এখন আর লাইন অবধি দিতে হয় না দোকানে, দুয়ারে মদ। কিছু সংস্থা ঘরে বোতল পৌঁছে দিচ্ছে যত্ন সহকারে। পাড়ায় বা মদের দোকানে কে দেখল, কিছু এসে যায় না– কারণ কেউ কিছু দেখতেই পায় না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বেয়ারাকে ফোয়ারা চালাতে হয় না, বাড়ির কর্তা তাই জানে স্ত্রী পোর্ট ওয়াইন খেতে ভালোবাসে, ব্রিজারে অ্যালকোহল পরিমাণ কম আর সুস্বাদু তাই সদ্য সাবালক সন্তানকে খাওয়ানোই যায়। তাই বর্ষশেষ হোক বা বর্ষ শুরু, ইংরেজি বা বাংলা, ঘরে বসেই এখন ফায়ার স্টিকে সিনেমা দেখতে দেখতে পরিবারের সবাই মিলে মৌতাত করা যায়– গিন্নি কাদা চিংড়ির বড়া আর স্যালাড রাখে সামনে আর পোর্ট ওয়াইনে চুমুক দেয়, কর্তা হুইস্কিতে আর সন্তান ব্রিজারে।
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
সে এক সময় ছিল যখন মাতালদের একটা আত্মশ্লাঘা থাকত, যা তারা খুব যত্নে প্রতিপালন করত। মানিকতলার কেলো রোজ বিকেলে খালপাড়ের রতনজি-বোমানজি’র বাংলা মদের ঠেকে গিয়ে দুই গ্লাস বাংলা খেয়ে এক গ্লাস নিজের মাথায় ঢেলে নিত– যাতে ফেরার পথে লোকে বুঝতে পারে কেলো ‘খেয়ে’ রয়েছে। তাই কেলো যখন পিতৃবিয়োগের পর ১৫ দিনের মাথায় এক সন্ধেয় স্বর্গত বাবার বিছানা নোংরা করল আর তার দাদা সেই নিয়ে চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুললে উত্তর দিয়েছিল, ‘বাবার একটা খাট আর আমরা দুই ভাই, আমি আমার অংশে হেগেছি, তাতে তোর কী!’, পাড়ার লোকেরা ওর দাদাকে ‘মদের খেয়ালে করেছে, ও কি আর সুস্থ আছে!’ বলে বুঝিয়ে বাড়ি ফেরত পাঠিয়েছিল।
লিলুয়া রেলকলোনির রামরাজু যে তেলুগু নয়, আদ্যন্ত বাঙালি– তার বুড়ো সাধুর প্রতি দুর্বলতার জন্য ‘রামরাজু’ বলে সম্বোধিত হত, এটা না জেনে রেলকলোনিতে ট্রান্সফার হয়ে আসা এক তেলুগু প্রতিবেশী যখন ওর সঙ্গে মাতৃভাষায় কথা বলতে শুরু করেছিল, রামরাজু পালিয়ে গেলেও ওর বিস্তর গর্ব হয়েছিল! অনেককে এই অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছিল সে। গঞ্জিকা সেবনের পরে চোখের সামনে ক্যালাইডোস্কোপের ডিজাইন থামানোর জন্য কালনার রিকশাচালক পূর্ণকাকু নিদান দিয়েছিল– বিষে বিষে বিষক্ষয়ের জন্য বাংলা মদ খেতে, পূর্ণকাকুর বউ বাদে বাকিরা তার বুদ্ধির বাহবা দিয়েছিল।
ছেলে-ছোকরাদের পাড়ার দোকান কনডোম কেনা আর পাড়ার মদের দোকান থেকে বোতল কেনা একই রকম দুরূহ ব্যাপার ছিল– কে কখন দেখে ফেলবে আর সেই নিয়ে দীর্ঘশ্বাস মিশ্রিত আলোচনা হবে, এই ভয়ে দূরের কোনও দোকান থেকে বোতল কিনতে হত। মেট্রোরেল উত্তর আর দক্ষিণ কলকাতার মধ্যে সেতুবন্ধন করার আগে অন্য প্রান্তে যাওয়াটা বেশ চাপের ব্যাপার ছিল– তার ওপর উত্তর কলকাতায় মদের দোকান ছিল হাতে-গোনা, তাই প্রত্যেকটার ভৌগোলিক অবস্থান নিয়ে পরিষ্কার ধারণা ছিল। ফুলবাগান শিশু হাসপাতাল, রাজাবাজার মোড়, মানিকতলা ছায়া সিনেমা, খান্না মোড়ে বিধুশ্রী সিনেমা, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ আর গ্রে স্ট্রিটের মোড়– এই পাঁচটা জায়গার আলাদা গুরুত্ব ছিল মধ্যবিত্ত মাতালদের কাছে। গোটা সল্টলেকে এই মার্কেটে একটা দোকান। যশোর রোডে মাইকেলনগরের কাছে জ্ঞানীর ধাবায় বাইরে থেকে বোতল নিয়ে এসে সুরাপান করা যেত বলে অনেকে সেখানে পৌঁছে যেত, কিন্তু স্টক শেষ হয়ে গেলে হয় নাগেরবাজার নয়তো বারাসত-চাপাডালির মোড় অবধি দৌড়তে হত বোতলের সন্ধানে। তাই শহরের বিভিন্ন জায়গায় ছিল ‘এটিএম’- এনি টাইম মদের দোকান। চালতাবাগানে ভুতো, শ্যামবাজার মোড়ে ব্যাটারি– এরা ছিল অসময়ের বন্ধু। বউবাজার ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া মোড় থেকে সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার যেতে রাস্তার পাশে এক মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে মধ্যরাতেও ‘ভগবান’ বলে ডেকে থমকে দাঁড়ালে একজন উদয় হয়ে জিজ্ঞেস করত কী চাই, আর দশ টাকা বেশি নিয়ে বোতল দিয়ে দিত। পুরোটা নগদে কারবার। তাই প্রথম যখন থিয়েটার রোড– ক্যামাক স্ট্রিট মোড়ে ক্রেডিট কার্ডে বোতল কেনা গেল, শহরের সুরাপ্রেমীদের মধ্যে আলোড়ন পড়ে গেল! গাড়ি থামিয়ে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে বোতল কেনার মধ্যে শহুরে মাতালদের এক দাম্ভিকতা প্রকাশের জায়গা হয়ে দাঁড়াল– আর লুকিয়ে নয়, বোতল কৌলীন্য-প্রাপ্ত হয়েছে।
……………………………
বউবাজার ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া মোড় থেকে সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার যেতে রাস্তার পাশে এক মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে মধ্যরাতেও ‘ভগবান’ বলে ডেকে থমকে দাঁড়ালে একজন উদয় হয়ে জিজ্ঞেস করত কী চাই, আর দশ টাকা বেশি নিয়ে বোতল দিয়ে দিত। পুরোটা নগদে কারবার। তাই প্রথম যখন থিয়েটার রোড– ক্যামাক স্ট্রিট মোড়ে ক্রেডিট কার্ডে বোতল কেনা গেল, শহরের সুরাপ্রেমীদের মধ্যে আলোড়ন পড়ে গেল!
……………………………
বোতলের কৌলীন্যপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে আধা-মাতালদের প্রমোশন হল সেমি-মাতালে। ধারে মদ কেনা যেত না, মদ কিনতে নগদ পয়সা দরকার ছিল আগে। এক বোতল রাম বা হুইস্কি কেনার সংকল্প নিয়ে মদের দোকানে লাইন দিয়ে শেষ মুহূর্তে বিবেক নামক বেইমানের কানমলা খেয়ে বা সংসারের কোনও প্রয়োজনের কথা শেষ মুহূর্তে মনে পড়ে হাফ বোতল কিনে বাড়ি ফেরা হাফ-মাতাল মানুষের সংখ্যা ছিল বেশি। আর তার সঙ্গে ছিল এক কমিউন মনোভাব। দোস্ত-ইয়ারদের মজলিশে এক রকমই পানীয় থাকত, ফল স্বরূপ পসন্দ্ আপনা আপনা হওয়ার সুযোগ ছিল না। নিজের বউকে ফেলে পরস্ত্রীর সঙ্গে সহবাসের অব্যহিত পরে মধ্যবিত্তের যেমন একটা পাপবোধ হয়, মদের খোঁয়ারি কাটলে ঠিক সেরকমই এক পাপবোধ হত! সেই বিবেক বেইমান মনে পড়াত ঠিক ক’টা একশো টাকার নোট আগের সন্ধেতে মদের দোকানে দেওয়া হয়েছে। প্লাস্টিক মানি’র দৌলতে বিবেক দন্তহীন হয়ে গেল– ধুর শালা, পয়সা তো এখন দিতে হচ্ছে না! ক্রেডিট কার্ড অনেকে ব্যবহার করতো না বলে যারা বেঁচে গিয়েছিল, মদের দোকান যবে থেকে ডেবিট কার্ড নেওয়া শুরু করল, আধা-মাতালরা সেমি-মাতাল থেকে পুরো মাতালে প্রোমোশন পেয়ে গেল, কারণ ইতিমধ্যে প্রায় সবার মাইনে সরাসরি ব্যাঙ্কে পৌঁছে যায়, আর কোম্পানি সবাইকে ডেবিট কার্ড ধরিয়ে দিয়েছে মাইনে তোলার জন্য নিজেদের অফিসে মাইনে দেওয়ার ঝক্কি এড়াতে। টাকা বড় বিষম বস্তু, তার চেয়েও গোলমেলে অনুশোচনা। আর কোনও জায়গাই রইল না এসবের, কার্ড সোয়াইপ করো আর বোতল হাতে নাও, পসন্দ আপনা আপনা। এরপর সময় এল যখন আবার কার্ডও লাগে না, সঙ্গে ফোন থাকলেই হল, স্ক্যান করো– গুগুল পে, ফোন পে। হোটেলের সহকর্মী জয় চ্যাটার্জির মদের প্রতি আসক্তি জেনে এক ঘরোয়া পার্টিতে ম্যানেজার মিসেস মোহন স্নেহভরে জয়কে ‘পে লে জে, পে লে’ বলে হুইস্কি খাওয়াতে দেখে খুব হেসেছিলাম, এখন ভাবি মিসেস মোহন কি ত্রিকালদর্শী ছিল?
পরিশিষ্ট: এখন আর লাইন অবধি দিতে হয় না দোকানে, দুয়ারে মদ। কিছু সংস্থা ঘরে বোতল পৌঁছে দিচ্ছে যত্ন সহকারে। পাড়ায় বা মদের দোকানে কে দেখল, কিছু এসে যায় না– কারণ কেউ কিছু দেখতেই পায় না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বেয়ারাকে ফোয়ারা চালাতে হয় না, বাড়ির কর্তা তাই জানে স্ত্রী পোর্ট ওয়াইন খেতে ভালোবাসে, ব্রিজারে অ্যালকোহল পরিমাণ কম আর সুস্বাদু তাই সদ্য সাবালক সন্তানকে খাওয়ানোই যায়। তাই বর্ষশেষ হোক বা বর্ষ শুরু, ইংরেজি বা বাংলা, ঘরে বসেই এখন ফায়ার স্টিকে সিনেমা দেখতে দেখতে সপরিবার মিলে মৌতাত করা যায়– গিন্নি কাদা চিংড়ির বড়া আর স্যালাড রাখে সামনে আর পোর্ট ওয়াইনে চুমুক দেয়, কর্তা হুইস্কিতে আর সন্তান ব্রিজারে। বন্ধুরা এলে ‘চা-কফি না হার্ড’ জিজ্ঞাসা করাই দস্তুর এখন। কেলো এখন বার-কোড স্ক্যান করে বাংলা মদ কেনে, মাথায় ঢেলে মদ নষ্ট করে না। বাঙালি স্মার্ট হয়েছে।
…………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………..