রূপান্তরিত নারীকে অবলীলায় করছে ধর্ষণ! মারিলিয়ার অসহায়তা, মানসিক দুর্বলতার অভিব্যক্তি মারিসা ফুটিয়ে তোলেন জোরদার।
১৭ ডিসেম্বর, ৭৮ বছর বয়সে প্রখ্যাত স্প্যানিশ অভিনেত্রী মারিসা পারাদেস শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন। তাঁর ক্যারিয়ারের একটি দিক হল, শেষ বয়স অবধি তিনি অভিনয় করে গিয়েছেন। তিনি সিনেমায় অভিনয় করেছেন, টিভিতে করেছেন, মঞ্চেও তাঁর অভিনয় প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটেছে। শুধু পেদ্রো আলমোদোভারের ছবিতে নয়, গিয়েরমো দেলতোরো (দ্য ডেবিল্স ব্যাকবোন) ও রবের্তো বেনজিনির (লাইফ ইজ বিউটিফুল) মতো পরিচালকদের সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন এবং তাঁদের পুরস্কারপ্রাপ্ত বিখ্যাত ছবিগুলোতে তাঁর অনবদ্য অভিনয়ের স্মৃতি রয়ে গেছে।
………………………………………….
তাঁর অভিনীত চরিত্ররা কখনও গায়িকা, কখনও যৌনকর্মী, কখনও লেখক, কখনও অসহায় মা, কিন্তু প্রধান চরিত্র। হলিউডি সিনেমার ঢঙে বিশ্বের নানা ভাষার সিনেমায় যে এক সময় ‘হিরো-ওয়ারশিপ’ চলত তাঁর বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে সাত-আটের দশকে ক্রমাগত নারীপ্রধান ছবি করে যাওয়া সহজ কাজ ছিল না। বরং সাহসী উদ্যোগ ছিল। আর সেই সাহসে ভর করে পরবর্তীকালে জুলিয়া রবার্টস থেকে পেনেলোপি ক্রুজ এমনকী, ভারতে শ্রীদেবী-মাধুরী দীক্ষিতরা সফল হয়েছেন। ছবি তৈরি হয়েছে একজন অভিনেত্রীকে ‘হিরো’ বানিয়ে।
………………………………………….
স্প্যানিশ ছবির ইতিহাসে অভিনেত্রী হিসেবে তিনি ছিলেন তুলনাহীন এবং খুবই সম্মানীয় শিল্পী। তবে বিশ্বচলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাঁর কিছু বিশিষ্টতা অন্য জায়গায়। আমেরিকার সিনেমা প্রথম থেকেই একজন ‘হিরো’কে এই শিল্পের পরাকাষ্ঠা করে তুলেছিল। সাহিত্যের পাশাপাশি সিনেমাতেও কাহিনি একজন পুরুষকে ঘিরে আবর্তিত হত। ইউরোপের সিনেমা এসবের ব্যতিক্রম ছিল না। সেই সব সিনেমায় নারীর ভূমিকা থাকত ওই ‘হিরো’র প্রেমিকা, ‘হিরো’র স্ত্রী কিংবা ‘ভ্যাম্প’ হিসেবে। নারীই গোটা একটা চরিত্র– এমন ছবি অনেক কম তৈরি হত। কিন্তু ইউরোপের ফ্যাসবিন্ডার, আলমোদোভারদের পাশাপাশি আমেরিকার জন ওয়াটার্সরা যখন সিনেমাশিল্পে এলেন, পরের পর এমন সব সিনেমা তৈরি হতে থাকল, যেগুলিতে নারীরাই প্রধান, নারীই তথাকথিত ‘হিরো’। নারীকে প্রধান করে সিনেমা তৈরির প্রবণতা অনেক শক্তিশালী অভিনেত্রীদের পর্দায় পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। বেটি ডেভিস, হানা স্কাইগুলা, ইসাবেল আদজানি, ইসাবেল হাপার্ট, জিনা রোল্যান্ডস, ক্লদিয়া কার্দিনালে, রোমি স্নেইডার, সুচিত্রা সেন, কার্মেন মরা প্রভৃতি অভিনেত্রীরা পৃথিবীর নানা প্রান্তের সিনেমায় প্রধান চরিত্র হয়ে উঠলেন। স্প্যানিশ সিনেমাশিল্পে সেই কাজটা খুব সাফল্যের সঙ্গে করেছেন মারিসা পারাদেস।
তাঁর অভিনীত চরিত্ররা কখনও গায়িকা, কখনও যৌনকর্মী, কখনও লেখক, কখনও অসহায় মা, কিন্তু প্রধান চরিত্র। হলিউডি সিনেমার ঢঙে বিশ্বের নানা ভাষার সিনেমায় যে এক সময় ‘হিরো-ওয়ারশিপ’ চলত তাঁর বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে সাত-আটের দশকে ক্রমাগত নারীপ্রধান ছবি করে যাওয়া সহজ কাজ ছিল না। বরং সাহসী উদ্যোগ ছিল। আর সেই সাহসে ভর করে পরবর্তীকালে জুলিয়া রবার্টস থেকে পেনেলোপি ক্রুজ এমনকী, ভারতে শ্রীদেবী-মাধুরী দীক্ষিতরা সফল হয়েছেন। ছবি তৈরি হয়েছে একজন অভিনেত্রীকে ‘হিরো’ বানিয়ে। এবং বাণিজ্যিক সাফল্যও পাওয়া গিয়েছে। পুরুষদের ঘিরে নারীচরিত্রদের উপগ্রহসম গড়ে উঠতে হয়নি। কিন্তু তা বলে কি সিনেমা থেকে পুরুষতান্ত্রিকতা সম্পূর্ণ মুছে দিতে পেরেছিলেন মারিসা? হয়তো নয়। কারণ, তাঁর ‘হিরো’সুলভ ম্যানারিজম ছিল। এমনকী, এত বছরে বহু সিনেমায় অভিনয় করলেও চুলের ছাঁট তিনি কখনও পরিবর্তন করেননি। কচ্চিৎ চুলের রং বদলেছে কিন্তু ছাঁট একই রয়ে গিয়েছে! বড় ক্যানভাসে ধরা হয়েছে তাঁর মুখ। ক্যামেরা থেমে থেমে শুনেছে তাঁর গম্ভীর সংলাপ। মারিসা পারাদেসের মৃত্যু স্প্যানিশ সিনেমাতে আজ ‘অপূরণীয় ক্ষতি’ বলা যায় কি না, তা নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে, কিন্তু এ-নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই তিনি যে-ধারা তৈরি করে গেছেন চরিত্র-নির্মাণ ও অভিনয়শিল্পে, তা পৃথিবীর নানা প্রান্তের সিনেমাতে ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। সেগুলি যেন নারীবাদের একেকটি বিশিষ্ট পাঠ।
‘অল অ্যাবাউট মাই মাদার’ সিনেমার শেষ দৃশ্যে ম্যানুয়েলা দ্বিতীয়বারের জন্য বার্সেলোনাতে যখন ফিরেছে তখন সে আগের বারের মতো শূন্য নয়। আজ সে পূর্ণ– আজ তার কোলে আরেকটি ইস্তেবান, মৃত রোসার ছেলে যাকে ম্যানুয়েলা পালন করছে। ম্যানুয়েলা হুমার সঙ্গে কোনও এক মঞ্চের গ্রিনরুমে দেখা করতে আসে। হুমাকে সুন্দর, যৌবনবতী মনে হচ্ছে। হুমার আয়নায় ম্যানুয়েলার মৃত ইস্তিবানের ছবি। অনেক কথা বলার মধ্যেই মঞ্চপ্রবেশের ঘণ্টা বাজে। বহু কথা বাকি রয়ে গেল। হুমা ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দেখা হচ্ছে।’
শিল্পীর মৃত্যু নেই। অভিনেত্রী মারিসা পারাদেসও বোধ হয় আবার দেখা হওয়ার কথা আমাদের দিয়ে গেলেন।
……………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………….