দয়া করে, গুগলবাবুকে সময় জিজ্ঞেস করবেন না। বিশেষত, আপনি দুর্বলচিত্ত হলে তো না-ই। একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, ইংল্যান্ডে দুপুর সাড়ে-তিনটে মানে ভারতে তখন কটা বাজবে? গুগলবাবু, উত্তরে বলেছিলেন, ভারতে আটজন প্রধানমন্ত্রী! বাঁ-হাতে বুকটা চেপে, ডানহাতে ইংরেজি ক্লিক করে জেনেছিলাম, গুগলবাবু বলেছেন, ‘ইন ইন্ডিয়া দেয়ার ইজ এইট পিএম।’
কালে-ক্রমে, গুগল ক্রোমে অনেক কিছুই এসেছে। আমাদের তো আর সিধুজ্যাঠা নেই! আবার খুঁচিয়ে জবাব জেনে নেওয়ার মতো মেজদাও নেই! আমাদের আছেন গুগলবাবু। গুগলবাবুর উত্তরগুলো ভারি মজাদার! বিশেষ করে, যদি আপনি বাংলায় প্রশ্ন করেন।
সেদিন, ৩০ সেপ্টেম্বর, মোবাইলে জ্বলে উঠল নোটিফিকেশন। গুগলবাবু বললেন: ‘আন্তর্জাতিক অনুবাদ দিবস’। সেপ্টেম্বর ফুরিয়ে গেলেও, আমার কথাটি ফুরালো না। বলা ভালো, শুরু হল।
কিশলয় অবস্থায়, দেশ-বিদেশের গল্প-কাহিনি বাংলায় পড়েছি। বুঝতেই পারিনি যে, এই বই-সকল আদতে, বাংলায় লেখাই হয়নি! এই বুঝতে না পারাতেই ছিল অনুবাদের সার্থকতা। ‘Milou’ থেকে ‘কুট্টুস’ হয়ে ওঠা, ‘Panoramix’ থেকে ‘এটাসেটামিক্স’ হয়ে ওঠা কিংবা ‘Henry’ থেকে ‘গাবলু’ হয়ে ওঠাতেই ছিল অনুবাদের আনন্দ। ‘Plop’ ধ্বনির ‘ছলাৎ’ রূপই যেন সঠিক ভাষান্তর। যদি কখনও কিছু পড়ে মনে হত, বাংলায় লেখা হয়নি, অনুবাদ করা হয়েছে, তখনই থেকে গিয়েছে অপূর্ণতা। অন্য ভাষার পাখির গান, ট্রেনের হুইসল, মানুষের কথা বাংলায় শুনতে না পাওয়া অবধি মন ভরেনি।
সেই মনের ভিতর আড়াইখানা ভাষা নিয়ে, পেশাদার জগতে দেখেছি, অনুবাদকের কাজ, শুধুমাত্র বই-পত্রে সীমাবদ্ধ নেই। দলিল-দস্তাবেজ, আদালতের রায়, রাজনৈতিক বক্তৃতা, দৈনিক সংবাদ, নোটিশ বোর্ড, পণ্য বিবরণী, প্রেসক্রিপশন, ব্যাঙ্কের ফর্ম, বিজ্ঞাপন, সিনেমার সাবটাইটেল, ওয়েবসাইট বা মোবাইল অ্যাপের মতো যে কোনও জায়গাতেই ভাষান্তর প্রয়োজন। যাকে বলা হয়, লোকালাইজেশন বা স্থানীয়করণ। এই যে, কাস্টমার কেয়ারে ফোন করলেই, কপালকুণ্ডলা বলে ওঠেন: পথিক তুমি কি ভাষা হারাইয়াছ— তারপর সুইচ টিপে ভাষা বেছে নিতে হয়; পথিক তথা উপভোক্তার পথে ভাষা-পরিষেবা বিছিয়ে দেওয়ার এই কর্মকাণ্ডের নামই ‘লোকালাইজেশন’।
লোকালাইজেশনের সংসারে, বছর দশ আগে, হাজির হয়েছিল এক ধরনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই। নিউরাল মেশিন ট্রান্সলেশন বা এনএমটি। পাইথন কোডিংয়ের মাধ্যমে মেশিনকে মানুষের ভাষা শেখানো। সেই বর্ণপরিচয়ের বিদ্যাসাগর ছিলেন আমাদের গুগলবাবু। আর সহজপাঠ লিখেছিলেন, মাইক্রোসফট ঠাকুর। পাইথন নামক ‘অ-এ অজগর’ তেড়ে এল। শুরু হল মেশিন ট্রান্সলেশন।
তারা ভাবলেন, আমাদের মস্তিষ্ক যেভাবে শব্দ গ্রহণ করতে করতে ভাষা শিখে ফেলে, সেভাবে মেশিনও ডেটা খেয়ে, ভাষা শিখে ফেলবে একদিন। এনএমটি পদ্ধতিতে, শিখে ফেলবে, ‘টিট ফর ট্যাট’-এর বাংলা ‘ইটের বদলে পাটকেল’। কিন্তু সমস্যা হল ফাস্টফুড খেয়ে। সমস্ত কিছুর আক্ষরিক অনুবাদ খেয়ে মেশিনের হল বেজায় পেটখারাপ। এখন সে, সংবিধানের ‘আর্টিকেল’-কে ‘নিবন্ধ’ লেখে। ‘মেসোমশাই’-কে লেখে ‘মিস্টার মেসো’, প্রসূতি মায়ের প্রেসক্রিপশনে, ‘লেবার অ্যান্ড ডেলিভারি’-কে লেখে ‘শ্রম ও বিতরণ’।
এক কুরিয়ার সার্ভিসিং সংস্থা তার ইংরেজি ফর্মে লিখেছিল: কাস্টমারস ফিজিকাল অ্যাড্রেস। বাঙালি কাস্টমার বেচারা শুধু বাংলায় ফর্মের একটা কপি চেয়েছিলেন। গুগলবাবু তাতে লিখে দিলেন: ‘উপভোক্তার শরীরের ঠিকানা’! শুনেছি, সেই মানহানির মামলা আজও চলছে।
চাকরির পরীক্ষায়, প্রশ্ন এসেছিল রাউরকেল্লা স্টিল প্লান্ট সম্পর্কে। যাঁরা বাংলায় সেই পরীক্ষায় দিয়েছিলেন, তাঁদের খাঁটি বাংলায় গুগল অনুবাদক জিজ্ঞেস করেছিলেন: রাউরকেল্লা ইস্পাতের গাছ কোথায় অবস্থিত? সত্যিই তো, টাকা ছাড়া সবই তো গাছেই ফলে!
পদার্থবিদ্যায়, ভাসমান বস্তুর ইংরেজি, ‘ফ্লোটিং বডি’। জনৈক অনলাইন শিক্ষকের নোটসে লেখা ছিল, ‘এ বডি ইজ ফ্লোটিং ইন দ্য ওয়াটার’; যার গুগলকৃত বঙ্গানুবাদ ছিল, ‘জলে একটা লাশ ভাসছে।’ ভাগ্যিস আর্কিমিদিস বাংলা জানতেন না! জানলে হয়তো ‘ইউরেকা’ বলে রাজদরবারে না গিয়ে, ‘জয় বাংলা’ বলে বাংলা পক্ষে ঢুঁ মারতেন।
ধরুন, গুগল ক্রোমে খেলার স্কোর বাংলায় দেখছেন। দেখবেন, মেসি-রোনাল্ডোর খুব জরিমানা হচ্ছে। কিন্তু ইংরেজিতে জরিমানা হচ্ছে না। আপনার রাগ হবে। ভাববেন, বাংলার প্রতি অবিচার হচ্ছে। মনে মনে গ্রেগ চ্যাপেলকে তিন-চার অক্ষর দেবেন। তখনই বুঝতে পারবেন গুগলবাবু, ফুটবলে পেনাল্টির বাংলা করেছেন জরিমানা।
আবার হয়তো দেখলেন, প্রতিবাদীদের হলুদ কার্ড, লাল কার্ড দেওয়া হচ্ছে। ভাববেন, এ কেমন বিচার! তাহলে কি ধর্না দিলে এখন থেকে ‘সমঝোতা’র বদলে কার্ড দেওয়া হবে? আধার-ভোটার-স্বাস্থ্যসাথীর পর আবার নতুন কার্ড? ঠিক তখনই, জানতে পারবেন গুগলবাবু, ফুটবলে, ডিফেন্ডারের বাংলা করেছেন, ‘প্রতিবাদী’।
ক্রিকেট দেখতে বসে যদি দেখেন, অর্থনীতির হার বাড়ছে-কমছে। উদ্বিগ্ন হবেন না। আপনার টাকাপয়সা সহি-সলামত আছে। গুগলবাবু ক্রিকেটে ‘ইকোনমি রেট’কে, বাংলায় ‘অর্থনীতির হার’ লিখেছেন, এটুকু শিখে ফেললেই দেখবেন রক্তচাপ ঠিকঠাক।
শুধু দয়া করে, গুগলবাবুকে সময় জিজ্ঞেস করবেন না। বিশেষত, আপনি দুর্বলচিত্ত হলে তো না-ই। একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, ইংল্যান্ডে দুপুর সাড়ে-তিনটে মানে ভারতে তখন কটা বাজবে? গুগলবাবু, উত্তরে বলেছিলেন, ভারতে আটজন প্রধানমন্ত্রী! বাঁ-হাতে বুকটা চেপে, ডানহাতে ইংরেজি ক্লিক করে জেনেছিলাম, গুগলবাবু বলেছেন, ‘ইন ইন্ডিয়া দেয়ার ইজ এইট পিএম।’
তবে মোটের উপর গুগলবাবু লোকটা নেহাত মন্দ নন। অনেক ইতিবাচক দিকও আছে। এই যেমন, উনি মানুষের মধ্যে বিভেদ করেন না। ধর্মনিরপেক্ষ, উদার প্রকৃতির। ইংরেজিতে ‘Shrine’ শব্দের অর্থ হল ‘উপাসনালয়’। মন্দির-মসজিদ-মঠ-গির্জা-গুরুদ্বার বা যে কোনো কিছুই হতে পারে। গুগলবাবু এসব মানেন না। তিনি রহিমকে মন্দিরে, রামকে মসজিদে কিংবা মাইকেলকে অনায়াসে মঠে পাঠিয়ে দিতে পারেন। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘পারমুটেশন অ্যান্ড কম্বিনেশন’। বিশ্বাস না হলে, বাংলায় বাক্য-রচনা করে গুগল ট্রান্সলেট করে দেখুন। দেখবেন বিভেদ কমে আসবে। পাশের লোকটার সঙ্গে ইন্টার্যাকশন বাড়বে। তবে খবর্দার! গুগলবাবুকে ‘ইন্টার্যাকশন’ শব্দের মানে জিজ্ঞাসা করবেন না যেন! আপনি পাশের জনের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত— এমন কথা যদি উনি বলে দেন, তাহলে আবার আমাকে দোষ দেবেন না যেন!