মেডিক্লেম পরিষেবার জন্যে তার ফি লাফিয়ে বাড়ছে প্রতি বছর, অন্যদিকে যদি এই প্রত্যাখ্যানের পরিমাণ প্রায় ৫০ শতাংশ ছুঁয়ে ফেলে, মধ্যবিত্ত একেবারে বিপদের প্রান্তসীমায় পৌঁছে যাবে! করদাতা হয়েও সে রেশন ব্যবস্থা, সরকারি হাসপাতাল থেকে বঞ্চিত। চিকিৎসার ব্যয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ার পর সে তার সঞ্চয় বা উপার্জন থেকেই প্রতিবছর নির্দিষ্ট হারে টাকা দেয়। কিন্তু নানা ছুতোয় তাকে ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করলে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রির দিকে যেতে হয়।
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
আমি কেন, আমাদের প্রজন্মের অনেকেই সরকারি হাসপাতালের জন্মে ছিল। অবশ্যই কুকুর বিড়ালের বিচরণ ক্ষেত্র বা থিকথিকে ভিড়ওয়ালা এক বিছানায় চার রোগী শোওয়ার হাসপাতাল ছিল না। আরেকটু বড় হয়ে গলায় মাছের কাঁটা বিঁধে যাওয়া বা সর্দি-কাশি-জ্বরের জন্যেও আমরা হাসপাতালে গেছি। অসুস্থ হলে সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির সামনের নার্সিংহোম নয়, বাড়িতেই বড় বড় ডাক্তাররা ‘কল’ নিয়ে দেখতে আসতেন। খুব একটা বেহাল অবস্থা না হলে চিকিৎসা বাড়িতে থেকেই চলত। বাড়ি বলতে তখন মোটামুটি সব একান্নবর্তী পরিবার। ফলে ওষুধের সঙ্গে পথ্য দেওয়ার লোকের অভাব হত না। ডাক্তারের ভিজিট আর ওষুধ ছাড়া টাকার বিষয়ও নেই।
আরোগ্য নিকেতনের জীবনমশাইয়ের সঙ্গে তৎকালীন নবীন অ্যালোপাথের যে সংঘাত, তা ছিল দুই চিকিৎসা পদ্ধতির। এক সময় অন্তর্জলী যাত্রায় কলকাতার তাবড় ধনীদের স্বেচ্ছায় গঙ্গার ঘাটে যাওয়ার কাহিনি শুনেছি, পড়েছি আমরা। আসন্ন মৃত্যুকে বরণ করার জন্য ছিল নানা সমারোহের প্রয়াণ-পরিকল্পনা। পরবর্তী প্রজন্মের, আমাদের মনে হয়েছিল এ এক জান্তব নিষ্ঠুরতা, যেখানে প্রাণী জগতের মতো নির্দয় মৃত্যু প্রতীক্ষা থাকে। কিন্তু আমরা ডারউইনকে স্বীকার করেও যখন মানবতার হাত ধরেছিলাম– খাদের কিনারায় থাকা মানুষটিকে জান লড়িয়ে টেনে আনলাম, সর্বাপেক্ষা দুর্বল সন্তানটিকে প্রকৃতির সম্ভাব্য নিষ্ঠুর পরিণতির হাতে ছেড়ে না দিয়ে আগলে রাখলাম দু’-হাতে, তখন হয়তো অগোচরে প্রকৃতির বিরোধিতাই করলাম।
তবে মানুষ তো সেই কবেই প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে গেছে। রাজা যযাতির পুত্র পুরু তার পিতার বার্ধক্য গ্রহণ করে নিজের যৌবন দান করেছে। এই সময়েও তরুণী বা তরুণ, প্রৌঢ় পিতামাতা নিকটাত্মীয়কে নিজের জরুরি অঙ্গ দান করে নিজের জীবন বিপন্ন করে রেখেছে। মানুষের এই কল্যাণবুদ্ধি এবং নিজের ক্ষণিকের জীবনকে সুস্থতা দান ও অনন্তের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে নিরন্তর প্রয়াস অব্যাহত। প্রকৃতিকে চ্যালেঞ্জ করেই চিকিৎসা জগতের নিত্যনতুন আবিষ্কার মানুষের জীবৎকাল বৃদ্ধি শুধু নয়, শারীরিক বদল ঘটিয়ে ফেলছে। যাকে একসময় বলা হত– খোদার ওপর খোদকারি, তাই তো মানুষকে পকেট ভারী থাকলেই শারীরিক দর্শনে অন্য মানুষ করে তুলছে। আর এর সঙ্গেই অবধারিত যুক্ত হয়েছে বাজারের চাহিদা যোগানের অর্থনীতি।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক সব পরিবর্তন মানুষকে প্রতিনিয়ত উত্তেজিত করছে, হাতছানি দিচ্ছে, কিন্তু যাকে বলে ‘পকেট ফ্রেন্ডলি’– তা হচ্ছে না। বিদেশে ছেলেমেয়ের কাছে বেড়াতে বা তাকে সাহায্য করতে যাওয়া মা-বাপের চিকিৎসা প্রবল ব্যয়সাধ্য হওয়ায় প্রায়শই তাঁদের দেশে এনে চিকিৎসা করানো হচ্ছে, দেখতে পাই। মোদ্দা কথা, সব এখন প্যাকেজ। যে আমরা প্রায় বিনামূল্যে সরকারি হাসপাতালে জন্মেছি, খানিক চিকিৎসা পেয়েছি, ইদানীং সেই আমরাই বেসরকারি চিকিৎসার বহরে নাভিশ্বাস ফেলছি! চিকিৎসা যত উন্নত হয়েছে, তত ব্যয়বহুল হয়েছে। মৃত্যুর সম্ভাব্য বিচ্ছেদ-আঘাতের চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে নার্সিংহোমের মহার্ঘ্য বিল বিষয়ে রোগীর পরিবারের আতঙ্ক। যে পরিমাণে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটেছে সরকারের তরফে স্বল্পমূল্যের বা বিনামূল্যের হাসপাতাল তৈরি হয়নি। ফল হয়েছে এই, দারিদ্র্য-সীমার নিচে বা দরিদ্র মানুষরা চলে গেছে এই সরকারি হাসপাতালের দিকে আর প্রায় বাধ্যতায় মধ্যবিত্ত ,উচ্চ মধ্যবিত্ত বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানে পরিচ্ছন্নতা ও পরিষেবার নামে তেমন কোনও সরকারি নজরদারি নেই। যত দেখনদরি, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির চমক, তত মালকড়ি গুণে চিকিৎসা চলে।
আমরা অধিকাংশ মানুষ, নিজের বিষয়ের বাইরে অন্য বিষয়গুলির প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করি না। ফলে সাধু ডাক্তারের পাশে অসাধুর আবির্ভাব হতে দেরি হয় না। ক্রমবর্ধমান ব্যয়বহুল চিকিৎসার পাশে দাঁড়াবার জন্যই দীর্ঘদিন ধরেই মেডিক্লেম কোম্পানিগুলো আছে, প্রথম দিকে ছিল একেবারেই সরকারি কোম্পানি। হালে সরকারি কোম্পানিগুলিও চলে গেছে প্রায় বেসরকারি হাতে। অর্থাৎ, সরকারি কোম্পানি টাকা দেবে, কিন্তু সেটি প্রকৃত অর্থে খরচ হয়েছে কি না সেটা দেখভাল করবার জন্য আছে বেসরকারি এজেন্সি।
………………………………………………
চিকিৎসা যত উন্নত হয়েছে, তত ব্যয়বহুল হয়েছে। মৃত্যুর সম্ভাব্য বিচ্ছেদ-আঘাতের চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে নার্সিংহোমের মহার্ঘ্য বিল বিষয়ে রোগীর পরিবারের আতঙ্ক। যে পরিমাণে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটেছে সরকারের তরফে স্বল্পমূল্যের বা বিনামূল্যের হাসপাতাল তৈরি হয়নি। ফল হয়েছে এই, দারিদ্র্য-সীমার নিচে বা দরিদ্র মানুষরা চলে গেছে এই সরকারি হাসপাতালের দিকে আর প্রায় বাধ্যতায় মধ্যবিত্ত ,উচ্চ মধ্যবিত্ত বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানে পরিচ্ছন্নতা ও পরিষেবার নামে তেমন কোনও সরকারি নজরদারি নেই। যত দেখনদরি, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির চমক, তত মালকড়ি গুণে চিকিৎসা চলে।
………………………………………………
প্রাক্ পর্বে মেডিক্লেম কোম্পানিগুলির এক ধরনের স্বচ্ছতা ছিল। মানুষও ততটা অসৎ হয়নি, যেমনটা কিছুদিন আগে আমরা দেখলাম, জনগণের ভোটে জিতে আসা এক নাট্যকর্মী জনপ্রতিনিধি তাঁর সন্তান হওয়ার জন্য লক্ষাধিক টাকার বিল পাঠিয়েছে! সদর্পে দাবি করছেন, এই টাকাটা তাঁরা পেতেই পারেন। জনগণের করের টাকায় লাখ টাকার স্যুট দেখার পর থেকে অবশ্য এই নির্লজ্জ প্রকাশ্য উক্তিতে আমরা আর বিস্মিত হই না। কবি শঙ্খ ঘোষের মুখেই প্রায় শোনা, তাঁর চিকিৎসা বিমা বিষয়ে কোম্পানির এজেন্টদের প্রশ্নের সামনে তিনি বিমা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। হয়তো নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় এবং প্রমাণ দেওয়ার কাগজপত্র দেওয়াটার ভিতরে যে সূক্ষ্ম অপমান থাকে, তা স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর স্বভাবে আঘাত করেছিল।
এ তো গেল এক চরমপন্থা, অন্যদিকে দেখি বহুসংখ্যকের ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে মিথ্যা বিল দেওয়ার ঘটনা। হয়তো খানিকটা মানুষের সততার প্রশ্নেই মেডিক্লেম কোম্পানিগুলি সাধারণ মানুষকে চোর ভাবতে শুরু করেছে। এটা সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, গত কয়েক বছরে বহু সংখ্যক মেডিক্লেম প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। খুব অল্প সংখ্যক মানুষ বলেছেন, তাদের সেটেলমেন্ট ঠিক সময়ে যথাযথ ভাবে হয়েছে। এ কিন্তু এক অশনি সংকেত।
একদিকে মেডিক্লেম পরিষেবার জন্যে তার ফি লাফিয়ে বাড়ছে প্রতি বছর, অন্যদিকে যদি এই প্রত্যাখ্যানের পরিমাণ প্রায় ৫০ শতাংশ ছুঁয়ে ফেলে, মধ্যবিত্ত একেবারে বিপদের প্রান্তসীমায় পৌঁছে যাবে! করদাতা হয়েও সে রেশন ব্যবস্থা, সরকারি হাসপাতাল থেকে বঞ্চিত। চিকিৎসার ব্যয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ার পর সে তার সঞ্চয় বা উপার্জন থেকেই প্রতিবছর নির্দিষ্ট হারে টাকা দেয়। কিন্তু নানা ছুতোয় তাকে ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করলে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রির দিকে যেতে হয়।
এখনও ঠিক বোঝা যাচ্ছে না ইনসিওরেন্স কোম্পানির পক্ষ থেকে, বিশেষ করে চিকিৎসা বিষয়ে এই পদক্ষেপ কেন নিচ্ছে তারা। হয়তো এও এক বাজার-ধরার খেলা। মানুষের কাছে প্রথমে একটা সহজ ও আকর্ষণীয় প্যাকেজ তুলে ধরা, অভ্যস্ত হলে দাম বাড়ানো এবং তাতে তার আস্থা তৈরি হলে ধীরে ধীরে সেখানে অস্থিরতা তৈরি করা। মানুষ এবার তার সীমাবদ্ধ ক্ষমতা নিয়ে ছটফট করবে, হয়তো আরও মহার্ঘ্য হবে মেডিক্লেম। আরও অর্থ উপার্জনের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে মেডিক্লেম উপভোক্তাদের!
…………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………….