বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন বর্ণের, ভিন্ন লিঙ্গের শিশুর সঙ্গে মেলামেশার মধ্যে দিয়েই একজন শিশু বড় হয়ে ওঠে। পাশের বন্ধুটির থেকে তাদের টিফিন ভাগ করে নেওয়ার মধ্যে দিয়েই শিশুটির মধ্যে তৈরি হয়, সম্প্রদায়গত বোধ। সে তো শুধু একা এই সমাজে বাস করবে না, সে অন্য মানুষদের সঙ্গেই থাকবে। এটা যদি ছোটবেলা থেকে তৈরি হয়, সেটাই আসল শিক্ষা। তার মধ্যে যদি ছোটবেলা থেকে ‘নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান। বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান’, এই ধারণাটা প্রবেশ করে, তাহলে তার মধ্যে অন্য ধর্মের মানুষদের প্রতি অসহিষ্ণুতা কম তৈরি হবে, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। যখন উত্তরপ্রদেশের আমরোহীতে, দু’জন মুসলমান শিশুকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়, টিফিনে আমিষ খাবার নেওয়ার জন্য, তখন আবার ও এই ক্যালেন্ডারটির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধ হয়।
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
গত দশ বছরে আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক বোধহয় হয়েছে, মানুষের খাদ্যাভাস নিয়ে। সেই জন্যই সবচেয়ে বেশি জরুরি, দেশের মানুষের বৈচিত্রময় খাদ্যাভাস নিয়ে কথা বলা। সেই কাজটাই কিছু মানুষ করেছেন এবার একটি ক্যালেন্ডারের মাধ্যমে।
নতুন বছরে এই ক্যালেন্ডার আমাদের ভাবনাকে উসকে দেবে। একটি শিশু যদি স্কুলের পাশাপাশি, তার বাড়িতেও এই বিষয় নিয়ে কথা বলে, তাহলে তার মনের বিকাশ হতে বাধ্য, কিন্তু সে যদি এক দেশ, এক জাতি এক খাদ্যাভাসের কথা শুনে বড় হয়, তাহলে সে অন্য ধর্মের বন্ধুদের চিনবেও না, তাদের সম্পর্কেও জানবে না। ধীরে ধীরে সেও অসহিষ্ণু হয়ে উঠবে, অন্য ধর্মের মানুষদের খাবারকে বিজাতীয় এবং সেই মানুষদের ‘অপর’ ভাবতে শিখবে। কলকাতার তিনজন মহিলা মিলে এই কাজটা করার চেষ্টা করেছেন। মিতালি বিশ্বাস, আবির নিয়োগী এবং সাগরিকা দত্তের যৌথ উদ্যোগে তৈরি এই ক্যালেন্ডার নিশ্চিত ভাবনার খোরাক দেবে।
বাঙালির রান্নাঘর নিয়ে কথা বলতে গেলে একটাই কথা বলতে হয়, এই রান্নাঘর সত্যিই বৈচিত্রের উদাহরণ। সুদূর আফগানিস্তানের হিং থেকে শুরু করে নানা মশলা সহজেই স্থান পেয়েছে এই রান্নাঘরে। রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ ছোটগল্পে এর উদাহরণ দেখা যায়। রহমতের সঙ্গে বাঙালি পরিবারের একটি ছোট্ট শিশুর পরিচয়ের নেপথ্যে যে এই খাবারের গল্পও আছে, তা কিন্তু রবীন্দ্রনাথ দেখিয়ে গেছেন।
রসগোল্লার জিআই ট্যাগ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বহু বিতর্ক হয়েছে, কিন্তু রসগোল্লার মূল উপকরণ ছানা কি বাঙালি? তথ্য বলছে, ছানা এসেছে পর্তুগিজ পাদ্রিদের থেকে। বাঙালির রান্নাঘরের অন্যতম উপকরণ আলু, কোথা থেকে এসেছে? আমরা কি জানি, পেরু থেকে এসে আলু কী করে আমাদের প্রিয় হয়ে উঠল? প্রথমে পর্তুগিজ পরে ইংরেজদের হাত ধরে আমাদের রান্নাঘরের দখল নিয়েছে আলু, তা আমরা ক’জন জানি?
দলিতদের খাবার বলে কিছু হয়, এই প্রশ্নও তোলা হয়েছে ক্যালেন্ডারের একটি মাসে। আসলে যা সহজলভ্য, তা দিয়েই খাবার বানিয়ে আসছেন দলিতরা। কিছুদিন আগে বিরসা মুন্ডার সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে বেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনে দলিত আদিবাসীদের খাবার খাওয়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে খবর হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকার নাকি আদিবাসী সম্প্রদায়ের খাবার ও সংস্কৃতিকে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যেই এবং তা সংরক্ষণের জন্যেই এই ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভেবেছিল, কিন্তু আদিবাসী ও দলিতদের খাদ্যাভাসের মধ্যে তো শুধু কিছু নির্দিষ্ট খাবার নেই, আরও অনেক কিছু আছে। কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী আমলারা কি জানেন না, গোমাংস থেকে শুকরের মাংস– সবই কিন্তু থাকে দলিত আদিবাসীদের পাতে। সেই খাবারগুলোও কি থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যান্টিনে, এই প্রশ্নও করেছিলেন, তখন আদিবাসী ও দলিত আন্দোলন নিয়ে কাজ করা মানুষেরা। এই বিরোধ মেটানোর জন্যও নতুন বছরের এই ক্যালেন্ডারটি সংগ্রহ করা উচিত।
……………………………………….
বাঙালির রান্নাঘর নিয়ে কথা বলতে গেলে একটাই কথা বলতে হয়, এই রান্নাঘর সত্যিই বৈচিত্রের উদাহরণ। সুদূর আফগানিস্তানের হিং থেকে শুরু করে নানা মশলা সহজেই স্থান পেয়েছে এই রান্নাঘরে। রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ ছোটগল্পে এর উদাহরণ দেখা যায়। রহমতের সঙ্গে বাঙালি পরিবারের একটি ছোট্ট শিশুর পরিচয়ের নেপথ্যে যে এই খাবারের গল্পও আছে, তা কিন্তু রবীন্দ্রনাথ দেখিয়ে গেছেন।
……………………………………….
একজন শিশু কতক্ষণ স্কুলে থাকে? হয়তো দিনের খুব সময়। যেটুকু সময় সে স্কুলে থাকে, ততটুকু সময়ে সে শেখে। সেই শিক্ষা কিন্তু শুধুমাত্র পুঁথিগত শিক্ষা নয়। একজন শিশু যতটা না বই থেকে শেখে, তার থেকে অনেক বেশি শেখে পারিপার্শ্ব থেকে। একসঙ্গে বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন বর্ণের, ভিন্ন লিঙ্গের শিশুর সঙ্গে মেলামেশার মধ্য দিয়েই একজন শিশু বড় হয়ে ওঠে। পাশের বন্ধুটির থেকে তাদের টিফিন ভাগ করে নেওয়ার মধ্য দিয়েই শিশুটির মধ্যে তৈরি হয়, সম্প্রদায়গত বোধ। সে তো শুধু একা এই সমাজে বাস করবে না, সে অন্য মানুষদের সঙ্গেই থাকবে। এটা যদি ছোটবেলা থেকে তৈরি হয়, সেটাই আসল শিক্ষা। তার মধ্যে যদি ছোটবেলা থেকে ‘নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান। বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান’, এই ধারণাটা প্রবেশ করে, তাহলে তার মধ্যে অন্য ধর্মের মানুষদের প্রতি অসহিষ্ণুতা কম তৈরি হবে, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। যখন উত্তরপ্রদেশের আমরোহীতে, দু’জন মুসলমান শিশুকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়, টিফিনে আমিষ খাবার নেওয়ার জন্য, তখন আবার ও এই ক্যালেন্ডারটির প্রয়োজনীয়তা বোধ হয়।
আমিষ ও নিরামিষের দ্বন্দ্বের কারণ কী, কেনই বা এক অংশের মানুষ নিরামিষ খাদ্যাভাস চাপিয়ে দিতে চাইছে, আরও এক অংশের মানুষের ওপর, সেই বিতর্কও উঠে আসবে এই ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে। আজকের সময়ে হোক বা যুগ যুগ ধরে, শিশুদের শিক্ষা কিন্তু শুধু স্কুলে হয়, এমনটা বলা যায় না। প্রতিটি শিশুর যাপনের সঙ্গে এই ধারণাটা জুড়ে দেওয়া যায়, তাহলেই অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে। এমনিতে আমাদের দেশটা ক্রমশ বদলে যাচ্ছে। কয়েক বছর ধরেই, দেশজুড়ে নানা সময়ে, ভাষাগত, খাদ্যগত এবং পোষাক সংক্রান্ত নানান বিতর্ক তৈরি হয়েছে। কার ফ্রিজে কী মাংস আছে, কে কী খাবার আনছে টিফিনে, তা নিয়ে আমাদের অনেক বেশি মাথাব্যথা আজকাল। ফ্রিজে রাখা মাংস পরীক্ষার নামে ঘরে ঢুকে দাপাদাপি করা থেকে শুরু করে, গণধোলাইতে মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে একটি বিশেষ ধর্মের মানুষদের।
বাঙালিকে নানা সময়ে, শুধুমাত্র ভাষাগত কারণে ‘বাংলাদেশি’ তকমা অবধি দেওয়া হয়েছে। পোশাক নিয়েও বহু বিতর্ক হয়েছে। একটি রাজ্যে হিজাব নিষিদ্ধ হওয়ার বিতর্ক দেশের সর্বোচ্চ আদালত অবধি গেছে। আসলে আমাদের দেশে খাবার ও সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা এবং বৈচিত্র নিয়ে বিতর্ক যেন সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো, যা শুধু খাবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।
ভারতীয় রান্নাঘর নিজেই একটা বৈচিত্রময় এবং বড় ক্যানভাস, যেখানে শুধু বহিরাগত খাবার মেশেনি, মিশেছে তার রঙ, গন্ধ এবং স্বাদ। তৈরি হয়েছে এক নতুন ব্যঞ্জন, এক নতুন সংস্কৃতি। লঙ্কা, আলু, পোস্ত, জাফরান, হিং– সবই তো বাইরের হাওয়ার সঙ্গী হয়ে আমাদের রান্নায় মিশে, আমাদের রান্নাকে করে তুলেছে বিশ্বজনীন। খাবার শুধু কি খিদে মেটায়, নাকি নিজস্ব সত্তা, সাংস্কৃতিক পরিচয়ও গড়ে তোলে– এই প্রশ্নই তুলেছে এই ক্যালেন্ডার। নানা সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের ইতিহাস ও মিশে থাকে একটি খাবারের সঙ্গে। সেই সম্প্রদায়ের একটি বহমান ঐতিহ্য হয়ে ওঠে, তাঁদের খাদ্যাভাস। সেই ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতেই এই ক্যালেন্ডার তাই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। মূলত তিনজনের উদ্যোগে এই ক্যালেন্ডার আমাদের কাছে পৌঁছলেও, বিশেষ করে বলতে হয়, এই ক্যালেন্ডারের ছবি যাঁরা একেছেন, তাঁদের কথা। জিৎ নট্ট, সিদ্ধেশ গৌতম, শিবাঙ্গী সিং এবং অন্যান্যদের সহায়তায় এই ক্যালেন্ডার হয়ে উঠেছে একটি অবশ্য সংগ্রহণযোগ্য বস্তু।
………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………