ভাঙার গান বইটির শ্রেষ্ঠ রচনা নিঃসন্দেহে তার নাম-কবিতাটি। বইটিকে ছাপিয়ে গিয়ে এ কবিতা যে কোনও আটক ও বিপন্ন মানুষের নিজস্ব আশ্রয় হয়ে উঠেছে। এ আর কেবল নজরুলের নয়, এ আমাদের নিজেদের কথা, নিজেদের গান। ‘বন্দীশালা’ শব্দটির সঙ্গ অপ্রতিরোধ্য ভাবে এখন জুড়ে গেছে ‘আগুন জ্বালা’ এবং ‘ভাঙ্ রে তালা’। ‘বন্দীশালা’ শুনলেই এই দু’টি ক্রিয়ার দিকে ধাবিত হয় মন। উপলক্ষটিকে ছাপিয়ে এ গান সব পীড়িতের সম্পদ হয়ে গেছে এতদিনে। কেবল স্থাবর স্থাণু পাষাণ কারা নয়, এমনকী, চিন্তারাজ্যের কারাগারের জন্যও ভাঙার গান প্রাসঙ্গিক।
১৯২৪-এর আগস্ট মাস। কিছুদিন আগেই তাঁর একটি বই নিষিদ্ধ করেছে ব্রিটিশ সরকার– যুগবাণী– ফজলুল হকের মালিকানাধীন সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ-এ প্রকাশিত সম্পাদকীয় রচনাগুলির নির্বাচিত সংকলন ছিল সেটি। মুজফ্ফর আহ্মদ এবং নজরুল ছিলেন সেই পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক। যুগবাণী নিষিদ্ধ হওয়ার অল্পদিন পরেই এক মাসেই– আগস্ট ১৯২৪ সালের আগস্ট মাসে পরপর প্রকাশিত হয় নজরুলের দু’টি কবিতার বই– বেশ কয়েকটি গানও ছিল সেই বই দু’টিতে। প্রথমটি বিষের বাঁশী আর তার কয়েক দিন বাদে ভাঙার গান। ‘বাঁশি’ আর ‘গান’– এই দুই শব্দের সুবাদে বোঝাই যায়, গানের প্রসঙ্গটি নজরুলের ভাবনায় ছিল বেশ পাকাপাকি ভাবে। সেই জোড়া সুরের একটির ওপর থেকে সরকারি নিষেধাজ্ঞা কখনওই ওঠেনি– স্বাধীনতার পরে, ১৯৪৯ সালে একবার ছাপা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তারপরে এই বাংলায় অন্তত গোটা বই আকারে আর ছাপা হয়নি সে বই। এই মাত্র ক’দিন আগে ব্ল্যাকলেটার্স প্রকাশন সংস্থা নতুন করে ছেপেছেন কাজী নজরুল ইসলামের ভাঙার গান। একশো বছর পেরিয়ে, একশো বছর ছাপিয়ে নতুন করে প্রকাশিত এ বইটির কালো মলাটের উপর রুপোলি হরফে লেখা নাম ঝলমল করছে। বন্ধু শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায় সাজিয়ে তুলেছেন এ বইয়ের অবয়ব, প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছেন এবং উত্তরকথন লিখেছেন, ভারি যত্নে আদরে নতুন করে তাকে সামনে এনেছেন অর্ক দেব– নজরুল গবেষণায় উদ্যমী তরুণ তিনি। এঁরা দু’জনেই আজ আমাদের সকলের কৃতজ্ঞতার পাত্র।
ভাঙার গান-এর প্রকাশক কে ছিলেন, জানা যাচ্ছে না ঠিকই, কেননা এ বইয়ের প্রথম সংস্করণটি পাওয়া যায়নি। ন্যাশনাল বুক এজেন্সির ১৯৪৯ সালের সংস্করণটিই তাই মূল ধরে নেওয়া হয়। তবে অনুমান করা যায়, আগের বই বিষের বাঁশীর মতো এটিও সম্ভবত নজরুল নিজেই প্রকাশ করেছিলেন। প্রথম সংস্করণটির প্রচ্ছদের যে ছবি আমরা দেখেছি, তাতে স্বাভাবিক ভাবেই প্রকাশকের নাম নেই, কিন্তু স্ট্যাম্পের ছাপ দেওয়া আছে– ‘প্রাপ্তিস্থান: ডি এম লাইব্রেরি, ৬১ নং কর্ণওয়ালীশ স্ট্রীট, কলিকাতা।’ নিচে লেখা, দাম ১০ আনা। সেটিই যে প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ, তা বোঝা যাচ্ছে কী করে? বইটি ডি এম লাইব্রেরির আপিসে সংগ্রহ করা যাবে– এই ছাপই প্রমাণ করে কোনও নির্দিষ্ট প্রকাশনা-সংস্থা ছিল না এ বইয়ের নেপথ্যে। আমাদের দেখা প্রচ্ছদটিই যে সেই হারানো প্রথম সংস্করণের তার প্রমাণ কী? তার পরোক্ষ প্রমাণ হচ্ছে ওই দামের কথাটুকু। ন্যাশনাল বুক এজেন্সির ওই পূর্বোক্ত দ্বিতীয় মুদ্রণে বইটির দাম ছিল এক টাকা। সেখানে প্রকাশকের কথায় উল্লেখ ছিল স্পষ্ট, নিষিদ্ধ হওয়ার পরে এ বইয়ের আর কোনও সংস্করণ হয়নি। এবং সেই দ্বিতীয় মুদ্রণের দাম ধার্য হয়েছিল ষোলো আনা, মানে এক টাকা। অতএব, প্রচ্ছদে দশ আনা দামের উল্লেখ-ওয়ালা বইটিই ভাঙার গান-এর প্রথম সংস্করণ।
আক্ষেপের কথা এই যে, সেই প্রথম মুদ্রণটি অনুসরণ করেই ন্যাশনাল বুক এজেন্সি তাঁদের সংস্করণটি প্রস্তুত করলেও, তার পূর্ণাঙ্গ পরিচয় তাঁরা দেননি। ফলে ঠিক করে আমাদের জানাই হল না, প্রকাশক নজরুলই ছিলেন, নাকি অন্য কেউ। জানা হল না, নজরুল নিজে প্রকাশ করলেও– ঠিক আগের বই বিষের বাঁশী-র ক্ষেত্রে যেমন একটি ছোট ভূমিকা লিখেছিলেন তিনি এখানেও তেমন কিছু ছিল কি না। আমাদের অনুমান, ছিল না তেমন কিছু, প্রকাশকের নামটিও হয়তো অনুল্লেখিতই ছিল। তার কারণ সম্ভবত লুকিয়ে আছে আগের বইটির মুখবন্ধে। বিষের বাঁশী-র সেই ‘কৈফিয়ৎ’-এ তিনি জানিয়েছিলেন, নিজে প্রকাশ করলেও ঔপন্যাসিক সনৎকুমার সেন, কল্লোল-সম্পাদক দীনেশরঞ্জন দাশ, ‘পরম শ্রদ্ধেয় বন্ধু’ নূর লাইব্রেরির মইনুদ্দিন হোসায়ন, ডি এম লাইব্রেরির গোকুলদা– এঁরা সবাই মিলেই তাঁর বইটিকে ঘনিয়ে তুলতে সাহায্য করেছেন প্রভূত। সেই লেখাতেই বিস্তারিত ভাবে লিখেছেন তিনি, অগ্নিবীণার দ্বিতীয় পর্ব হিসেবে বিজ্ঞাপন দিলেও শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত বদলে ভিন্ন নামে বেরচ্ছে এই বই, জানিয়েছিলেন, ‘আইন রূপী আয়ান ঘোষ’ বাঁশ উচিয়ে আছে বলে বাঁশিতে ‘বিদ্রোহ’ নামক রাধার নাম আপাতত না তোলাই ভালো, সেই কারণেই, জানিয়েছিলেন তিনি, ইচ্ছে থাকলেও কয়েকটি গান ও কবিতা এখানে রাখা যায়নি। ভাঙার গান-এর মোট ১১টি রচনার বেশির ভাগই সম্ভবত সেই কয়েকটি গান ও কবিতা। এ বইয়ের একটি গান বা কবিতাও বিষের বাঁশী প্রকাশিত হওয়ার পরে লেখা নয়– সবগুলিই আগের রচনা। সেগুলিকে অনায়াসেই বিষের বাঁশী-র অন্তর্ভুক্ত করা যেত। এদের মধ্যে সরাসরি গান হিসেবে চিহ্নিত ছয়টি লেখা। গান নয়, কিন্তু গানের ইশারা আছে এমন লেখা তিনটি (‘আশু প্রয়াণ গীতি’, ‘ল্যাবেণ্ডিশ বাহিনীর বিজাতীয় সঙ্গীত’, ‘সুপার জেলের বন্দনা’), আর কবিতা দু’টি মাত্র (‘দুঃশাসনের রক্ত পান’ এবং ‘শহিদী ঈদ’)। এর সবগুলিই লেখা হয়ে গিয়েছিল ১৯২১-এর নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে ১৯২৪-এর জুলাই মাসের মধ্যেই। আর বিষের বাঁশী প্রকাশিত হয় ১৯২৪-এর আগস্ট-এ। একই মাসে কয়েক দিনের ব্যবধানে মাত্র ১১টি রচনা সম্বলিত একটি পৃথক বই-এর দরকার হল কেন তাঁর? নজরুল কি আগেই আশঙ্কা করছিলেন নিষিদ্ধ হতে পারে এই বই? তাই প্রকাশক না খুঁজে নিজেই ছেপেছিলেন? কিন্তু মজার কথা হল, যে বিষের বাঁশী-কে তিনি আইন-রূপী আয়ান ঘোষের হাত থেকে বাঁচাতে তৎপর ছিলেন, সেই বইও কিন্তু বাঁচল না। পরপর দুই মাসে– অক্টোবর ও নভেম্বর ১৯২৪-এ নিষিদ্ধ হল দু’টি বই-ই। ভাঙার গান সম্ভবত আঘাত প্রত্যাশা করেই প্রকাশিত হয়েছিল– বন্দিশালা উপড়ে ফেলার কথা, তালা ভেঙে আগুন লাগানোর ডাক যে বইয়ের গোড়ায়, শাসক তাকে নিষেধ না করে থাকে কী করে? বিষের বাঁশী সম্পর্কে যে ভয়ানক বিপ্লব সম্ভাবনায় আঁতকে উঠে শাসকের তোষামুদে দালাল-পক্ষ রিপোর্ট দিয়েছিল এ বই এক্ষুনি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা উচিত,ভাঙার গান সম্পর্কেও সেই কথা প্রযোজ্য বইকি।
বেঙ্গল লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক অক্ষয়কুমার দত্তগুপ্ত পাবলিক ইন্সট্রাকশন বিভাগকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, ‘বিষের বাঁশি’র মাধ্যমে কবি তাঁর বিপ্লবী অনুভূতি প্রকাশ করেছেন, বিদ্রোহে উসকে দিচ্ছেন তরুণদের, প্ররোচনা দিচ্ছেন আইন অমান্য করতে। চিঠিতেই তিনি অনুরোধ করেন, অপরাধ তদন্ত শাখার স্পেশাল ব্রাঞ্চ যেন এই প্রকাশনাটির দিকে নজর দেয়। স্পেশাল ব্রাঞ্চের স্পেশাল নজর যথারীতি পড়ে এবং ১৯২৪-এর ২২ অক্টোবর গেজেট ঘোষণা মারফত ‘বিষের বাঁশি’ নিষিদ্ধ হয়। অক্ষয়বাবু ঠিক এইরকম কোনও চিঠি ভাঙার গান সম্পর্কে লিখেছিলেন কি না, জানা নেই, কিন্তু তাঁর অভিযোগ ভাঙার গান-এর ক্ষেত্রেও সত্য। আইন অমান্যে এবং ব্যাপক অর্থে বিদ্রোহে তরুণদের উসকে দেওয়াই তো উদ্দেশ্য ছিল তাঁর। এই কথাটিই প্রশংসার আকারে লিখেছিল প্রবাসী পত্রিকা– ‘কবিতাগুলি যেন আগ্নেয়গিরি, প্লাবন ও ঝড়ে প্রচণ্ড রুদ্ররূপ ধরিয়া বিদ্রোহী কবির মর্মজ্বালা প্রকটিত করিয়াছে। জাতির এই দুর্দিনে মুমূর্ষু নিপীড়িত দেশবাসীকে মৃত্যুঞ্জয়ী নবীন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করিবে।’ আবারও বলতে চাই, এই সমস্ত কথাই ভাঙার গান-এর ক্ষেত্রেও একই ভাবে প্রযোজ্য। ভাঙার গান আসলে বিষের বাঁশী-র ছিন্ন উত্তর ভাগ, তার অপরার্ধ। বিষের বাঁশী-র প্রচ্ছদে যে সর্পবেষ্টিত কিশোরের ছবি ছিল, যার দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল দূরের সূর্যের দিকে, ভাঙার গানে আসলে তারই সংগীত ধরা আছে।
ব্ল্যাকলেটার্স প্রকাশিত এই শতবার্ষিক সংস্করণে ১১টি রচনার প্রতিটির সম্পর্কেই খুঁটিনাটি তথ্য সংকলন করে দেওয়া হয়েছে– কবে লেখা হয়েছে, পত্রিকা প্রকাশের কাল, গানে সুরারোপ করেছেন কে, গেয়েছেন কারা– সে-সবই এক সঙ্গে পাওয়া যাবে বইয়ের শেষে। সেই তথ্যাবলি অনুসরণ করলে সহজেই বোঝা যাবে, অধিকাংশ লেখাই সমকালীন কোনও রাজনৈতিক ঘটনা-আশ্রিত। মাদারিপুরের শান্তি-সেনা বাহিনীর অধ্যক্ষ পূর্ণচন্দ্র দাসের কারামুক্তি উপলক্ষে রচিত ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’, ১৯২১-এর প্রিন্স অফ ওয়েলস্-এর ভারত-আগমনকে কেন্দ্র করে ডাকা হরতালের মিছিলে গাইতে হবে বলে লেখা গান ‘জাগরণী’, হুগলি জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় অত্যাচারী সুপারের আচরণের প্রতিবাদে লেখা প্যারডি-সংগীত ‘সুপার (জেলের) বন্দনা’, তারকেশ্বরের মোহন্ত সতীশ গিরির নানা অপকর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সত্যাগ্রহ আন্দোলন মনে রেখে লেখা ‘মোহান্তের মোহ-অন্তের গান’ কিংবা তাঁর প্রিয় নেতা চিত্তরঞ্জনের কারাবাস মাথায় রেখে লেখা এ বইয়ের নাম-কবিতা ‘ভাঙার গান’-এর কথা সকলেই জানেন। তিনটি লেখা– ‘মিলন গান’, ‘ঝোড়ো গান’ আর ‘দুঃশাসনের রক্ত-পান’ কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ঘটনার কথা সরাসরি ছুঁয়ে না থাকলেও, সেগুলিও যে সমকালেরই প্রতিক্রিয়া, তাতে কোনও সন্দেহ থাকার কথা নয়। যেমন, মিলন গান লেখাটি। ঠিক কবে এটি লেখা, তা জানা যাচ্ছে না ঠিকই, তবে মনে রাখতে হবে হিন্দু-মুসলমানের মিলনের কথাই এই শ্লেষাত্মক লেখাটির বিষয়। আগস্ট মাসে সরাসরি বইতেই এটি প্রথম প্রকাশিত। আমাদের মনে পড়ে যাবে, মাস তিনেক আগে, ২৪ এপ্রিল তাঁর বিবাহ হয়েছে আশালতার (পরে প্রমীলা) সঙ্গে। সেই বিবাহকে কেন্দ্র করে বেশ একটু শোরগোল পড়েছিল বাংলায়। বিয়ের আগে এবং পরে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালিখিও হয়েছিল। হিন্দু-মুসলমান উভয়পক্ষই নিজ নিজ তরিকায় আপত্তি জানিয়েছিল সেদিন। এমনকী, সরলা দেবীর মতো প্রতিবাদী এবং আলোকপ্রাপ্ত মানুষও মেনে নিতে পারেননি।
প্রমীলার ধর্ম পরিবর্তনে আপত্তি ছিল নজরুলের। অথচ তা না করলে বিবাহে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে, কেননা হিন্দু বিবাহ রীতি এক্ষেত্রে চলবে না, প্রমীলার বয়স কম হওয়ায় বিশেষ আইন অনুসরণ করা যাবে না, ইসলামী বিবাহ রীতির একটি ফাঁক বের করে অবশেষে বন্ধুরা তাঁর বিয়ের বন্দোবস্ত করেছিলেন। নিজের পরিচিত-অপরিচিত মানুষজন, যাঁদের অনেকের ওপরেই ভরসা করা যেত, তাঁদের আচরণ নিঃসন্দেহে আহত করে ছিল নজরুলকে। এপ্রিল মাসেই তিনি পারিবারিক সূত্রে প্রাপ্ত ধর্ম-পরিচয়ের কারণে বহরমপুরের বন্ধু নলিনাক্ষ সান্যালের বিবাহ অনুষ্ঠান থেকে এক প্রকার বিতাড়িত হয়ে ফিরে আসেন। এই অবস্থায় বিয়ের পরে পরে থাকার জায়গা পাচ্ছিলেন না নবদম্পতি। ধর্মের কারণেই ভাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না ঘর। শেষ অবধি হুগলিতে এক কংগ্রেসকর্মী খগেন ঘোষের বাড়িতে তিনি কিছুদিন আশ্রয় পেয়েছিলেন। সেটি মে মাসের প্রথম সপ্তাহ। ভাঙার গান বইতে সংকলিত ‘মিলন গান’ লেখাটি এই পরিস্থিতিতে লেখা হয়ে থাকা অসম্ভব নয়। এ লেখার একেবারে শেষে নজরুল লিখেছেন,
তোরা করলি কেবল অহরহ নীচ কলহের গরল পান।
আজ বুঝ্লি নে হায় নাড়ি-ছেঁড়া মায়ের পেটের ভায়ের টান॥
ভাঙার গান-এর শেষ লেখাটি, ‘শহিদী ঈদ’, ঢাকার বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত নজরুল রচনাবলির জন্মশতবর্ষ সংস্করণের সাক্ষ্য অনুযায়ী, সেটি ছাপা হয়েছিল সাপ্তাহিক মোহম্মদী পত্রিকায়, এই বইতে ঈষৎ বেমানান। অন্য লেখাগুলি যে অর্থে তীব্র শাসক বিরোধী, শাসকের অত্যাচারের বিরুদ্ধে শ্লেষে বিদ্রুপে ঝকমকে, এ লেখাটি ঠিক তেমন নয়। এই কবিতায় নজরুল কোরবানির সময় পশুহত্যার বীভৎসতা নিয়ে কিছুটা কাতর, ইসলাম ধর্মের যথার্থ মর্যাদা রাখার তাগিদেই যেন এই আপত্তি তুলছেন নজরুল। জানাচ্ছেন, ইব্রাহিমের মতো সত্যিকারের প্রিয় জিনিস কি তুমি বলি দিতে পারছ আজ, নাকি কেবলই এক উৎসব হয়ে থাকছে এই কার্যক্রম? তার সঙ্গে জুড়ে দেন পরাধীন দেশের বেদনার প্রসঙ্গটিকেও। লেখেন,
যতদিন তোরা নিজেরা মেষ,
ভীরু দুর্বল অধীন দেশ,–
আল্লার রাহে ততটা দিন
দিওনাক পশু কোরবানী,
বিফল হবে রে সবখানি!
(তুই) পশু চেয়ে যে রে অধ্ম হীন!
আমাদের মনে পড়বে, অগ্নিবীণা বইতে সংকলিত হয়েছিল এমনই একটি কবিতা– ‘কোরবানী’। সবুজ পত্র পত্রিকায় শ্রাবণ ১৩২৭ সংখ্যায় ‘তরিকুল আলম’ ছদ্মনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট আলিমুদ্দিন আহমেদ। ‘আজ ঈদ’ নামক সেই লেখায় কোরবানিকে একটি বর্বর প্রথা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। নজরুল তারই প্রতিবাদে লিখেছিলেন ‘কোরবানী’। পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল পরের মাসেই। উদ্ধত, ছিটকে পড়া বিদ্যুৎ ছিল সেখানে। সাম্রাজ্যবাদী শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে হিংস্র শক্তিমত্তার প্রয়োজনীয়তা কী, সেই কবিতায় বারবার উঠে এসেছিল। কেন কোরবানিতে আত্মত্যাগের, আত্মাহুতির ইঙ্গিত পাচ্ছে না ভীরুরা, তা নিয়ে কটাক্ষও ছিল সেখানে। বছর তিনেক বাদে সেই নজরুলই লিখছেন শফিদী ঈদ। এইখানে তাঁর স্বর অনেক আলাদা। মজার কথা, শহিদী ঈদ ছেপেছিল সাপ্তাহিক মোহম্মদী। আর কোরবানি ছাপা হয় মোসলেম ভারত-এ। দু’টিই তথাকথিত ‘মুসলমান-ঘেঁষা’ পত্রিকা। ভাঙার গান বইতে এ কবিতাকে জায়গা দিয়ে নজরুল কি কোরবানি সম্পর্কিত পুরাতন কোনও সংস্কার ভাঙার ইশারা দিতে চাইছিলেন আসলে?
ভাঙার গান বইটির শ্রেষ্ঠ রচনা নিঃসন্দেহে তার নাম-কবিতাটি। বইটিকে ছাপিয়ে গিয়ে এ কবিতা যে কোনও আটক ও বিপন্ন মানুষের নিজস্ব আশ্রয় হয়ে উঠেছে। এ আর কেবল নজরুলের নয়, এ আমাদের নিজেদের কথা, নিজেদের গান। ‘বন্দীশালা’ শব্দটির সঙ্গ অপ্রতিরোধ্য ভাবে এখন জুড়ে গেছে ‘আগুন জ্বালা’ এবং ‘ভাঙ্ রে তালা’। ‘বন্দীশালা’ শুনলেই এই দু’টি ক্রিয়ার দিকে ধাবিত হয় মন। উপলক্ষটিকে ছাপিয়ে এ গান সব পীড়িতের সম্পদ হয়ে গেছে এতদিনে। কেবল স্থাবর স্থাণু পাষাণ কারা নয়, এমনকী, চিন্তারাজ্যের কারাগারের জন্যও ভাঙার গান প্রাসঙ্গিক। জনতার কবি হিসেবে নজরুলের যে পরিচিতি গড়ে উঠেছে তার নেপথ্যে এই গানটির অবদান অনেকখানি। ব্ল্যাকলেটার্স প্রকাশন সংস্থাকে আন্তরিক ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি, শতবর্ষ পেরনো ভাঙার গান বইটিকে এমন এক সময়ে আবার সামনে এনেছেন তাঁরা– ঠিক যখন ভাঙার গান খুব দরকারি হয়ে উঠেছে। নজরুলের ভাঙার গান আমাদের ভাঙার গানে ইন্ধন জুগিয়ে দিক– যতদিন না পর্যন্ত ক্ষমতার নতুন কোনও তোষামুদে পেয়াদা এই রকম কোনও অভিযোগ লিখে পাঠায়, ভয়ংকর ষড়যন্ত্র হচ্ছে, বিদ্রোহ আর অবাধ্যতা উসকে দিচ্ছে ব্ল্যাকলেটার্স, এবার ওদের সহায় হয়েছে সেই সেই পুরনো পাপী, সেই পাগল লোকটা, সেই কাজী নজরুল ইসলাম।
ভাঙার গান: শতবার্ষিক সংস্করণ
কাজী নজরুল ইসলাম
ব্ল্যাকলেটার্স
২০০ টাকা
…………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………….