জেলে অনেক বিচারাধীন বন্দি থাকেন। তাঁদের বিচার চললেও দোষ প্রমাণিত নয়। পরে অনেকেই প্রমাণের অভাবে মুক্তি পান। আবারও এমনও অনেকে আছেন, যাঁরা হয়তো বিনা দোষে জেল খাটছেন। পরে দেখা যায়, বিচারের কোনও ক্ষেত্রে ভুল হয়েছে। সুতরাং তাঁদের প্রাপ্য অধিকার রদ করা কাঙ্ক্ষিত নয়। এছাড়া, জেল এখন খোলা হাওয়ায় নতুন নামের শরিক– ‘সংশোধনাগার’। সেখানে খেলা হয়, সংস্কৃতি-চর্চা হয়। শ্রমের বিনিময়ে বন্দিদের পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। পুনর্বাসনের লক্ষ্যে চলে নানা কর্মকাণ্ড। অপরাধীকে যখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে, তখন যৌনতার মতো জীবনের অপরিহার্য বিষয়ই বা বাদ থাকে কেন?
আহার, নিদ্রা, মৈথুন– মুখে যাই বলি, আদপে এই তিনটিই যে মানুষের মূল কাজ, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। মানবসভ্যতা তো বটেই, প্রকৃতির প্রত্যেক জীবের এই প্রবৃত্তি। মানুষ তাদের মধ্যেই একটা প্রজাতিমাত্র! একটি উন্নততর প্রজাতি। যা সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন চাণক্য। তাঁর নীতিমালার শ্লোক ১৭/১৫-এ বলা হয়েছে, হিতোপদেশেও বলা আছে– ‘আহারনিদ্রাভয়মৈথুনং চ, সামান্যমেতৎ পশুভির্নরাণাম্। ধর্মোঃ হি তেষামধিকো বিশেষো, ধর্মেণ হীনাঃ পশুভিঃ সমানাঃ।।’ একটু পাল্টে উত্তর গীতার ৪৪ নম্বর শ্লোক বলছে, ‘আহার-নিদ্রা-ভয়-মৈথুনঞ্চ, সামান্তমেতৎ পশুভির্নরাণাম্ জ্ঞানং নরাণামধিকং বিশেষো, জ্ঞানেন হীনাঃ পশুভিঃ সমানাঃ।’ অর্থাৎ, ভোজন করা, নিদ্রা যাওয়া, ভয়ে ভীত হওয়া এবং মৈথুনের মাধ্যমে সন্তান উৎপন্ন করা, এই সমস্ত বিষয়ে মানুষ আর পশুর মধ্যে কোনও ফারাক নেই। কিন্তু পশুর চেয়ে মানুষ একটু আলাদা। তারা ধার্মিক, জ্ঞানী। এর থেকেই স্পষ্ট যে, ধর্মহীন ও জ্ঞানহীন মানুষ পশুর সমতুল্য।
তা এই ‘আহার-নিদ্রা-মৈথুন’ হল জীবের সর্বস্ব। এছাড়া জীবন, সৃষ্টি অচল। জ্ঞানবৃক্ষ থেকে ফল পেড়ে খাওয়াই হোক বা বৈজ্ঞানিক কারণে জৈবিক চাহিদার বশবর্তী হওয়া, মৈথুন ছাড়া সৃষ্টি থমকে যাবে। অথচ খিদে-ঘুম নিয়ে সমাজের কারও কোনও মাথাব্যথা নেই, যত ভ্রুকুটি যৌনতা ও শারীরিক সম্পর্কের মতো সুস্থ-স্বাভাবিক বিষয় নিয়ে। লজ্জা, সমাজচ্যুতি বা শাস্তির বিধি-বন্দোবস্তও তৈরি করে রেখেছে সমাজ। যাতে প্রয়োজনীয় ‘ফোড়ন’ দিয়ে রেখেছে ধর্মগুরুরাও। অথচ যৌনতা সাধারণত মানুষের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি এবং শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। এটি ভালোবাসার প্রকাশ, ঘনিষ্ঠতা এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। যার অপরিসীম প্রভাব রয়েছে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও। তাই একে অবহেলা করার কোনও যুক্তিসংগত কারণ নেই। স্বাধীন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যে সমস্ত মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে, যৌনতাও তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
এই আবহেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রায় দিয়েছে ইতালির একটি সাংবিধানিক আদালত। যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমবারের মতো সে দেশের একটি কারাগারে চালু হয়েছে ‘সেক্স রুম’, যেখানে বন্দিরা তাঁদের সঙ্গীর সঙ্গে একান্তে সময় (যৌন মিলন) কাটাতে পারবেন। সদ্য আমব্রিয়া অঞ্চলের টেরনি শহরের একটি জেলে এক পুরুষ বন্দি তাঁর মহিলা সঙ্গীর সঙ্গে একটি বিশেষ কক্ষে সাক্ষাৎ করার এই সুযোগ পান। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে ঘরের দরজা বন্ধ ছিল না। যাতে বিশেষ কোনও পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে কারারক্ষীরা সেখানে প্রবেশ করতে পারেন। বন্দির গোপনীয়তাও রক্ষা করা হচ্ছে। ইতালির ওই আদালতের মন্তব্য, কারাবন্দিদেরও তাঁদের সঙ্গী বা জীবনসঙ্গীর সঙ্গে ‘অন্তরঙ্গ সাক্ষাৎ’ করার অধিকার থাকা উচিত। অবশ্য ইউরোপের অন্যান্য কয়েকটি দেশ যেমন ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, নেদারল্যান্ড এবং সুইডেনে এই প্রথা আগে থেকেই চলে আসছে।
এই পরিস্থিতিতে ভারতের অবস্থা ঠিক কী রকম? বছর দশেক আগেই ঐতিহাসিক রায় দিয়েছিল পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্ট। বিচারপতি সূর্যকান্তের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ জানিয়েছিল, যে কোনও বন্দির ‘প্রজননের অধিকার’ জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্রের অধিকারের অধীন। সংবিধানের ২১ নম্বর ধারায় যে অধিকারের কথা বলা হয়েছে। বৈবাহিক সম্পর্কের পরিধির মধ্যে তাই বন্দিদের প্রজননের বা কৃত্রিম প্রজননের অধিকার রয়েছে। তবে কারা এই সুযোগ পাবেন, তা ঠিক করবে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকার। কিন্তু তার পরেও পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি।
…………………………………
বছর দশেক আগেই ঐতিহাসিক রায় দিয়েছিল পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাই কোর্ট। বিচারপতি সূর্যকান্তের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ জানিয়েছিল, যে কোনও বন্দির ‘প্রজননের অধিকার’ জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্রের অধিকারের অধীন। সংবিধানের ২১ নম্বর ধারায় যে অধিকারের কথা বলা হয়েছে। বৈবাহিক সম্পর্কের পরিধির মধ্যে তাই বন্দিদের প্রজননের বা কৃত্রিম প্রজননের অধিকার রয়েছে। তবে কারা এই সুযোগ পাবেন, তা ঠিক করবে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকার। কিন্তু তারপরেও পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি।
…………………………………
খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান থেকে শুরু করে আইনি অধিকারের নানা প্রশ্নে ভারতীয় সমাজ মুখর। কিন্তু মানসিক-শারীরিক অধিকারের কথা উঠলেই অনেকে যেন দ্বিধায় ভোগেন। সামাজিক অধিকারের প্রশ্নে মানুষ যতটা উচ্চকিত, শারীরিক অধিকারের প্রশ্নে তারাই কেন যেন মুখে কুলুপ আঁটে। পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্টের রায় কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার দরজা খুলে দিয়েছিল। এখনও নানা আদালতে, একই যুক্তিতে আবেদন জমা পড়ে। যদিও সেগুলির পরিণতি বিশেষ একটা ইতিবাচক হয় না। এক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, যিনি দণ্ডিত আসামি, তাঁর কিছু অধিকার রদ হয়েই থাকে। কিন্তু তাঁর স্ত্রী তো কোনও অপরাধ করেননি। তাঁর স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় চাহিদার নিবৃত্তি হবে কী করে? স্বামীর সঙ্গে তাঁকেও তো ‘বঞ্চিত’ ও ‘অস্বাভাবিক’ জীবনই কাটাতে হয়। তাঁর সন্তান ধারণ, যৌনতার অধিকার কি এতে লঙ্ঘিত হচ্ছে না? একজনের অপরাধের বোঝা কেন অন্যজন বয়ে বেড়াবেন?
আবার এটাও প্রমাণিত যে, কারাগারে স্বাভাবিক যৌনজীবনের সুবিধে না থাকলেও বন্দিদের অবদমিত কাম রুদ্ধ করার কোনও পথ নেই। তা নানাভাবে বেরিয়ে আসেই। বস্তুত, বাঁকাপথেই যৌনতৃষ্ণা মেটানোর বন্দোবস্ত করে নেন বন্দিরা। তাতে বিপদ ও ঝুঁকি কম নেই। সম্প্রতি জানা গিয়েছে, উত্তরাখণ্ডের হরিদ্বার জেলা কারাগারে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার সময় ১৫ জন বন্দির এইচআইভি পজিটিভ পাওয়া গিয়েছে। ২০২৩-এ উত্তরাখণ্ডেরই হলদোয়ানি জেলে এক মহিলা-সহ ৪৪ জন বন্দি এইচআইভি সংক্রমিত হন। অন্যান্য জেলেও কী অবস্থা, সহজেই অনুমেয়। তাহলে এটাও মেনে নিতে হয়, বন্দিদের স্বাভাবিক যৌনতার পথে বাধা তৈরি করে রাষ্ট্রই তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে।
কেউ হয়তো প্রশ্ন তুলতে পারেন, সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের আবার অধিকার কী? তারা অপরাধী। এখানে দু’টি বিষয় বলার।
এক, জেলে অনেক বিচারাধীন বন্দি থাকেন। তাঁদের বিচার চললেও দোষ প্রমাণিত নয়। পরে অনেকেই প্রমাণের অভাবে মুক্তি পান। আবারও এমনও অনেকে আছেন, যাঁরা হয়তো বিনা দোষে জেল খাটছেন। পরে দেখা যায়, বিচারের কোনও ক্ষেত্রে ভুল হয়েছে। সুতরাং তাঁদের প্রাপ্য অধিকার রদ করা কাঙ্ক্ষিত নয়। এছাড়া, জেল এখন খোলা হাওয়ায় নতুন নামের শরিক– ‘সংশোধনাগার’। সেখানে খেলা হয়, সংস্কৃতি-চর্চা হয়। শ্রমের বিনিময়ে বন্দিদের পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। পুনর্বাসনের লক্ষ্যে চলে নানা কর্মকাণ্ড। অপরাধীকে যখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে, তখন যৌনতার মতো জীবনের অপরিহার্য বিষয়ই বা বাদ থাকে কেন?
তবে ভারত নামক রাষ্ট্র এবং এ দেশের সমাজ কি আদৌ এই উদারতা দেখাতে পারবে, ইতালির সাম্প্রতিক পদক্ষেপ সেই প্রশ্নই ফের উসকে দিল।
………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………