মা ওরফে উমা আসছেন। কুমোরটুলির প্রতি আমাদের ভালোবাসা ঐতিহাসিকভাবেই অমলিন। পুজোর চার-পাঁচদিন শরীর-মনের সমস্তটুকু দিয়ে দেওয়া যায় এই উৎসবে। আকাশে, কাশফুলে, শরৎ প্রতিমায়। কিন্তু তারপরও একটা প্রশ্ন ইদানীংকালে ঘুরে-ফিরে আসছে, কারণ চোখে পড়ছে অবহেলিত মাটির প্রতিমা। কেন? তাহলে কি ভক্তি শুধুই পুজোর আড়ম্বরে? এ লেখা ভক্তিকে আঘাত করতে নয়, প্রশ্ন করতে চায়। কেন অবহেলিত অবিসর্জিত প্রতিমারা পড়ে থাকবেন আমাদের আশপাশে?
–‘তুমি কি মাটির পুতুল, যে কথা বলো না? কই দেখি!’
উমাপ্রসাদ, সামান্য তুলে ধরল দয়াময়ীর লাজুক আরক্ত মুখ। আমরা সেই মুখ দেখতে পেলাম না। অথচ বিবাহের রাতে, নিখুঁত দয়াময়ীকে দেখার পরে উমাপ্রসাদের মুগ্ধচোখ যেন আমাদেরই। অনন্ত বিস্ময়ে সে কেবল বলে উঠতে পেরেছিল, ‘প্রতিমা!’
এই দৃশ্যের নির্মাতা সত্যজিৎ রায়। ছবির নাম ‘দেবী’। যেখানে গোটা ছবিতেই ‘প্রতিমা’ শব্দটিকে ঘিরে অদ্ভুত এক দ্যোতনা খেলা করতে থাকে। কারণ উমাপ্রসাদ ও তার বাবা, কালীকিঙ্কর– প্রতিমার ধারণায় দু’জনে একেবারে পৃথক। দুই বিপরীত মেরু। মধ্যে একা পড়ে থাকে দয়াময়ী। বিসর্জন হয়নি এমন কোনও প্রতিমার মতো।
কিন্তু, প্রতিমা আসলে কী? উপাদান অনুযায়ী– বাঁশ, খড়, মাটি। একটা মূর্তিমাত্র। এরপরে যখন মূর্তির গায়ে রং পড়ে! ঢালাও সাজগোজ হয়। দশ হাতে দশ অস্ত্র। ডুরে শাড়ি। ক্রমে সে মূর্তি থেকে ঠাকুরে রূপান্তরিত হয়। আর এই রূপান্তরের প্রতিটি ধাপে, আশ্চর্য এক দেবত্ব পলির মতো জমতে থাকে মূর্তিশরীরে। অথচ সে পলি ক্ষণিকের। কালীকিঙ্করের স্বপ্নের মতো। ক্ষণিকের জন্যই প্রতিমা থেকে দেবত্বপ্রাপ্তি। প্রতিমা হলেন মা! তারপর? এ লেখায় এটাই একমাত্র প্রশ্ন।
কলেজ স্কোয়্যার প্রায় ঢেকে ফেলেছে যে সরষের তেলের বিজ্ঞাপন, সে বলছে– মা আসছে। এ-গ্রাম সে-গ্রাম ঘুরে ইন্সটাগ্রামেও, মা আসছে! হ্যাশট্যাগ কাশফুল। হ্যাশট্যাগ কুমোরটুলি। এই মুহূর্তে বাঙালির মোক্ষম গন্তব্য। যে প্রতিমায় রং পড়েছে সদ্য, শরীরে আপাতভাবে জড়ানো লালপেড়ে শাড়ি, সিংহের মুখটা তত পরিণত নয়– সোশ্যাল মিডিয়ায় হেবি ট্রেন্ডিং! নান্দনিকতা একেবারে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। অথবা, অসমাপ্ত কোনও প্রতিমার পাশে বহু রকম পোজওয়ালা মনুষ্য।
জ্যান্ত ও জড়ের এহেন ক্যারিশমা দেখার পরে, এআই নিশ্চিত অথৈ জলে পড়বে। আসলে ‘পুজো আসছে’—– আমাদের যাবতীয় ভক্তি, হুল্লোড়, এগরোল আর সেলফি সেই পুজোটুকুকেই ঘিরে। আগমনের সময়টুকু আর গোটা পাঁচেক দিন। কিন্তু তারপর? কেন দেখতে পাওয়া যায়, না-বিসর্জিত প্রতিমা? এদিকে-ওদিকে? নদীর ধারে, অবহেলিত?
ধূপ-ধুনো কাঁসর-ঘণ্টা একশো ঢাকের বাদ্যি—গোটাটাই একটা উপলক্ষ। দশমী পেরনোমাত্র ঠাকুর হয়ে ওঠে বাতিল দেবতা! যেহেতু আক্ষরিক অর্থে, পুজো শেষ। বিসর্জনটুকুও যেন বাঁ-হাতে দেওয়া অঞ্জলীর মতো সেরে ফেলতে পারলেই, ব্যস! কোথাও প্রতিমা গঙ্গার পাড়েই দাঁড়িয়ে থাকল দারুণ অবহেলায়। কখনও মণ্ডপ থেকে প্রতিমা সরল না। পাহারা দিল একদল কুকুর। ততদিনে খসে গেছে দেবীত্বের পলি। সঙ্গে উবে গেছে অন্তরের ভক্তি। দেখি উপেক্ষার জলহাওয়া লেগে আধখানা মুখ অথবা সাড়ে তিনখানা হাত অথবা ভেঙে যাওয়া ঠোঁট নিয়ে গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন দেবী দুর্গা। কেউ মুখ তুলেও চায় না। চারিদিকে পচাখড়ের গন্ধ কিনা।
রবিঠাকুরের নাটক ‘বিসর্জন’-এর নির্যাস নিয়ে, অঞ্জন দত্ত মঞ্চস্থ করেছিলেন ‘রঘুপতি’। সে নাটকে, শুরু থেকে দেবতা ভেবেছিলাম যে অবয়বকে! জবাফুলের মালা আর অপার ভক্তি আর ভয় দিয়ে গড়া যে মূর্তি! নাটকের ক্লাইম্যাক্সে রঘুপতি সেই মূর্তিকেই ঘুরিয়ে দেন। আমরা দেখতে পাই, সে মূর্তি আসলে একটা চেয়ার। যেখানে বসে দু’দণ্ড জিরিয়ে নিতে পারেন আপনি!
বলতে চাইছি, যতক্ষণ পুজো, ততক্ষণই সে দেবতা। ততক্ষণই কদর তার। কিন্তু নিখাদ ভক্তি কি ফুরোয় কখনও? সে তো শরীর-মনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে আমৃত্যু। তার উল্লাস কম। আবেগের উচ্ছ্বাস কম। দাপাদাপি নেই। ডিজে নেই। কিন্তু, প্রগাঢ়। যেখানে প্রতিমার বিসর্জন হয় আর বিসর্জনের পরেও জ্বলে থাকবে আরাধনার আকাঙ্ক্ষা ও যত্ন। আমার নাস্তিকমন এটুকুই বলে!
ফিরে আসি, ‘দেবী’ ছবির কথায়। কেউ কেউ উমাপ্রসাদের কথায় পুরুষতান্ত্রিক অভিলাষ খোঁজার চেষ্টা করেন। আমার মনে হয়, উমাপ্রসাদের চোখে দয়াময়ী যে প্রতিমা, তার দেবীত্ব ইউনিভার্সাল। সূর্যের মতো সত্যি। বিপরীতে, কালীকিঙ্করের মনপ্রতিমায় দেবীত্ব বড় ঠুনকো। যার বিসর্জন সম্পূর্ণ হয় না। সবশেষে পরিণত হয় রাক্ষসীতে। কী আশ্চর্য দেখুন! ঈশ্বরের থেকেই জন্ম নিল শয়তান। দুর্গন্ধ। সংবাদ বলছে, পুরনো কাঠামোয় জল জমতে জমতে ডেঙ্গু।
কিন্তু এসবের পরেও, মনে থেকে যায় একটি দৃশ্যপট। তা বিসর্জন না হওয়ারই দৃশ্য থেকে উঠে আসা। একটি কবিতা। সুমন্ত মুখোপাধ্যায়ের–
কয়েকজন বাতিল দেবতা দেবদেবী
আমার সঙ্গেই কোনো অন্তিম বাসের খোঁজে
বটতলায় দাঁড়িয়ে ছিলেন
কারো চুল আছে কোনো মুখ নেই
বুকের পাঁজর খড়ের
ইঁদুর যথেষ্ট রয়েছে শুধু
গণেশটি উধাও
সুউচ্চ কুচের নারকেল মালায় কোনো
মাটি নেই কটি নেই সীমন্তের পাটি নেই
হাতের ভঙ্গিমা শুধু ফুল নেই ফল নেই
গদা শঙ্খ চক্র নেই ত্রিশূল খাঁড়া না
শুধু বরাভয় মুদ্রাটি কেবল
সবার সমান আছে
বাস থামানোর জন্য
রেশন কার্ডের জন্য
জ্বালানি তেলের জন্য
শীতের কাঁথার জন্য
জাতীয় দলের জন্য…
বরাভয় মুদ্রা জেগে থাক। জেগে থাক আমাদের উৎসব। কিন্তু প্রতিমার প্রতি অযত্নও যেন না ঘটে। পুজো শুধু যেন ভক্তির প্রদর্শনী হয়ে না ওঠে। দেবত্ব, দেবীত্ব আরোপের পর, তাকে যেন ফের আমরা অবহেলিত মাটির প্রতিমা করে ফেলে না রাখি। উমা ঠিকঠাক বিদায় না দিলে, পরের বছর উমা আসবে কী করে?