মাংস কেনার টাকা ছিল না, তাই কাম্পানিয়ার মানুষ আধ ইঞ্চিটাক মোটা রুটি বেলে তার ওপরে টমেটো সস ছড়িয়ে দিয়ে চিজ, টমেটো, অলিভ, মাশরুম, রসুন টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে সেটা ওভেনে ঢুকিয়ে বেক করত। বাংলাদেশের ইউসুফ মিয়াঁ এক পেল্লায় চাটুতে তেল ছড়িয়ে মাখা আটা আধ ইঞ্চির চেয়েও বেশি পুরু করে পুরো চাটুতে ছড়িয়ে দিয়ে সেঁকে খেতে দিল! দেখতে একেবারে এক ফালি পিৎজার মতো, তফাত শুধু একটাই, ওপরে কিছু ছড়ানো নেই, তার বদলি হিসাবে ভর্তা।
ফোন করলেই প্যাকেট-পোশাক পরে যে সটান বাড়িতে চলে আসে, এবার একটু সেই পিৎজা-র গল্পে আসা যাক। আজকের পিৎজা-র উল্লেখ ১২০০ বছর আগের ইতালিতে পাওয়া গেলেও এর জন্ম আরও অনেক আগেই। পিৎজা চিরকালই ছিল সাধারণ মানুষের খাবার– আড়াই হাজার বছর আগের পারস্য বা মিশরে সেনাবাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে রুটির ওপরে চিজ আর খেজুর ছড়িয়ে যেটা খেত, সেটা আজকের পিৎজা ছাড়া কিছুই নয়; কিন্তু আজকের পিৎজার জন্ম দক্ষিণ ইতালির নিওপলিতান অঞ্চলের কাম্পানিয়াতে, যেখানকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি একেবারেই অনুকূল ছিল না। রুটির সঙ্গে মাংস কেনার সামর্থ্য কম মানুষেরই ছিল, কিন্তু মনে আনন্দের অভাব ছিল না মানুষগুলোর। নিজেদের মতো করে ভালো থাকা কাম্পানিয়ার মানুষ তাই আধ ইঞ্চিটাক মোটা রুটি বেলে তার ওপরে টমেটো সস ছড়িয়ে দিয়ে চিজ, টমেটো, অলিভ, মাশরুম, রসুন টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে সেটা ওভেনে ঢুকিয়ে বেক করত। এই রুটি হত স্বয়ংসম্পূর্ণ– এতই সুস্বাদু যে, এটাই হয়ে উঠত মেন কোর্স, বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই আনন্দের সঙ্গে খেত এই রুটি। এই পিৎজা এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠল যে, ১৮৮৯-এ রাজা উম্বার্তো আর রানি মার্গারিতা ভোজনবিলাসীদের স্বর্গরাজ্য প্যারিসের কেতাদুরস্ত খাবারে আর স্বাদে বীতশ্রদ্ধ হয়ে দেশে ফিরে পিৎজা খেয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন।
১০০ বছর আগেও পিৎজা কিন্তু ইতালীয়দের ঘরেই সীমাবদ্ধ ছিল। এমনকী, যে মার্কিন দেশে ইতালীয়রা যুদ্ধের ১৫০ বছর আগে থেকে বসবাস শুরু করেছে, সেই দেশেও সাধারণ মানুষ ইতালীয়দের এই প্রিয় খাবারের কথা জানত না– কারণ সেই দেশে পৌঁছনো বাকি দেশগুলোর সামনে ইতালির অবস্থা ছিল অনুষ্ঠানবাড়িতে বড়লোক আত্মীয়দের ভিড়ে মধ্যবিত্তের মতো। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পটচিত্র বদলে গেল– বড়লোক আত্মীয়দের ভাঁড়ারে টান পড়তে তারাও চাকরির খোঁজে বেরিয়ে ফ্যাক্টরির দরজায় ভিড় করল– আর সেই সঙ্গে পিৎজা ইতালীয় রান্নাঘরে আটকে না থেকে উপস্থিত হল মার্কিন দেশের খাবার টেবিলে– সাধারণ প্লেটে নয়, কাঠের প্লেটে চড়ে। মার্কিন দেশে আমাদের ভারতীয় খাবারও রীতিমতো জনপ্রিয় আর উত্তাপাম বেশ পছন্দের খাবারের মধ্যে পড়ে। পিৎজার বৈমাত্রেয় ভাই আমাদের দেশের উত্তাপাম (পিৎজা আটা দিয়ে তৈরি আর উত্তাপম চালের গুড়ো দিয়ে) দক্ষিণ ভারতের দোসার চেয়ে প্রায় ৫০০ বছর বড়। আগের সপ্তাহে বলা আপ্পামের নাম থেকেই উত্তাপামের নাম– আর সেখানেও রুটির ওপরে বিভিন্ন সবজি ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের টাঙ্গাইল শহরে গিয়েছিলাম পোড়া চমচমের লোভে। কিন্তু সেখানে গিয়েও সুস্মিতা বায়না ধরল তার দাদাকে আগে অন্য জিনিস খাওয়ানোর ইচ্ছে– তারপরে নাহয় মিষ্টিমুখ। তার সঙ্গে চললাম টাঙ্গাইলের ডিসট্রিক্ট রোডে। কোর্টের অদূরে রাস্তার পাশে এক ঝুপড়িতে ইউসুফ মিয়াঁর দোকানে আমাকে নিয়ে পৌঁছল এক নতুন খাবারের সঙ্গে পরিচয় করাতে। চাপটি। এক গামলা জলে কলাইয়ের ডাল বাটা, চাল বাটা, পেঁয়াজ কুচি, লঙ্কা কুচি, ধনেপাতা, নুন আর হলুদ বেশ খানিকক্ষণ ধরে যত্ন নিয়ে মেশাল আর তারপরে তাতে দুই কিলোর চেয়েও বেশি আটা ঢেলে দিয়ে মাখতে লাগল। যখন মাখা হয়ে গিয়েছে, সেটা কাপড়ে ঢেকে প্রায় দুশো গ্রাম লঙ্কা একটা কৌটোয় ঢেলে লম্বা খুন্তি দিয়ে সেগুলো কৌটোর মধ্যে পিষছিল ইউসুফ মিয়াঁর ছেলে এক কোণে বসে। কলকাতায় যেমন চাটুতে রোল বানায়, ওইরকম এক পেল্লায় চাটুতে তেল ছড়িয়ে মাখা আটা আধ ইঞ্চির চেয়েও বেশি পুরু করে পুরো চাটুতে ছড়িয়ে দিয়ে সেঁকতে লাগল। বেশ খানিক দুই পিঠ সেঁকার পরে যে বিশাল রুটিটা উনুন থেকে নামল, তার ওজন তিন থেকে চার কিলোর মাঝামাঝি। সেটা এক কাঠের পাটায় ফেলে ফালি করে কেটে প্লেটে রেখে ধরিয়ে দিল হাতে। তার সঙ্গে আলুর ভর্তা, আর পেঁয়াজ-লঙ্কা দিয়ে তৈরি একটা ভর্তা। দেখতে একেবারে এক ফালি পিৎজার মতো, তফাত শুধু একটাই, ওপরে কিছু ছড়ানো নেই, তার বদলি হিসাবে ভর্তা। অনবদ্য স্বাদের চাপটি, দুর্দান্ত ঝাল লঙ্কার ভর্তা আর ব্যালেন্সিং ফ্যাক্টর আলুর ভর্তার ত্র্যহস্পর্শে আমেজে চোখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। খানিক বাদে চোখ খুলে আশপাশটা দেখার চেষ্টা করলাম, মানে ইউসুফ মিয়াঁর বাকি খদ্দেরদের। রিকশাওয়ালা থেকে কোর্টের মুহুরি– কে নেই সেখানে!
ইউসুফ মিয়াঁকে দেখলাম কাগজে বেশ কিছু প্যাকিং করে চলেছে সমানে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘উকিলবাবুরা আসেন না?’ জিভ কেটে ইউসুফ উত্তর দিল ‘কী যে কন কত্তা! ওঁরা ভদ্দরলোক না! ওরা এখানে আসে না, ঘরে নিয়ে গিয়ে খায়!’ বুঝলাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পিৎজা নিজেদের যেখানে কুঁড়েঘর বানিয়ে ফেলেছে বিশ্বজুড়ে, আমাদের বাংলার পিৎজা ‘সাব-অল্টার্ন’ ছাপ থেকে এখনও বেরতে পারেনি।
এ ব্যাপারে লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তর্ক করেছিলেন। ১৯১০-এ লক্ষ্মীনাথের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাঁহী’ পত্রিকা। এই পত্রিকায় লক্ষ্মীনাথ অসমিয়া ভাষা-সংস্কৃতির নিজত্বকে যুক্তিনিষ্ঠভাবে প্রকাশ করেছিলেন।