এমন এক ফেস সেভিং অ্যাক্ট সুকুমারের প্যাঁচাবাবুও করেছেন গিন্নির চিৎকারকে খাসা উপমায় ভরিয়ে দিয়ে। ‘খাসা’ উপমা লাগিয়ে মুখের ওপর চ্যাঁচানির অভিযোগ করেও পার পেয়ে গেলেন। শুধু তাই নয়, দিব্যচোখে ভেবে দেখুন, এর পরে পেঁচক ম্যাডামের সাংসারিক প্রোডাক্টিভিটি অনেকখানি বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর তাতে সবথেকে লাভবান হতে পারেন প্যাঁচাবাবু স্বয়ং। এখন মনে হচ্ছে না, সুকুমারের প্যাঁচা বড় শিশুসুলভ নয়, প্যাঁচালের প্র্যাগম্যাটিক্স তিনি ভালোই বোঝেন? মনে হচ্ছে না প্যাঁচার প্যাঁচালও বড় প্যাঁচময়?
প্যাঁচা কয় প্যাঁচানি খাসা তোর চ্যাঁচানি। হঠাৎ পড়লেন, বা শুনলেন। এবং হাসলেন। হাসিরই কথা। কিন্তু শুধুই কি হাসির কথা? একটা মুশকিলের কথাও নয়? আপনাকেই যদি টুক করে প্রশ্ন করে বসি, আপনি কেন হাসলেন? আপনি হয়তো বলবেন, ওখানে প্যাঁচানির চ্যাঁচানিকে ‘খাসা’ বলা হয়েছে, তাই হেসেছি। কিন্তু ব্যাপারটা তো ওখানেই শেষ হচ্ছে না। আপনি তো ছাপ্পান্ন ইঞ্চি সাহস করে বলছেন না, প্যাঁচানি ম্যাডামের চ্যাঁচানির মধ্যে আপনার মহিলাদের কথা বলার (প্যাঁচাল পাড়ার) চেনা গাঁটগুলো (আপনি যেহেতু চারপাশে বাল্যকাল থেকেই শুনে আসছেন– মেয়েরা কথা বলে কম, চ্যাঁচায় বেশি) সম্পর্কে অর্জিত ধারণাও কিছুটা এখানে সমর্থন পেয়ে আপনাকে হাসিয়েছে! অথবা ওই গিন্নির কান ঝাঁ-ঝাঁ করানো চ্যাঁচানির সামনে কর্তার অনিবার্য মিনমিনে অসহায় আত্মসমর্পণের কল্পদৃশ্য (এটাও আপনি বাল্যকাল থেকে চারপাশে শুনেছেন) সম্পর্কে আপনার লালিত মনোভাব এখানে কি একটু আশকারা পাচ্ছে না? সেটাও কি আপনার হাসির কারণ নয়? আর যে মুশকিলের কথা বলেছিলাম সেটা হল, ওই প্যাঁচানিটি যদি কর্তৃত্বজ্ঞাপক চ্যাঁচানিটি না দিতেন এবং সেই চ্যাঁচানিটির সামনে যদি প্যাঁচা মহোদয় নতজানু না হতেন, তবে কি দাম্পত্যপ্রেমের প্রচলিত (বাড়িতে মিঞা জিরো বিবি আসল হিরো) মুখটি হুমকির সামনে পড়ত না? অর্থাৎ আপনার অর্জিত অভিজ্ঞতাগুলো রসবঞ্চিত ম্যাড়মেড়ে হয়ে আপনার হাসির কারণ হওয়ার পথে খামোখা সমস্যা সৃষ্টি করত না? আপনি যদি সহমত হন, তো বিঙ্গো! আপনি প্যাঁচালের দুরূহ প্র্যাগম্যাটিক্স বেশ খানিকটা বুঝে গিয়েছেন। বুঝে গিয়েছেন ফেস থ্রেটনিং অ্যাক্ট বা এফ.টি.এ বলতে ভাষাবিজ্ঞানীরা কী ধরতে চাইছেন। প্র্যাগম্যাটিক্স নামে ভাষার মারপ্যাঁচ, ভাবমূর্তির প্যাঁচঘোঁচ নিয়ে একটা জটিল আলোচনাক্ষেত্র ওঁরা ভেবেছেন, ভাবছেন। আমরা অজান্তেই সেই জটিল প্যাঁচালো ভাষিক সংবর্তনক্রিয়ায় অহরহ অংশ নিচ্ছি। কিন্তু সেটা নিয়ে ভাবছি কই? অবাক হচ্ছি কই?
স্টিফেন হকিং একটা মজার কথা তাঁর বিখ্যাত সময়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বইটার অবতারণা করতে গিয়ে বলেছিলেন। সেটা হল, এই যে পৃথিবীটা বনবন করে ঘুরছে, আর আমরা ছিটকে না পড়েও ঠিক ঠিক এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় হেঁটে বা ছুটে চলে যাচ্ছি, সেইটুকু ভাবলেই তো বিস্ময়ের শেষ থাকার কথা নয়! মাথার ওপর এমন একখান নীল রঙের ঢাউস আকাশ, সেখানে আবার কিছু পাখি উড়ছে, অথচ আমি উড়ছি না! ভাবলে অবাক হওয়ারই তো কথা! ভাষার ক্ষেত্রেও কিছু জায়গা অবাক করা। আপনি চুপিচুপি মাথায় সেঁটে বসে আছেন ভাষা মানে বুঝি ভাব প্রকাশের জন্য কতকগুলো শব্দ, যাদের কিছু অর্থ আছে, এবং সেগুলো পরপর আইন মেনে বসিয়ে বলে যাওয়া। ব্যাস! মিটে গেল? আচ্ছা, ভাবুন তো, এই বর্ষাকালের কথাই ভাবুন, একজন বাড়ির বাইরে যাচ্ছেন, আপনি বললেন– ‘বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু’। এবার ভেবে দেখুন, তিনি তো দেখতেই পাচ্ছেন বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। তাহলে আপনি সেটা গলা তুলে বলতে গেলেন কেন? আসলে আপনার বলার উদ্দেশ্য ছিল, তিনি এই বৃষ্টির মধ্যে যে বাইরে যাচ্ছেন, প্রয়োজনীয় ছাতা বা বর্ষাতি নিয়েছেন কি না! কিন্তু আপনার ‘বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু’ কথাটায় লাগানো শব্দগুলোর দিকে চাইলে যা অর্থ, সেখানে সে কেবলই জানাচ্ছে ঘরের বাইরে জল পড়ছে। একটা ইনফরমেশন কেবল। ওখানে ছাতাটাতা কিছু নেই কিন্তু। তবে ওই না বলা শব্দগুলো এল কোথা থেকে? এল বক্তা আর শ্রোতা ওই মুহূর্তে যে কথার মারপ্যাঁচের অদৃশ্য অন্তর্বয়নে অংশ নিলেন, সেখান থেকে। আজ্ঞে হ্যাঁ, সহজ কথায় ভাষার ওটাই প্র্যাগম্যাটিক্স। আর ওই প্র্যাগম্যাটিক্স আলোচনা করতেই করতেই নানা সম্ভাবনার প্রসঙ্গে এফ.টি.এ-র মতো সজীব অভিনব অবাক করা একটা বিষয় চলে এসেছে।
কথা হচ্ছে, কথার ‘মারপ্যাঁচ’ নিয়ে। সে তো কেবল কথার কথা নয়! মুখের কথাও নয়। মুখ বলতে আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিই, মুখ একটা থাকে না মানুষের। না, রাবণের কথা বলছি না, আমার আপনার মতো সাধারণ মানুষের কথাই বলছি। সেখানেও মুখ একটা নয়। একটা মুখে কথা বলা হয়। সেখানে মুখ বাগযন্ত্রের পোরশান। আর এক মুখ ‘মরাল কারেজ’, সৎ সাহস বলি যাকে। আপনি বলে থাকবেন কখনও কখনও ‘আমার আর বলার মুখ নেই’। আর এক মুখ হল কথা বলার ঢং। আপনি তো জানেনই কতজন ‘মিষ্টি মুখে’ কার্যসিদ্ধি করে বেরিয়ে যান! একটা ভাবমূর্তির মুখ আছে। যেমন ‘দলের মুখ’। ভোট-টোটের বাজারে তাঁদের হেব্বি চাহিদা। একটা মুখ অবশ্যই প্রকৃতিদত্ত চর্ম-লালিত্য-মেকাপের ত্রিবেণী সংগম, যেটি সুন্দর হলে নাকি সর্বত্র সহজ জয় পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর একটা মুখ তৈরি হয় সামাজিক প্রত্যাশায়। সেই মুখটা ধরেই প্র্যাগম্যাটিক্সে খুব নাড়াচাড়া চলে। ওই মুখটিতে হেব্বি ঝকমারির ব্যাপার রয়েছে। যেমন ধরুন, আপনি ভোট দিচ্ছেন এক নেতাকে। অর্থাৎ আপনি যে বকলসটা নিজের গলায় পরে আছেন তার লিশটা একজনের হাতে তুলে দেবেন। কেমন লোকের হাতে তুলে দেবেন? উচ্চশিক্ষিত, ব্যক্তিত্বপূর্ণ, চরিত্রবান, খুব নম্র, একটাও মিথ্যে বলবেন না, সর্বদা মৃদু কণ্ঠে কথা বলবেন, পাবলিকের পয়সায় এক কাপ চা-ও খাবেন না, ভোটের পরেও আপনি তাঁর কোলে উঠে পড়তে পারবেন– এমন লোককে? তত্ত্বগতভাবে হয়তো সেটাই। কিন্তু বাস্তবে? আপনি চান এমনি লোক দেশ শাসন করুক? বিকল্প না পেয়ে ছুঁচোর বংশধরদের নির্বাচিত করেন বললে তো চলে না। ওটা অজুহাত। ৭৫ বছর ধরে, মানুষ চাইলে, ভারতের অন্তত ৫০ শতাংশ নেতা পূর্বে বলা প্যারামিটারগুলো সিদ্ধ করত।
আসলে আপনারা মনে মনে নেতার একটা মুখ ভেবেই নিয়েছেন, যে মুখের মালিক একজন খুব মোটা দাগের দগদগে ব্যক্তিত্বের লোক। মোটেই সুবিধের নন এমন কেউ। অর্থাৎ তাঁর একটা নেগেটিভ ফেস বা ঋণাত্মক মুখ সমাজে প্রচলিত। তিনি যদি বেশি নম্র হন, আপনি তাঁকে ‘মিনমিনে’ বলবেন, ‘পাপ্পু’ বলবেন, ‘লেডিস স্পেশাল’ বলবেন। অর্থাৎ বিনয়ী স্বভাব এক নেতার ক্ষেত্রে ফেস থ্রেটনিং অ্যাক্ট হয়ে উঠতে। একে ভাষাবিজ্ঞানীরা বলছেন থ্রেট টু নেগেটিভ ফেস। অর্থাৎ নেতা ওঁচা কথাই বলবেন, মঞ্চে উঠে বাতুলের স্বপ্ন দেখাবেন, খিস্তি করবেন, আপনি তাঁর মতের বিরুদ্ধতা করলে আপনার বাপের নাম খগেন করে দেওয়ার চেষ্টা করবেন। তাঁর ঋণাত্মক ভাবমূর্তি কেন? কারণ আমাদের মধ্যে সকলেই তো সুবিধের নই। যাঁরা নই, তাঁরা সুযোগ পেলেই নানা অপকম্ম করে বসতে পারি। সেটা সামলাতে একটা কর্তৃত্বের সুর লাগবে, একটা ভয় পাওয়ানো লাগবে। কোয়েসিভ পাওয়ার। আপনিও জানেন সেটা কোনও শিক্ষিত ভদ্র মিনমিনে মানুষের দ্বারা হবে না। অর্ডার করতে হবে, রিকোয়েস্ট করলে আমি শুনব না। আমি শক্তের ভক্ত। খিস্তি খেয়েই সিধা হব। তাই নেতাকে ধমকি দেওয়া, খিস্তি দেওয়া অভ্যাস করতে হয়। এখন যা অনাবিল অভ্যাস হল তা তো রেখেঢেকে ব্যবহার করা যায় না! ফলে নেতা সর্বত্র খিস্তি মারতে, মিথ্যে কথা বলতে আল্ট্রা প্রো-ম্যাক্স শিল্পী হয়ে গেলেন। তাঁর হাতে সজ্জন-নিরীহ মানুষও ক্রমাগত লাঞ্ছিত হতে থাকলেন। একই পদ্ধতিতে নেগেটিভ ফেস তৈরি হল পুলিশের, কিছু সরকারি অধিকারিকেরও। সবই সমাজ-মনোবৈজ্ঞানিক প্রতিক্রিয়া। সরলতা, নম্রতা, ভদ্রতা এই নেগেটিভ ফেসের পক্ষে এফ.টি.এ।
আবার সমাজে পজিটিভ ফেসও রয়েছে। যেমন শিক্ষক, আধ্যাত্মিক গুরু ইত্যাদি। প্রত্যাশিত তিনি ভদ্র কাজ-কথায় অভ্যস্ত হবেন। তাঁর মুখে যদি আপনি দু’-অক্ষর চার-অক্ষর শোনেন, সেখানে তৈরি হবে থ্রেট টু পজিটিভ ফেস। নির্বোধ সমালোচনা, অবমাননাকর ব্যবহার ফেস থ্রেটনিং অ্যাক্ট হিসেবে বিবেচিত হবে পজিটিভ ফেসের ক্ষেত্রে। আপনি জানতে চাইতে পারেন এসব জেনে কী হবে? জানলে অনেক লাভ। প্রকৃতিদত্ত মুখটি ঘষেমেজে জনপ্রিয় করে উঠতে না পারলেও আপনি আপনার সামাজিক মুখ অন্তত সামলে চলতে পারবেন। আপনার সামাজিক অবস্থান নেগেটিভ হলে আপনি ইচ্ছাকৃত এফ.টি.এ তৈরি করে আপনার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করতে পারবেন। আপনার কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ স্বাস্থ্যকর করে তুলতে পারবেন। আপনার অধীনস্ত কর্মচারীদের প্রোডাক্টিভিটি বাড়াতে পারবেন। এমনকি প্রেমিক-প্রেমিকারও। আর আপনার ‘সোশ্যাল ফেস’ পজিটিভ হলে তাকে এফ.টি.এ থেকে রক্ষা করতে পারবেন।
কথার প্যাঁচ যেন আপনাকে প্যাঁচামুখো হিসেবে সমাজে সুবিদিত না করে তোলে, সেই বিষয়ে যত্নবান হওয়াও তো জরুরি! একে বলে ফেস সেভিং অ্যাক্ট বা এফ.এস.এ। কীভাবে করবেন? ধরুন, বাচ্চারা খেলতে যাবে। তাদের এক বন্ধুকে তারা ডাকল যে কিনা খেলার বলটির মালিক। পত্রপাট জানতে পারল সেই বন্ধুটিকে রোদ থাকার কারণে খেলতে বাইরে পাঠানো যাবে না। এখন যদি কেউ একজন বলে, ঠিক আছে, বলটা দিয়ে দিন। সেটা অর্ডার। নেগেটিভ ফেস তৈরি করতে পারে আবেদনকারীর। কিন্তু তার জায়গায় কেউ যদি বলে, তাদের বন্ধুটি যদি বাইরে নাও আসতে চায় সেক্ষেত্রে কি বলটা কিছুক্ষণের জন্যে বাইরে খেলতে আসতে পারে? তাহলেই ফেস সেভিং অ্যাক্ট তৈরি হল। এমন এক ফেস সেভিং অ্যাক্ট সুকুমারের প্যাঁচাবাবুও করেছেন গিন্নির চিৎকারকে খাসা উপমায় ভরিয়ে দিয়ে। ‘খাসা’ উপমা লাগিয়ে মুখের ওপর চ্যাঁচানির অভিযোগ করেও পার পেয়ে গেলেন। শুধু তাই নয়, দিব্যচোখে ভেবে দেখুন, এর পরে পেঁচক ম্যাডামের সাংসারিক প্রোডাক্টিভিটি অনেকখানি বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর তাতে সবথেকে লাভবান হতে পারেন প্যাঁচাবাবু স্বয়ং। এখন মনে হচ্ছে না, সুকুমারের প্যাঁচা বড় শিশুসুলভ নয়, প্যাঁচালের প্র্যাগম্যাটিক্স তিনি ভালোই বোঝেন? মনে হচ্ছে না প্যাঁচার প্যাঁচালও বড় প্যাঁচময়?