একবার (২৯ এপ্রিল, ১৯৯৯-এর ঘটনা) নেল্সন ম্যান্ডেলাকে অভ্যর্থনা জানাতে গিয়ে মহা কেলেঙ্কারি কাণ্ড! তখন সাবেক যুগোস্লাভিয়ার কোসোভো সংকট চলছিল। এই সময় নেল্সন ম্যান্ডেলাকে মস্কোতে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে ইয়েল্ৎসিন বললেন, ‘আপনি যুগোস্লোভিয়ায় যা করছেন… মাফ করবেন, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রে যা করছেন, তার জন্য আমরা গর্বিত।’ এরকম বেফাঁস কথা বলার ঘটনা তাঁর ক্ষেত্রে অতীতেও ঘটেছে। একবার সুইডেনে এসে তিনি ফিনল্যান্ডের সঙ্গে সম্পর্কের কথা বলতে শুরু করে দিয়েছিলেন। এখানেও তাঁর পূর্বসূরি ব্রেজ্নেভ্, আর উত্তরসূরি বোধহয় ভূতপূর্ব মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ (জুনিয়র) যাঁর অদ্ভুত অদ্ভুত বাগধারা ও ভুলভাল শব্দ প্রয়োগ পরবর্তীকালে ‘বুশইজম’ নামে পরিচিত হয়েছে এবং হয়তো এককালে শব্দকোষে স্থানও পেতে পারে।
৬১.
বিশুদ্ধ হাস্যরসের দিন কি শেষ হয়ে গেল?
বিংশ শতাব্দীর তিনের দশকে অনেক চুটকিই, বিশেষত মারাত্মক ধরনের সমস্ত চুটকিই প্রচলিত ছিল তখনকার দিনের বিখ্যাত হাস্যরসিক কার্ল রাদেকের নামে। এর আগেই অবশ্য তাঁকে স্তালিনের বন্দি শ্রমশিবিরে ইহলীলা সংবরণ করতে হয়েছিল।
মাক্সিম গোর্কির কোনও এক জন্মজয়ন্তীতে নাকি রাদেক বলেছিলেন, ‘আচ্ছা গোর্কি শহর, গোর্কি স্ট্রিট, গোর্কি যৌথখামার কত কিছুরই নাম আমরা, গোর্কির নামে দিয়েছি… আমাদের সমস্ত জীবনটাকেই তাঁর সম্মানে ‘ম্যাক্সিমাম গোর্কি’ (‘গোর্কি’ নামের অর্থ তিক্ত) নাম দিলে হয় না?’
দেশের প্রসঙ্গ যখন উঠল তখন আরও দু’-একটি মজার গল্প বলা যেতে পারে। রুশিরা এমনিতে দারুণ দেশভক্ত। সোভিয়েত ইউনিয়নে থাকতে, তাদের অনেককে গর্ব করে এমন কথাও বলতে শুনেছি– কী নেই আমাদের সোভিয়েত দেশে? অথচ তাদেরই অনেকের মুখে– বিশেষত, বুড়ো মানুষদের মুখে শুনেছি আমাদের দেশটা একটা মূর্খের দেশ।
সে যাই হোক, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যখন অস্ত্র প্রতিযোগিতা হ্রাস এবং অন্যান্য বিষয়ে ঘন ঘন আলাপ-আলোচনা চলছে, সেই সময়ের কথা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট মস্কোয় এসেছেন সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে। একসময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট কথায় কথায় জাঁক করে সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধানকে বললেন, ‘আমাদের দেশ প্রযুক্তিবিদ্যায় এতদূর এগিয়ে গেছে যে আমরা এখানে বসে নরকের সঙ্গে পর্যন্ত টেলিফোনে যোগাযোগ করে কথাবার্তা বলতে পারি।’ সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান এতে রীতিমতো আগ্রহ প্রকাশ করে মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে জানতে চাইলেন এরকম একটা যোগাযোগ ব্যবস্থার সুযোগ মস্কো তাদের কাছ থেকে পেতে পারে কি না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘ও প্রচুর ব্যয়সাপেক্ষ, আপনাদের সাধ্যে কুলোবে না।’ সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান নাছোড়বান্দা। শেষকালে প্রেসিডেন্ট নিমরাজি হয়ে বললেন, ‘বেশ যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছি, কিন্তু অত খরচ করে দেশ যদি লাটে উঠে যায় তার জন্য আমাকে দুষবেন না।’ সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান নরকে যোগাযোগ করে কমরেড স্তালিনের সঙ্গে দীর্ঘ রাজনৈতিক শলাপরামর্শ সেরে অফিস ঘরে ফিরে এলেন। কিছুক্ষণ বাদে সশরীরে শয়তান টেলিফোন বিল নিয়ে উপস্থিত। সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধানের বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল– টাকার অঙ্ক কত হবে কে জানে? কিন্তু বিল দেখে তো চক্ষুস্থির! মাত্র দু’-কোপেক। শয়তান মুচকি হেসে বলল, ‘লোকাল কল যে।’ তখনকার দিনে টেলিফোন বুথ থেকে লোকাল কলের ওটাই ছিল রেট।
কিন্তু আশ্চর্য এই যে, চুটকির প্রবাহ কমে গেল গ্লাস্নস্ত তথা প্রকাশের স্বাধীনতার ঘোষণার আমলে। হয়তো এখন আর সেসময় বা অবকাশ মানুষের নেই। গর্বাচ্যোভ্কে নিয়ে যাও বা দু’-একটি চুটকি এককালে শোনা গেছে, ইয়েল্ৎসিনকে নিয়ে একেবারেই শোনা যায়নি। অবশ্য তাতে আক্ষেপ করার বিশেষ কারণ নেই। যেহেতু তাঁর বিসদৃশ কার্যকলাপ ও বেফাঁস কথাবার্তাই চুটকির পর্যায়ে চলে গিয়েছিল।
………………………….
১৯৯৩ সালের ১২ জুনের কথা: দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মিলিত হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন। দিনটি গত দু’-বছর ওইদিন ইয়েলৎসিন হল রাশিয়ার স্বাধীনতা দিবস বলে পরিচিত। গত তিন বছর আগে ওই দিন নির্বাচিত হয়েছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসাবে। কিন্তু শনিবার অমনিতেই ছুটির দিন থাকায় এবারে সেটা অনেকেরই খেয়াল ছিল না।
…………………………
অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে লিখিত ভাষণের বাইরে গেলেই তিনি পরিস্থিতি হাস্যকর করে তুলছেন। একবার (২৯ এপ্রিল, ১৯৯৯-এর ঘটনা) নেল্সন ম্যান্ডেলাকে অভ্যর্থনা জানাতে গিয়ে মহা কেলেঙ্কারি কাণ্ড! তখন সাবেক যুগোস্লাভিয়ার কোসোভো সংকট চলছিল। এই সময় নেল্সন ম্যান্ডেলাকে মস্কোতে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে ইয়েল্ৎসিন বললেন, ‘আপনি যুগোস্লোভিয়ায় যা করছেন… মাফ করবেন, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রে যা করছেন, তার জন্য আমরা গর্বিত।’ এরকম বেফাঁস কথা বলার ঘটনা তাঁর ক্ষেত্রে অতীতেও ঘটেছে। একবার সুইডেনে এসে তিনি ফিনল্যান্ডের সঙ্গে সম্পর্কের কথা বলতে শুরু করে দিয়েছিলেন। এখানেও তাঁর পূর্বসূরি ব্রেজ্নেভ্, আর উত্তরসূরি বোধহয় ভূতপূর্ব মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ (জুনিয়র) যাঁর অদ্ভুত অদ্ভুত বাগধারা ও ভুলভাল শব্দ প্রয়োগ পরবর্তীকালে ‘বুশইজম’ নামে পরিচিত হয়েছে এবং হয়তো এককালে শব্দকোষে স্থানও পেতে পারে।
১৯৯৩ সালের ১২ জুনের কথা: দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মিলিত হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন। দিনটি গত দু’-বছর ওইদিন ইয়েলৎসিন হল রাশিয়ার স্বাধীনতা দিবস বলে পরিচিত। গত তিন বছর আগে ওই দিন নির্বাচিত হয়েছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসাবে। কিন্তু শনিবার অমনিতেই ছুটির দিন থাকায় এবারে সেটা অনেকেরই খেয়াল ছিল না।
সাংবাদিক সম্মেলনের উদ্বোধন করতে গিয়ে বরিস ইয়েল্ৎসিন সমবেত সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন: ‘রাশিয়ার একান্তই নবীন এক উৎসব উপলক্ষে আপনাদের অভিনন্দন জানাই।’
সাংবাদিকরা প্রেসিডেন্টের মনের ভাব বুঝতে না পেরে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে থাকেন। কোনও প্রতিক্রিয়া তাঁদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না দেখে প্রেসিডেন্ট ধরিয়ে দেন: ‘হাততালি দিতে পারেন আপনারা।’ হাততালি পড়ে, যদিও কারও তেমন বোধগম্য হয় না, হাততালি দেওয়ার কারণ কী থাকতে পারে। অবশেষে বোঝা যায়, যখন প্রেসিডেন্টের প্রেস-সেক্রেটারি প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করেন প্রশ্নোত্তরগুলি তিনি যেন যতদূর সম্ভব সংক্ষেপে বলেন। উত্তরে প্রেসিডেন্ট আপত্তি তোলেন: বার্ষিকীটা আমার, আর উনি কিনা আমাকেই সমালোচনা করছেন।
একসময় অকপট স্বীকারোক্তি করলেন প্রেসিডেন্ট: ‘আমি একসময়, এক জনসভায় প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে রেলের চাকার তলায় প্রাণ দেব। কিন্তু জনসভা জনসভাই, সেখানে শুধু রেললাইনের ওপর মাথা পেতে দেওয়া কেন, আরও…’ প্রেসিডেন্টের প্রেস-সেক্রেটারি সঙ্গে সঙ্গে খেই ধরিয়ে দেন: ‘কথা রাখতে না পারলে টুপি খাবেন, এমন কথাও কে যেন একবার বলেছিলেন, যতদূর মনে পড়ে চার্চিল।’ ইয়েল্ৎসিনের মন্তব্য: ‘আমার মনে হয় টুপি শেষ পর্যন্ত তিনি খাননি। হুইস্কি খেয়ে চুরুট ফুঁকে নব্বই বছরের ওপর বেঁচে ছিলেন, কিন্তু টুপি গেলেননি।’ প্রেস-সেক্রেটারির সিদ্ধান্ত: ‘তবে আপনি যে রেললাইনের ওপর মাথা পেতে দেননি, রাশিয়ার মানুষের কাছে এই চমকটা বেশ আনন্দের।’
দুঃখের কথা, আজকের এই হাস্যরসহীন সমাজে রুশি চুটকির আর্টটাই নষ্ট হতে চলেছে। সম্প্রতি উৎসাহদানের জন্য কোনও কোনও সংস্থা ও পত্রপত্রিকা এটাই প্রমাণ করার চেষ্টা করছে যে, রুশিদের হাস্যরস এখনও শুকিয়ে যায়নি– আপাতত সুপ্ত এই যা। ইয়েলৎসিনের আমলে কোনও এক প্রকাশনসংস্থা এই বিষয়ে একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার চুটকি জমাও পড়েছিল। কিন্তু অধিকাংশই ছিল এত অশ্লীল ও আদিরসাত্মক যে, প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। তাহলে কি সত্যি সত্যি বিশুদ্ধ হাস্যরসের দিন শেষ হয়ে গেল?