ভূতের গল্প বাঙালি আগেও পড়েছে। কিন্তু যতীন্দ্র সেন সেই ভূতের গল্পের ভূতগুলিকে কাগজ-তুলিতে নিয়ে এলেন কিছুটা স্যাটায়ার মিশিয়েই। প্রথমবার বাঙালি তার আপাত-চেনা ভূতগুলিকে চাক্ষুষ করল ভূশুণ্ডির মাঠে। সম্প্রতি শান্তিনিকেতনে ‘আর্টশিলা’ গ্যালারিতে প্রখ্যাত শিল্প গবেষক কে. এস. রাধাকৃষ্ণন একান্ত উৎসাহে ও নিবিড় গবেষণায় যতীন্দ্রকুমার সেন-কে নিয়ে এক প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। কিন্তু কেন যতীন্দ্রকুমার সেন? এর উত্তর প্রদর্শনীর মুখবন্ধেই কে. এস. রাধাকৃষ্ণন জানিয়েছেন– যেভাবে রাজশেখর বসু বাঙালি পাঠকের মনে প্রায় একশো বছর পরেও উজ্বল। অথচ যতীন্দ্র সেন কিছুটা বিস্মৃত।
‘পেনেটির আড়পাড় কোন্নগর। সেখান হইতে উত্তরমুখ হইয়া ক্রমে, রিশড়া, শ্রীরামপুর, বৈদ্যবাটীর হাট, চাপদানির চটকল ছাড়াইয়া আরও দু-তিন ক্রোশ দূরে ভূশুণ্ডির মাঠে পৌছিল।’ রাজশেখর বসু-র লেখা ‘ভূশুণ্ডির মাঠ’ ১৯২৩ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই বাঙালি পাঠক ট্রেনে করে হাওড়া থেকে চন্দননগর যাওয়ার পথে জানালায় চোখ রেখেছে, সন্ধান করেছে সেই ভূশুণ্ডির মাঠের, যেখানে নানা রকমের ভূতের দেখা মেলে। বাঙালির একান্ত চেনা ভূত, যেমন শাঁকচুন্নি, কিংবা পেত্নি, প্রচ্ছদ ও অলংকরণে প্রথম দেখা গেল এই বইয়েই। যাঁর আঁকায় আমাদের ভূত পরিচিতি, তাঁর নাম যতীন্দ্রকুমার সেন।
ভূতের গল্প বাঙালি আগেও পড়েছে। কিন্তু যতীন্দ্র সেন সেই ভূতের গল্পের ভূতগুলিকে কাগজ-তুলিতে নিয়ে এলেন কিছুটা স্যাটায়ার মিশিয়েই। প্রথমবার বাঙালি তার আপাত-চেনা ভূতগুলিকে চাক্ষুষ করল ভূশুণ্ডির মাঠে। বইয়ের পাতার শাঁকচুন্নি, পেত্নি, ডাকিনি-কে রূপ দিলেন যতীন্দ্র সেন– পেত্নির লজ্জায় জিভ কাটা, অথবা শাঁকচুন্নির গোবর জল ছড়ানো।
সম্প্রতি শান্তিনিকেতনে ‘আর্টশিলা’ গ্যালারিতে যতীন্দ্রকুমার সেন-কে নিয়ে শুরু হয়েছে এক বিশেষ প্রদর্শনী। প্রখ্যাত শিল্পী ও শিল্প গবেষক কে. এস. রাধাকৃষ্ণন একান্ত উৎসাহে ও নিবিড় গবেষণায় যতীন্দ্র সেনের অনেক ছবি নিয়ে এই প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। কিন্তু কেন যতীন্দ্রকুমার সেন? এর উত্তর এই প্রদর্শনীর মুখবন্ধেই কে. এস. রাধাকৃষ্ণন জানিয়েছেন– যেভাবে রাজশেখর বসু বাঙালি পাঠকের মনে প্রায় একশো বছর পরেও উজ্বল। অথচ যতীন্দ্র সেন কিছুটা বিস্মৃত। বাঙালির সামনে নতুনভাবে যতীন্দ্রকুমার সেনকে নিয়ে আসার প্রয়োজন ছিল অবশ্যই। যেভাবে রাজশেখর বসুর স্যাটায়ার তাঁর লেখায় উঠে এসেছিল, তার প্রকৃত রস যতীন সেন ছবিতে তুলে ধরতে পেরেছিলেন, যা এক অনবদ্য যুগলবন্দি হিসেবেই দেখা উচিত। রাধাকৃষ্ণন তাঁর বন্ধু পরিমল রায়ের কাছ থেকে যতীন্দ্র সেনের অনেক ছবি, যেমন ‘গড্ডালিকা’, ‘কজ্জলী’, ‘হনুমানে স্বপ্ন’, ‘ভূশুণ্ডির মাঠে’ ইত্যাদি সংগ্রহ করেছেন, আর তা-ই তুলে ধরেছেন এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে।
যতীন্দ্রকুমার সেনের জন্ম ১৮৮২ সাল নাগাদ, চন্দননগরে। প্রথাগত ছবি আকার বিদ্যে তাঁর ছিল না, তবে ছিল এক গভীর দৃষ্টি আর রসবোধ, যা তাঁকে শিল্পের কাছে এনে দিয়েছিল। দাদার সঙ্গে কলকাতায় চলে আসেন খুব ছোট বয়সে, তারপর নিজেকে নিযুক্ত রেখেছিলেন নানাবিধ শিক্ষায়। একদা রাজশেখর বসু ও যতীন সেন একসঙ্গে ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’ কোম্পানিতে চাকরি করতেন। যতীন সেন বেঙ্গল কেমিক্যালের বিজ্ঞাপনের ছবি আঁকতেন। এই নিয়েই শুরু হয় দু’জনের বন্ধুত্ব এবং তারপর রাজশেখর বসু যা লিখেছেন, প্রায় তাঁর সবই ছবি এঁকেছেন যতীন সেন। রাজশেখর বসু একটা স্কেচ করে দিতেন, সেই স্কেচের ওপর প্রাণ দিতেন যতীন সেন। অনেকেই যতীন সেনকে ‘বাংলার প্রথম কার্টুনিস্ট’ হিসেবে মনে করেন। এছাড়াও নানাবিধ পত্রপত্রিকা থেকে শুরু করে বিজ্ঞাপনের ছবি সবেতেই তাঁর দক্ষতা সমান।
আমাদের দেশে প্রচ্ছদশিল্পী বা অলংকরণ শিল্পের ইতিহাস সঠিকভাবে সংরক্ষিত নয়। আমরা যতটা চিত্রশিল্পীদের গুরুত্ব দিয়েছি, ততটা হয়তো অলংকরণ শিল্পীদের জন্য ভাবিনি। অথচ তাঁদের আঁকাতেই গল্পের চরিত্ররা আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সময়ের প্রতিনিধি হিসেবে। আমরা ক’জনই বা জানি এইসব শিল্পীদের কথা, যাঁদের আঁকায় উঠে এসেছিল একসময়ের বাংলার চরিত্ররা। যতীন্দ্র কুমার সেন এরকমই একটা নাম।
বাঙালির ইতিহাস ভুলে যাওয়ার ইতিহাস। সেখানে শিল্পের ইতিহাসও অনেকটাই বিস্মৃত। আমদের পরম পাওনা আর্টশিলা ও রাধাকৃষ্ণন আমাদের সামনে খুঁজে নিয়ে এসেছে আমাদেরই একান্ত চেনা, অথচ বিস্মৃত এক শিল্পীর শিল্পকলা, যা আজও বাঙালির মনে জায়গা নিয়ে আছে। আমরা ছবিগুলো চিনতাম, কিন্তু শিল্পীর নাম মনে রাখিনি কেউ। রাধাকৃষ্ণন ও আর্টশিলাকে ধন্যবাদ যতীন্দ্রকুমার সেনের ছবিগুলিকে একত্রিত করে নিয়ে আসার জন্য এবং সেগুলিকে বই আকারে প্রকাশ করার জন্য।