গ্রহণের মতো একটা গম্ভীর, শান্ত, কনফিডেন্ট সেলেসটিয়াল ইভেন্টকে ‘অপয়া’ বলার স্পর্ধা প্রথম হয়েছিল কে জানে! সূর্যগ্রহণ আর চন্দ্রগ্রহণ আসলে পৃথিবী আর চাঁদের ছায়াবাজি। চাঁদ পৃথিবীর গায়ে ছায়া ফেললে পৃথিবীতে সূর্যগ্রহণ, পৃথিবী চাঁদের গায়ে ছায়া ফেললে চাঁদে সূর্যগ্রহণ আর পৃথিবীতে চন্দ্রগ্রহণ, এক অলকবন্ধন। দু’জনের আদিম ভালোবাসাবাসি। জগৎ সংসার অন্ধ করা ভালোবাসার ম্যাজিক। আর ভালোবাসার ম্যাজিক নিয়ন্ত্রণ করা যায় না তাই সে অপয়া। সেই মান্ধাতার আমল থেকে।
প্রচ্ছদের ছবি লেখক
অনেক ক্ষেত্রেই এ মহাবিশ্বের অনেক রহস্যই কৌতূহলের চেয়ে ভয় জুগিয়েছে বেশি। যেসব ভয়ের সমাধান মানুষের তাকতে কুলোয়নি তাকে ‘অপয়া’ বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর কারণ মূলত দুটো। এক অপয়া জিনিসটা নিয়ে মানুষ প্রশ্ন করে কম। দুই অপয়াকে ভয়ও পায় মন থেকে। ম্যাজিক যেমন যতদূর যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে মাপা যায় ততদূর পর্যন্ত ধপধপে হোয়াইট। কিন্তু তার বাইরে সব ব্ল্যাক, তেমনই মহাবিশ্বের কিছু রহস্য আমাদের কাছে ভগবানের মহিমা, কিছু অপয়া। গ্রহণের মতো একটা গম্ভীর, শান্ত, কনফিডেন্ট সেলেসটিয়াল ইভেন্টকে ‘অপয়া’ বলার স্পর্ধা প্রথম হয়েছিল কে জানে! সূর্যগ্রহণ আর চন্দ্রগ্রহণ আসলে পৃথিবী আর চাঁদের ছায়াবাজি। চাঁদ পৃথিবীর গায়ে ছায়া ফেললে পৃথিবীতে সূর্যগ্রহণ, পৃথিবী চাঁদের গায়ে ছায়া ফেললে চাঁদে সূর্যগ্রহণ আর পৃথিবীতে চন্দ্রগ্রহণ, এক অলকবন্ধন। দু’জনের আদিম ভালোবাসাবাসি। জগৎ সংসার অন্ধ করা ভালোবাসার ম্যাজিক। আর ভালোবাসার ম্যাজিক নিয়ন্ত্রণ করা যায় না তাই সে অপয়া। সেই মান্ধাতার আমল থেকে।
ভারতীয় দর্শন যেহেতু একমুখী নয়, তাই গ্রহণের প্রতি ধারণাও ভিন্ন। সবচেয়ে প্রচলিত ধারণার বীজ রয়েছে অমৃত মন্থনের ইতিহাসে। অসুর সুর্ভানু যখন ছদ্মবেশে লুকিয়ে ঢুকে পড়েছিল দেবতাদের পঙ্ক্তিতে তখন সূর্য আর চন্দ্র তাঁকে চিনে ফেলে। বিষ্ণুর মোহিনী রূপকে তারা সজাগ করে সে ব্যাপারে, আর বিষ্ণুও এক মূহূর্তের দেরি না করে চালিয়ে দেন সুদর্শন চক্র। সুর্ভানুর শির ধর থেকে আলাদা হয়ে গেল বটে, কিন্তু ততক্ষণে সুর্ভানু গিলে ফেলেছেন খানিকটা অমৃত তাই তার শির আর ধর– দুই-ই অমর হয়ে উঠল ‘রাহু’ আর ‘কেতু’ নামে। সূর্য আর চন্দ্রের ওপর সেই থেকে আজন্মের রাগ রাহু আর কেতুর। সূর্য ও চন্দ্রকে সে ভক্ষণ করার তাগিদে আজও তারা ছুটে বেড়ায় অক্লান্ত। কিন্তু হজম করার ক্ষমতা রাহু আর কেতুর না থাকায় চাঁদ আর সূর্যও বেঁচে যায় আজীবন। এই ঘটনা যখন, জ্যোতিষশাস্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হল তখন সেই ভক্ষণকাল বা গ্রহণকাল হয়ে ওঠে ‘অমঙ্গল’, ‘অপয়া’। সূর্য আর চাঁদকে গিলে ফেলার চেষ্টাটা আর যাই হোক মানুষের অভিধানে বরাবর নেতি। খাওয়া, রান্না করা, ঘুমোনো, বাড়ি থেকে বেরনো বা কোনও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার নিষেধ আছে গ্রহণকালে। কারণ সে সময়ে সূর্য বা চন্দ্রের অনুপস্থিতির ফলে আলোর রশ্মির যে তারতম্য ঘটে, তা সূক্ষ্ম দুনিয়ার বিষাক্ত তাই যে কোনও জীবনমুখী কাজ এ সময়ে বিষিয়ে যেতে বেশি সময় নেয় না।
মেসোপটেমিয়াতে গ্রহণের সঙ্গে রাজার মৃত্যুকে তুলনা করা হত। ‘এনুমা আনু এনিল’ লিপিবদ্ধ করেছে গ্রহণের এমন অনেক অপয়া কর্ম। খরা, যুদ্ধ, বন্যা যা যা অন্ধকার করে দেবে জগৎ সংসার। প্রাচীন চিন দেশে গ্রহণের সঙ্গে রাজার মৃত্যুর যোগ থাকালেও রাহুর মতো সেখানেও এক ড্রাগনের উল্লেখ আছে। এবং দামামার মতো যন্ত্রের শব্দে সে অমঙ্গলকে খানখান করে দেওয়ার প্রথাও ছিল একরকম। ক্রিশ্চিয়ানিটিতে গ্রহণ চরম মুহূর্তে এসেছে। যিশুর ক্রশবিদ্ধ কালে ‘নাইনথ্ আওয়ার’ পর্যন্ত যে আঁধার নেমে এসেছিল, তা গ্রহণের কথাই মনে করায় দিও সেন্ট পিটারের সারমনে সূর্যগ্রহণ আর চন্দ্রগ্রহণকে একট নবযুগের সূচনা বলে আহ্বানও করা হয়েছে, সেটা ভুললে অন্যায় হবে। তন্ত্রে গ্রহণকে শিবশক্তির মিলন হিসেবে দেখা হয়েছে। সম্মোহন থেকে বুহনের পথে যাওয়ার একটা পথ, অসীমের সাথে স্বসীমের মিলন।
তবে ‘আগন্তুক’ ছবিতে সত্যজিৎ রায় মনমোহন মিত্রের জবানিতে যে-কথাটা বলেছেন, তারপর গ্রহণ পয়া-অপয়ার গণ্ডি ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে গিয়েছে। যে রহস্যে চাকতিতে চাকতি মিলে যায় এমন এক ম্যাজিক। তা সে শিবশক্তির হোক বা পৃথিবী আর চাঁদেরই হোক, ম্যাজিকটা ভালোবাসার। জগৎ সংসার অন্ধ করে দেওয়ার মতো ভালবাসা। পয়া-অপয়ার হিসেব তার কাছে বড্ড খাটো।
……………..অপয়ার ছন্দ অন্যান্য পর্ব……………..
পর্ব ৬। প্রেম সেই ম্যাজিক, যেখানে পিছুডাক অপয়া নয়
পর্ব ৫। ডানা ভাঙা একটি শালিখ হৃদয়ের দাবি রাখো
পর্ব ৪। জন্মগত দুর্দশা যাদের নিত্যসঙ্গী, ভাঙা আয়নায় ভাগ্যবদল তাদের কাছে বিলাসিতা
পর্ব ৩। পশ্চিম যা বলে বলুক, আমাদের দেশে ১৩ কিন্তু মৃত্যু নয়, বরং জীবনের কথা বলে
পর্ব ২। শনি ঠাকুর কি মেহনতি জনতার দেবতা?
পর্ব ১। পান্নার মতো চোখ, কান্নার মতো নরম, একা