শুরু হল ‘অভিযান পাবলিশার্স’-এর সঙ্গে প্রথম বই বের করার প্রস্তুতি। আমার উদ্ভট উদ্ভট বুদ্ধিতে জেরবার প্রকাশক, তার থেকেও বেশি সমস্যায় পড়লেন যাঁরা বইটার লেআউট তৈরি করবেন। কারণ খুব সহজ, আমি কোনও কিছু করতে গেলেই চেষ্টা করি অন্য পথে ভাবতে। আর যারা গতানুগতিক কাজ করতে অভ্যস্ত, তারা থতমত খেতে থাকেন। সময় খরচ হয় বেশি। ট্রায়াল আর এরর-এর খেলা চলতে থাকে। সাদা কাগজে ছাপা তো সব বই-ই হয়, আমার বই ছাপা হবে অন্য রঙের কাগজে। শুরু হল সেই কাগজের খোঁজ, অতঃপর হালকা নীল রঙের কাগজে ছাপা হল ‘প্রাপ্তমনস্কদের জন্য’, আমার দ্বিতীয় বই।
হঠাৎ মনে পড়ল– আমি যে বইটাকে আমার প্রথম বই ভাবতাম, সেটা আসলে আমার দ্বিতীয় বই। এটা মনে পড়তেই অনেক হিসেব গোলমাল হয়ে গেল। প্রথম বইটাকে ভুলে যাওয়ার কারণ বোধহয়, বইটার ছাপার সংখ্যার জন্যও হতে পারে। সংখ্যাতত্ত্বে আসার আগে প্রথমের জায়গায় দ্বিতীয় আর দ্বিতীয়র জায়গায় প্রথম হলে কী কী বদলাতে পারে, তাই ভাবছিলাম।
হঠাৎ যদি জানতে পারা যায় যে এডমন্ড হিলারি আর তেনজিং নোরগে এভারেস্টের চূড়োয় ওঠা প্রথম মনুষ রা নন, তার আগে অন্য কেউ একজন এভারেস্টের টঙে উঠে বসেছিলেন, অথবা যদি জানতে পারা যায় বর্ণপরিচয় প্রথম বর্ণ পরিচিতি দেয়নি বাঙালিকে, কেউ তার আগেই ছেপেছিলেন বাংলা অক্ষর-পরিচিতির প্রথম পুঁথিটি, তাহলে কি সাংঘাতিক ঐতিহাসিক ভুল হয়ে যেতে পারে? জ্যোতিবাবুর প্রধানমন্ত্রী না হওয়ার থেকেও বেশি না কম– এ ভাবনা ছেড়ে দিলাম পাঠকদের ওপর। আমার ভাবনার সীমাবদ্ধতার জন্য ছাড়লাম তা ঠিক নয়, ভাবতে রসদ দিলাম পাঠককে। আমি বুদ্ধিজীবী নই, ভাবনাজীবী। ভাবতে ও ভাবাতে ভালো লাগে। শুরু হোক ‘ভাবা প্র্যাকটিস’।
কিন্তু আমার প্রথম এবং দ্বিতীয়র এই গন্ডগোলে আমার জীবন বা আমার লেখক জীবন বা পৃথিবীর সমস্ত বইয়ের ইতিহাসের সামান্যতম ফারাক হওয়ার কোনও চান্স নেই, অতি তুচ্ছ সে কারণ।
আমার প্রথম বইটার ঘটা করে উদ্বোধন করা হয়েছিল আজ থেকে বছর পঁচিশেক আগে, মহাজাতি সদনের এক জাঁকজমকিয়া এক অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানের দিন ঠিক হয়েছিল আগে, বইটা রিলিজ করার কথা হয় পরে। কিন্তু পাবলিশার ভদ্রলোক ওই অল্প সময়ে আমার বইটার দুটো ডামি কেবল করাতে পেরেছিলেন। লোক দেখানোর জন্য। আর তারপর প্রথম সংস্করণে যতগুলো ছাপার কথা ছিল, তার একটাও আর হয়ে ওঠেনি। তার আগেই সদ্য হওয়া সেই পাবলিশারের বাল্ব তৈরির ব্যবসা উঠে গেছিল। ফলে আমার প্রথম কবিতার বইয়ের আর দুটোর বেশি কপি হয়নি।
……………………………
গীতিকার ও কবি কিংশুক চট্টোপাধ্যায় নিজের জীবন সামলাতে না পেরে অকালে চলে গেল। কিন্তু ও আমার গান ও লেখার এতটাই ভক্ত ছিল যে, ও আমাকে গোছাতে চেষ্টা করত। ওর চাপেই আমার ‘লাল মাটির সরাণে’ অ্যালবামটা প্রোডিউস করা। কিংশুক কোথা থেকে ধরে আনল মারুফকে। সে নাকি আমার বই প্রকাশ করতে চায়, তখন সে নবীন প্রকাশক, বইমেলাতে একটা ছোট্ট স্টল পাওয়ার চেষ্টা করছে সাংঘাতিক ভাবে। ওর মনে হয়েছিল শিলাজিতের একটা বই বের করতে পারলে ওর ভাল হয়।
…………………………..
বইটার নাম ছিল ‘ছোবল’, এর প্রচ্ছদ হয়েছিল আমারই একটা উদ্ভট আঁকা ছবি থেকে। শিল্পী দেবনাথ বিশ্বাসকে বলেছিলাম প্রচ্ছদ করতে, সে আমার পুরনো ছবির খাতা থেকে একটা ছবি দেখে বলেছিল, এটাই হোক প্রচ্ছদ। হোক দুটো মোটে কপি– তবুও তো সেটা ‘বই’ বলতে বাধা নেই। ডিলান জেঠুকে ঝাড়িয়া বলিলাম, “How many books must a publisher print before you call it a book” ক’টা বই আর কত কপি ছাপা হয়? সেই হিসেবে আমার প্রথম ভাবা বই ‘প্রাপ্তমনস্কদের জন্য’ আদতে আমার দ্বিতীয় বই।
এ বইটাও যে পাবলিশ করা হবে আমি কোনও দিন ভাবিনি, ইনফ্যাক্ট কোনও বই লেখার ভাবনা আমার মাথাতে ছিলও না। টুকটাক দৈনিক পত্রপত্রিকা বা ম্যাগাজিনে লেখার অনুরোধ আসত, লিখতাম কিন্তু বই বের করব ভাবিনি। একটা আস্ত বই, সেটা কীভাবে বের করতে হয় কোনও ধারণাও ছিল না। বাবার একটা কবিতার বই দেখেছিলাম। তাতে আরও দু’-তিনজন কবির কবিতা ছিল। শুনেছিলাম ওঁরা নিজেরাই খরচা করে বইটা বের করেছিলেন, তার ক’টা কপি বিক্রি হয়েছিল জানি না। কিন্তু একটা কপি আমার বড়মামার বড় ছেলে, আমাদের বড়দার সংগ্রহে এখনও সযত্নে রাখা আছে, ওই একটাই কপি।
গীতিকার ও কবি কিংশুক চট্টোপাধ্যায় নিজের জীবন সামলাতে না পেরে অকালে চলে গেল। কিন্তু ও আমার গান ও লেখার এতটাই ভক্ত ছিল যে, ও আমাকে গোছাতে চেষ্টা করত। ওর চাপই আমার ‘লাল মাটির সরাণে’ অ্যালবামটা প্রোডিউস করা। কিংশুক কোথা থেকে ধরে আনল মারুফকে। সে নাকি আমার বই প্রকাশ করতে চায়, তখন সে নবীন প্রকাশক, বইমেলাতে একটা ছোট্ট স্টল পাওয়ার চেষ্টা করছে। ওর মনে হয়েছিল শিলাজিতের একটা বই বের করতে পারলে ওর ভাল হয়। শুরু হল ‘অভিযান পাবলিশার্স’-এর সঙ্গে প্রথম বই বের করার প্রস্তুতি। আমার উদ্ভট উদ্ভট বুদ্ধিতে জেরবার প্রকাশক, তার থেকেও বেশি সমস্যায় পড়লেন যাঁরা বইটার লেআউট তৈরি করবেন। কারণ খুব সহজ, আমি কোনও কিছু করতে গেলেই চেষ্টা করি অন্য পথে ভাবতে। আর যারা গতানুগতিক কাজ করতে অভ্যস্ত, তারা থতমত খেতে থাকেন। সময় খরচ হয় বেশি। ফন্ট টাইপ, ফন্ট সাইজ নিয়ে নানা এক্সপেরিমেন্ট, ট্রায়াল আর এরর-এর খেলা চলতে থাকে। সাদা কাগজে ছাপা তো সব বই-ই হয়, আমার বই ছাপা হবে অন্য রঙের কাগজে। শুরু হল সেই কাগজের খোঁজ, অতঃপর হালকা নীল রঙের কাগজে ছাপা হল ‘প্রাপ্তমনস্কদের জন্য’, আমার দ্বিতীয় বই। নীল রং শুধু রূপমের প্রিয় নয়, আমার প্রথম বইয়ের পাতাও নীল।
সাল মনে নেই, সেবারের বইমেলা শুরু হওয়ার আগের রাতে অভিযানের স্টল তৈরির সময় হাজির হয়ে গেলাম, মনে পড়ে যাচ্ছিল ছোটবেলার সরস্বতী পুজোর আগের রাতগুলো, নিজেরাই নিজেদের প্যান্ডেল তৈরি করার উত্তেজনা।
‘অভিযান পাবলিশার্স’ এখন বইমেলায় স্টলের সাইজ বাড়িয়েছে, থাকে থাকে নানা কবির, নানা সাহিত্যিকের, গবেষকদের বইয়ের পর বই। অনেকগুলো বইমেলা পেরিয়ে গেল, যাওয়া হয় না। আমি জানি না কেউ খোঁজ করলে ওদের স্টলের কোনও কোণায় ‘প্রাপ্তমনস্কদের জন্য’ উঁকি মারবে কি না।
কিন্তু আমার কাছে আমার শেলফে আমার দ্বিতীয় বইটারও কোনও কপি নেই।