প্রকাশক কথামতো অগ্রিম ২০০০ টাকা তুলে দিয়েছিলেন প্রফুল্ল রায়ের হাতে। লেখকের সন্দেহ হয়। এইটুকু বাচ্চা, এত টাকা– নিশ্চয়ই চুরি করেছে। কিছু না বলে শুধু বলেছিলেন নাম-ঠিকানা লিখে দিয়ে যাও, আর বলেছিলেন, অমুক দিন বিকেলে আমি আসব। এসেছিলেন উনি। গলির মাথা থেকে নিয়ে এসেছেন সেই খুদে প্রকাশক। নিয়ে এসেছিলেন তাঁর বাবার কাছে। লেখককে বলেছিলেন, ‘এই আমার তৃতীয় সন্তান নতুন প্রকাশনা করেছে, আপনারও একটা বই করতে চায়।’ আরও অনেক কথার পরে মুঠোয় রাখা সেই ২০০০ টাকা সেই খুদে প্রকাশকের বাবার হাতে দিয়ে যান, আর জানিয়ে যান খুদেকে কবে তাঁর কাছে যেতে হবে। সেই ১৯৭১ সালে ‘আলোয় ফেরা’ বই প্রকাশের মধ্য দিয়ে দে’জের সঙ্গে সম্পর্ক শুরু। সদ্যপ্রয়াত প্রফুল্ল রায়ের স্মৃতিচারণা…
গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে আমার বন্ধু শ্রীকুমারকে সঙ্গে নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলাম রাণীকুঠিতে, প্রফুল্ল রায়ের বাড়িতে। আমার বাবা সুধাংশুশেখর দে তাঁর প্রকাশনা জগতে কাটানো ৫০ বছরের স্মৃতিকথা লিখছেন। বাবার সঙ্গে সেই শুরুর কথা জানতে প্রফুল্লজেঠুর কাছে যাওয়া। তখনই দেখি ৯১ বছরের লেখকের স্মৃতিতে পলি জমতে শুরু করেছে। নিজের বইয়ে সই করতে গিয়ে তিনবার কেটেছেন। আমি এই প্রফুল্ল রায়কে আগে দেখিনি।
৭০-এর গোড়ার দিক। ৩৬ বছরের এক লেখকের বাড়ি গিয়েছিলেন ১৭ বছরের এক তরুণ প্রকাশক। ‘আমরা নতুন প্রকাশনা করেছি, আপনার বই প্রকাশ করতে চাই’– এই ছিল প্রকাশকের প্রথম উক্তি।
লেখকের সন্দিহান চোখে সেই প্রকাশকের বর্ণনা শুনেছিলাম অনেক পরে। ‘রোগাপাতলা হাফপ্যান্ট পরা একটা ছেলে আমাদের বেহালার বাড়িতে কড়া নেড়েছিল।’
– কী চাই?
– আপনার একটা বই প্রকাশ করতে চাই।
– আমি তো অগ্রিম না নিয়ে বই দিই না।
– কত টাকা অগ্রিম আনব?
– ২০০০ টাকা।
– আচ্ছা। কবে নিয়ে আসব?
সেই সময় ২০০০ টাকা অনেক। যদিও সেই লেখক কয়েকদিন পরে সকালে আসতে বলেছিলেন। প্রকাশক গিয়েছিলেন সেই নির্দিষ্ট সময়ে। কিন্তু কোনও এক কাজে লেখক বেরিয়ে গিয়েছিলেন। ফিরতে বেশ সময় নিয়েছিলেন। সেই দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষার মধ্যে প্রকাশক পেয়েছিলেন মাতৃসম বউদিকে। যিনি এক অপরিচিত অনামী এক তরুণকে দুপুরে অন্ন জুগিয়েছিলেন (আজ তিনিও নেই)। সেই লেখক যখন ফিরলেন, একটু বিরক্ত হয়েই বলেছিলেন, ‘কে এসেছে?’ শুনেছি জেঠিমার কাছে, তোর জেঠুকে খুব বকেছিলাম, ‘আসতে বলো তার পরে ভুলে যাও, সেই সকাল থেকে এসে বসে আছে কিছু না খেয়ে! আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবে?’
প্রকাশক তার পরে সেই ২০০০ টাকা লেখকের হাতে তুলে দেন। এতে সেই লেখকের সন্দেহ আরও গভীর হয়। এইটুকু বাচ্চা, এত টাকা– নিশ্চয়ই চুরি করেছে। কিছু না বলে শুধু বলেছিলেন নাম-ঠিকানা লিখে দিয়ে যাও, আর বলেছিলেন, অমুক দিন বিকেলে আমি আসব। এসেছিলেন উনি। গলির মাথা থেকে নিয়ে এসেছেন সেই খুদে প্রকাশক। নিয়ে এসেছিলেন তাঁর বাবার কাছে। লেখককে বলেছিলেন, ‘এই আমার তৃতীয় সন্তান নতুন প্রকাশনা করেছে, আপনারও একটা বই করতে চায়।’ আরও অনেক কথার পরে মুঠোয় রাখা সেই ২০০০ টাকা সেই খুদে প্রকাশকের বাবার হাতে দিয়ে যান, আর জানিয়ে যান খুদেকে কবে তাঁর কাছে যেতে হবে। সেই ১৯৭১ সালে ‘আলোয় ফেরা’ বই প্রকাশের মধ্য দিয়ে দে’জের সঙ্গে সম্পর্ক শুরু।
বাবার ‘প্রফুল্লদা’ কখন যে আমার ‘গল্পজেঠু’ হয়ে উঠলেন, মনে নেই। নব্বইয়ের শেষের দিকে সপ্তাহে দু’-তিনবার প্রফুল্লজেঠুর বাড়িতে এসে গল্প শোনা নিয়ম হয়ে গিয়েছিল। এই গল্প বইয়ের গল্প নয়, গল্প গড়ে ওঠার কাহিনি, বন্ধুদের আড্ডার গল্প, সিনেমার গল্প।
তখন প্রফুল্ল রায় বোম্বেতে থাকতেন। একদিন হৃষীকেশ মুখার্জি তাঁর বাড়িতে প্রফুল্ল রায়কে ডেকেছেন। প্রফুল্লজেঠু হৃষীকেশ মুখার্জির বাড়িতে ঢুকতেই এক ডজনের বেশি কুকুর এসে ঘিরে ধরেছিল।
– এই তোমরা বিরক্ত করো না, যাও।
প্রফুল্লজেঠু আমায় বলেছিলেন, একটা কুকুরও হৃষীকেশ মুখার্জির কথা শোনেনি। সব ক’টা আমার পায়ের কাছে বসেছিল। আমি তো কথাই বলতে পারছি না। চুপ করে ‘হুম’, ‘হ্যাঁ’ করছি। একটু বাদে প্লেটে করে যখনই খাবার এল– কুকুরগুলো আবার সজাগ হয়ে উঠে দাঁড়াল। কয়েকটা কুকুর ইতিমধ্যেই প্লেটে কী দিয়েছে– তা নাক ফুলিয়ে গন্ধ নিয়েছে। হঠাৎ একটা কুকুর প্লেটে জিভ বুলিয়ে দেয়। এমন কাণ্ড দেখে প্রফুল্লজেঠু কী করবেন, বুঝতে পারছেন না। এদিকে হৃষীকেশবাবু বলতে শুরু করেছেন, ‘প্রফুল্লবাবু খেয়ে নিন…’
একদিন ‘আমাকে দেখুন’ উপন্যাস তৈরির গল্প বলছিলেন। উত্তমকুমার খুব আগ্রহী হয়েছিলেন এই গল্প নিয়ে সিনেমা করতে। শেষপর্যন্ত সিনেমাটা হয়নি, কিন্তু কীভাবে উপন্যাসটি তৈরি হল তার মজার গল্প বলেছিলেন–
একদিন বোম্বেতে সমুদ্রের পাড় ধরে হাঁটছেন, হঠাৎ দেখেন এক গোয়ানিজ ভদ্রলোককে ঘিরে আছে ফুটপাথে থাকা মানুষজন। সেই ভদ্রলোক একের পর এক ঘিরে থাকা মানুষগুলোকে বিলি করছেন নতুন জামা। পরে, আবার একদিন ওই গোয়ানিজ ভদ্রলোককে দেখছেন ঝুড়ি ঝুড়ি ফল এনে বিলোতে। এমন একজন মানুষকে সামনে পেয়ে প্রফুল্লজেঠু আলাপ করেন। জিজ্ঞাসা করেন, ‘এত জিনিস আপনি কীভাবে জোগাড় করেন?’
– ভারতে ৮০ কোটি মানুষ। তার ওয়ান পার্সেন্ট লোককে টুপি পরিয়ে আমি এগুলো নিয়ে আসি। আমার নিজের কোনও সেভিংস নেই।
এই মানুষটিকে নিয়েই লিখলেন ‘আমাকে দেখুন’।
প্রফুল্লজেঠুর প্রথম থ্রিলার উপন্যাস ‘চরিত্র’ পড়ে খুব রেগে গিয়েছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। ফোনে বলেছিলেন, ‘তুমি শেষে থ্রিলার লিখছ!’
এমন কথা শুনে প্রফুল্লজেঠুর ভীষণ মনখারাপ হয়েছিল। জেদের বসে খুব অল্প সময়ে লিখে ফেলেন আরও একটি উপন্যাস। ‘এক্ষণ’ পত্রিকায় সেই উপন্যাস ছাপা হয়। উপন্যাস প্রকাশের প্রায় দু’মাস পরে প্রেমেন্দ্র মিত্র ফোন করেন। বলেন,
– এই যে উপন্যাস ‘রামচরিত্র’-এর লেখক প্রফুল্ল রায়, সে কি তুমি?
– হ্যাঁ।
– যে ‘রামচরিত্র’ লেখে, সে কেন ‘চরিত্র’ লিখবে!
উত্তরে প্রফুল্ল জেঠু বলেন,
–যিনি ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ লেখেন, তিনি কেন ‘পরাশর’ লেখেন!
প্রফুল্লজেঠুর স্মৃতিশক্তি ছিল অসম্ভব! বাংলাদেশে ছেলেবেলার দুরন্তপনার গল্পগুলো ছিল অসাধারণ। তখন প্রফুল্লজেঠু স্কুলে পড়েন। খুব সম্ভবত, ক্লাস থ্রি। সদ্য স্কুলে পরিবেশ বিজ্ঞান পড়েছেন। একদিন প্রফুল্লজেঠুর বাড়িতে তাঁদের পরিবারের গুরুদেব এসেছিলেন। চেয়ারে বসে গুরুদেব, আর তাঁর পায়ের নিচে একটি কাঁসার থালা। সেই থালায় গুরুদেবের পা-ধোয়া জল। শুধু বাড়ির লোকে নয়, গ্রামের বহু মানুষ সেই জল পান করতে ভিড় করেছেন। প্রফুল্লজেঠু স্কুল থেকে ফিরেছেন। তাঁর ঠাকুরমা সেই জল পান করতে বলেন। প্রফুল্লজেঠু বলেন,
– আমি দেখছি গুরুদেবের ফাটা ফাটা পা। বালি-কাদায় নোংরা ঘোলাটে জল। এই জল আমায় খেতে বলছে। থালার পাশে একটা আধলা ইট পড়েছিল। আমি সেই ইট তুলে গুরুদেবের পায়ের বুড়ো আঙুলে সজোরে মেরে ছুটে বাড়ি থেকে পালিয়েছি। তিনদিন বাড়ি ফিরিনি। ছোটবেলার সেই দুষ্টুমির মিষ্টি স্মৃতিগুলো লিখে ফেলার কথা বলি। তিনি লিখে ফেললেন ছেড়ে আসা সেই বাংলাদেশের গল্প। নাম দিলেন ‘যখন যা মনে পড়ে’।
বাংলাদেশে স্কুল জীবনে আর একটা কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। খুব সম্ভবত, তিনি তখন ক্লাস সেভেনে। তাঁদের গ্রামে সাপের খেলা দেখাতে এসেছে বেদেরা। এই বেদেরা এক একটা গ্রামে অনেক দিন কাটান। তাঁদের গ্রাম থেকে বেদেদের দল যেদিন ফিরে যাবেন বজরায়, প্রফুল্লজেঠু বাড়িতে কাউকে কিছু না জানিয়ে উঠে পড়েছিলেন তাতে। ন’দিন পরে জল-পুলিশ প্রফুল্লজেঠুকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। মনের সেই স্মৃতি বইয়ের পাতায় লিখে ফেলেন। নাম দেন ‘বেদের নৌকায়’।
এমনই সব গল্প শুনতে যখন তখন চলে যেতাম প্রফুল্লজেঠুর বাড়ি।
‘যৌনতার পাঠশালা’র ভাবনা শুরুই হয়েছিল যৌনতা নিয়ে ‘যা খুশি তাই বলা’ বা ভাবার লাইসেন্স নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করার জন্য যে, যৌনতা মানে কে কাকে কার সঙ্গে শুয়ে পড়তে চায় সেই সংক্রান্ত তাল পাকানোই শুধু নয়, যৌনকর্ম এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে আলোচিত হতে পারে।