দাঁড়কাকের অশুভ খ্যাতি তার জৈবিক বৈশিষ্ট্য এবং বহু শতাব্দী ধরে মানুষের গল্পের মিশ্রণে গড়ে উঠেছে। জাপানে, এর ডাক এবং কবরস্থানে খাওয়ার অভ্যাস তাকে ‘মৃত্যুর লক্ষণ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ভারত একে যম এবং পূর্বপুরুষের আরাধনার সঙ্গে মিলিয়ে এক পবিত্র এবং ভয়ংকর রূপ দিয়েছে।
১২.
প্রাচীন ভারতে, খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০-এর কাছাকাছি, কাক, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রচলিত দাঁড়কাক, প্রাচীন হিন্দুগ্রন্থ এবং আচার-অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল। ‘ঋগ্বেদ’ যদিও দাঁড়কাককে ‘অশুভ’ বলে উল্লেখ করেনি, কিন্তু পরবর্তীকালে, খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ থেকে খ্রিস্টাব্দ ৫০০ সালের মধ্যে রচিত অনেক ধর্মীয় গ্রন্থ এদের যমরাজ বা বলা ভালো, মৃত্যুর দেবতার সঙ্গে যুক্ত করে ফেলেছিল। সামাজিক জীবনে দাঁড়কাকের দুর্লভ উপস্থিতি এবং মৃতদেহ খাওয়ার অভ্যাসের জন্যই সম্ভবত এই ধারণা তৈরি হয়েছিল।
খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দে দাঁড়কাক শ্রাদ্ধের আচার-অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পূর্বপুরুষদের জন্য নিবেদন করা খাদ্য যদি দাঁড়কাক খেত, তবে তা পূর্বপুরুষদের খাদ্যগ্রহণের চিহ্ন হিসেবে বিবেচিত হত, যা একটি সুলক্ষণ বলেও মান্যতা পেয়েছিল। তবে আবার এই পরলোকের সঙ্গে সম্পর্কের জন্যই বেচারা দাঁড়কাকের মাথায় অচিরেই চড়ে বসল অন্ধকার খ্যাতির মুকুট। কোনও বাড়ির কাছে দাঁড়কাকের জোরালো ডাককে গণ্য করা শুরু হল মৃত্যু বা বিপদের ‘দৈব সতর্কতা’ হিসেবে। এই বিশ্বাসটি সম্ভবত প্রথম শতাব্দীতেই ভারতবর্ষের লৌকিক গল্পে নথিবদ্ধ হয়, যা এই কৃষ্ণবর্ণ পাখিকে একই সঙ্গে পরলোক এবং আতঙ্কের এক অদ্ভুত রূপক হিসেবে খাড়া করল আমাদের সমাজে।
জাপানের প্রাচীনতম লিখিত নথি– ‘কোজিকি’ এবং ‘নিহন শোকি’, ৭১২ থেকে ৭২০ সালের মধ্যে সংকলিত, তিন পায়ের কাক ইয়াতাগারাসু-র কথা বলে, যিনি সূর্যদেবী আমাতেরাসু-র ঐশ্বরিক দূত ছিলেন। এই পৌরাণিক কাক, সম্ভবত দাঁড়কাকের প্রাধান্য দ্বারা অনুপ্রাণিত, সম্রাট জিম্মুকে পথ দেখিয়েছিলেন, যা জ্ঞান এবং ঐশ্বরিক সাহায্যের প্রতীক। নারা যুগে– ৭১০ থেকে ৭৯৪ সাল পর্যন্ত, দাঁড়কাক শিন্তো মন্দিরে পূজিত হত, কিন্তু কবরস্থানে তাদের খাওয়ার অভ্যাস তাদের একটি অন্ধকার ভাবমূর্তি দিতে শুরু করে। সমাধিস্থলে দাঁড়কাকের খাওয়ার অভ্যাসের ফলে এই বিশ্বাস জন্মায় যে, তাদের ডাক মৃত্যু বা বিঘ্নের সংকেত দেয়। ৭০০ শতকের শেষের দিকে, ‘দাঁড়কাক যখন কাঁদে, কেউ মারা যায়’ এই কথাটি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। দাঁড়কাকের জোরালো ডাক শান্ত পরিবেশে প্রতিধ্বনিত হত অস্থিরতার প্রতীক হিসেবে।
প্রাচীন চিনে, খ্রিস্টপূর্ব ২২১ থেকে খ্রিস্টাব্দ ৫০০ সাল পর্যন্ত, দাঁড়কাক বিভিন্ন কাক প্রজাতির মধ্যে একটি অশুভ লক্ষণের নাম ছিল মাত্র। শানহাইজিং, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকে খ্রিস্টাব্দ প্রথম শতাব্দীর একটি গ্রন্থ, দাঁড়কাককে যুদ্ধ বা বিপর্যয়ের চিহ্ন হিসেবে বর্ণনা করে সম্ভবত তাদের গাঢ় পালক এবং যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে থাকা সৈন্যদের মৃতদেহ খাওয়ার কারণে। হান রাজবংশের সময়, খ্রিস্টপূর্ব ২০৬ থেকে ২২০ সাল পর্যন্ত, ‘হান শু’ নামক নথিতে দেখা যায় যে মানুষ দাঁড়কাককে ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য ব্যবহার করত, বিশেষ করে ছাদে বা গুরুত্বপূর্ণ ভবনের কাছে তাদের উপস্থিতি ছিল আসন্ন বিপদের সতর্কতা। পূর্ব এশিয়ায় প্রচলিত দাঁড়কাকের অন্ধকার খ্যাতির মুকুটই সম্ভবত এই বিশ্বাসে ভূমিকা রেখেছিল।
মধ্যযুগে, ১০০০ থেকে ১৫০০ সাল পর্যন্ত, জাপানে দাঁড়কাকের অশুভ খ্যাতি আরও শক্তিশালী হয়। হেইয়ান যুগ (৭৯৪-১১৮৫) এবং কামাকুরা যুগে (১১৮৫-১৩৩৩) শিন্তো ও বৌদ্ধ বিশ্বাসের মিশ্রণ দাঁড়কাককে মৃত্যুর সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত করে। কোঞ্জাকু মোনোগাতারি, ১১২০ সালের কাছাকাছি রচিত একটি গল্প সংকলন, যেখানে দাঁড়কাকের ডাক বা উপস্থিতি বিপর্যয়ের পূর্বাভাস দেয়। মুরোমাচি যুগে (১৩৩৬-১৫৭৩), দাঁড়কাকের ডাক যে আসলে মৃত্যু বা দুর্ভাগ্যের সংকেত দেয়– এই বিশ্বাস ব্যাপক হয়ে ওঠে। বিশেষ করে গ্রামীণ লোককথায় কবরস্থানে কাকের উপস্থিতি এই অশুভ চিত্রকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
ভারতে, এই সময়ে, দাঁড়কাক হিন্দু এবং জৈন ঐতিহ্যে দ্বৈত ভূমিকা পালন করেছিল। পিতৃপক্ষ সময়ে, পূর্বপুরুষ পূজার বার্ষিক সময়ে, কাকের নিবেদন খাওয়া একটি ইতিবাচক চিহ্ন হিসেবে দেখা হত।
‘গরুড় পুরাণ’ এই দাঁড়কাককে আত্মার বাহক বা যমের দূত হিসেবে বর্ণনা করে মৃত্যুর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক জোরদার করে। স্থানীয় গল্পে দাঁড়কাকের অস্বাভাবিক আচরণ, যেমন অদ্ভুত সময়ে ডাকা বা বাড়িতে প্রবেশ, অশুভ বলে বিবেচিত হত। এর ফলে উত্তর ভারতের কিছু অংশে, মাথায় পাতিকাকের বসাকেও অসুস্থতা বা আর্থিক ক্ষতির পূর্বাভাস হিসেবে বিশ্বাস করা হত। যদিও দাঁড়কাককে সবসময় অন্য কাকের থেকে আলাদা করা হয়, এবং সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় দাঁড়কাকই কুসংস্কারের প্রধান প্রার্থী।
চমকপ্রদ ভাবে ১৫০০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত, জাপানের মানুষ দাঁড়কাকের সঙ্গে এক অদ্ভুত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করে। যার ফলে দাঁড়কাকের সংখ্যা শহরে ফুলে-ফেঁপে ওঠে। এরা মূলত আবর্জনাই খুঁজে খেত এবং বড় দলে বাসা বাঁধত। ব্যাপারটা জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে একটা নেতিবাচক খ্যাতি লাভ করল। সপ্তদশ শতাব্দীর ভূতের গল্প এবং প্রবাদে দাঁড়কাককে দুর্ভাগ্যের প্রতীক হিসেবে দেখানো, রাতে তাদের ডাক বিশেষভাবে অশুভ বলে গণ্য করা ও ফাঁসির মাঠে, যেখানে এই দাঁড়কাকরা মৃতদেহের অবশিষ্টাংশ খেত, সেখানে তাদের এই অন্ধকার মাখা মর্যাদা আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে, শহুরে গল্পে দাঁড়কাক প্রায়ই বিঘ্নের প্রতীক ছিল, যদিও গ্রামীণ শিন্তো অনুশীলনে ইয়াতাগারাসুকে ঐশ্বরিক সম্মান করা হত, যা দাঁড়কাকের দ্বৈত পরিচয় প্রকাশ করে।
থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনামে, এই সময়ে, দাঁড়কাকের অশুভ প্রতীক হিসেবে ভূমিকা তার ব্যবহারিক ভূমিকার তুলনায় গৌণ ছিল। ষোড়শ শতাব্দী নাগাদ, বৌদ্ধ এবং আনিমিস্ট ঐতিহ্য দাঁড়কাককে সম্ভাব্য আত্মা হিসেবে দেখত, তাদের ডাক কখনও কখনও দুঃসংবাদের সতর্কতা হিসেবে ব্যাখ্যা করা হত। এই বিশ্বাসগুলি, চিনা ও ভারতীয় প্রভাবে গড়ে উঠে সেখানকার গ্রামীণ এলাকায় টিকে ছিল। আধুনিক যুগে, ১৮০০ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত, জাপানে দাঁড়কাক একটি সাধারণ দৃশ্য, প্রায়ই তার বুদ্ধিমত্তা এবং শহরে আবর্জনা লুটপাটের জন্য ক্ষতিকারক হিসেবে দেখা হয়। মেইজি যুগে, ১৮৬৮ থেকে ১৯১২ সাল, শহুরে মানুষ ক্রমশ দাঁড়কাকের এই বিরক্তিকর আচরণের দিকে মনোযোগ দেয়, কুসংস্কারের চেয়ে বেশি। তবে, গ্রামীণ গল্পে দাঁড়কাকের ডাক মৃত্যু বা দুর্ভাগ্যের সংকেত হিসেবেই প্রচলিত থেকে যায়। বিংশ শতাব্দীতে, জাপানি সাহিত্য, ভৌতিক চলচ্চিত্র এবং অ্যানিমে দাঁড়কাকের এই অশুভ ভাবমূর্তিকে জোরদার করে। অপরদিকে, ইয়াতাগারাসু আবার শুধু পৌরাণিক কাহিনি প্রেক্ষাপটেই আর টিকে থাকে না, বরং জাপান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের প্রতীক হিসেবেও স্থান পায়, যা এই পাখির দীর্ঘস্থায়ী দ্বৈত ভূমিকার স্বাক্ষর বহন করে।
ভারতে, আধুনিক যুগে, দাঁড়কাক পিতৃপক্ষ সময়ে তার আচার-অনুষ্ঠানের গুরুত্ব বজায় রাখে, কিন্তু স্থানীয় গল্পে এর অশুভ ধারণা এখনও টিকে আছে। ১৯ ও ২০ শতকের গবেষণায় এমন বিশ্বাসও নথিবদ্ধ হয়েছে যে, দাঁড়কাকের ডাক বা অস্বাভাবিক আচরণ অসুস্থতা বা আর্থিক ক্ষতির পূর্বাভাসও দেয়। উদাহরণস্বরূপ, রাজস্থানের কিছু অংশে, দাঁড়কাকের বাড়িতে প্রবেশ চরম অশুভ বলে গণ্য করা হয়।
বিশ্বব্যাপী, বিশ ও একুশ শতাব্দীতে, গথিক সাহিত্য এবং ভৌতিক মিডিয়া দাঁড়কাকের অশুভ ভাবমূর্তিকে ছড়িয়ে দিয়েছে, যা এশিয়ায় দাঁড়কাকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দাঁড়কাককে ‘ভয়ংকর’ বা ‘অতিপ্রাকৃত’ হিসেবে চিত্রিত চলচ্চিত্র এবং গল্পও ঐতিহ্যবাহী এই বিশ্বাসকে শক্তিশালী করেছে। তবে, আধুনিক ঝাঁ-চকচকে শহুরে প্রেক্ষাপটে, ক্ষতিকারক হিসেবে দাঁড়কাকের খ্যাতি তার কুসংস্কারের ভূমিকাকেও ছাপিয়ে গেছে।
……………………………
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
……………………………
দাঁড়কাকের অশুভ খ্যাতি আসলে তার জৈবিক বৈশিষ্ট্য এবং শতাব্দী ধরে মানুষের গল্পের মিশ্রণে গড়ে উঠেছে। জাপানে, এর ডাক এবং কবরস্থানে খাওয়ার অভ্যাস এটিকে মৃত্যুর লক্ষণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ভারত একে যম এবং পূর্বপুরুষের আরাধনার সঙ্গে মিলিয়ে এক পবিত্র এবং ভয়ংকর রূপ দিয়েছে। চিন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, এর অশুভ প্রতীকী ভাব কম হলেও ছিল, স্থানীয় বিনিময়ের প্রভাবে। আজ, শহুরে মানুষ প্রায়ই এর বিরক্তিকর আচরণের দিকে মনোযোগ দেয়, কিন্তু গ্রামীণ গল্পে দাঁড়কাকের ভয়ংকর উত্তরাধিকার আজও টিকে আছে, যা দাঁড়কাককে পাকাপাকি ভাবে করে তুলেছে ব্রাত্য, অপয়া, অপ্রয়োজনীয় যাকে অ্যাপেন্ডিক্সের মতো বাদ দিয়ে দিলেও কারও কিছু যায় আসে না।
……………..অপয়ার ছন্দ অন্যান্য পর্ব……………..
পর্ব ১১। শুধু একটা হ্যাঁচ্চো– বলে দেবে কীভাবে বাঁচছ
পর্ব ১০। অপয়ার ছেলে কাঁচকলা পেলে
পর্ব ৯। চোখের নাচন– কখনও কমেডি, কখনও ট্র্যাজেডি!
পর্ব ৮। জুতো উল্টো অবস্থায় আবিষ্কার হলে অনেক বাড়িতেই রক্ষে নেই!
পর্ব ৭। জগৎ-সংসার অন্ধ করা ভালোবাসার ম্যাজিক অপয়া কেন হবে!
পর্ব ৬। প্রেম সেই ম্যাজিক, যেখানে পিছুডাক অপয়া নয়
পর্ব ৫। ডানা ভাঙা একটি শালিখ হৃদয়ের দাবি রাখো
পর্ব ৪। জন্মগত দুর্দশা যাদের নিত্যসঙ্গী, ভাঙা আয়নায় ভাগ্যবদল তাদের কাছে বিলাসিতা
পর্ব ৩। পশ্চিম যা বলে বলুক, আমাদের দেশে ১৩ কিন্তু মৃত্যু নয়, বরং জীবনের কথা বলে
পর্ব ২। শনি ঠাকুর কি মেহনতি জনতার দেবতা?
পর্ব ১। পান্নার মতো চোখ, কান্নার মতো নরম, একা
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে গত ৬০-৭০ বছরের পরিসংখ্যান কী বলছে? আইন অনুযায়ী, ১৮ বছরের নিচে বিবাহ ও সন্তান ধারণ করা যায় না, গ্রামগুলিতেও পৌঁছে গেছে সরকারি হাসপাতালের সুযোগ-সুবিধা, এক্ষেত্রে মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যে ভারত ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছে?
আমরা নিজেরাও আমাদের চারপাশের মানুষ সম্পর্কে একটা নির্দিষ্ট ধারণা গড়ে নিই। সেই ধারণাকে ঘিরে একটা বেড়া তৈরি করি। সেখান থেকে কেউ একটু এদিক-ওদিক হলেই মুশকিল! ঋতুদা, আমাদের ঋতুদা– সে সারাক্ষণ নানা বৌদ্ধিক আড্ডার শিরোমণি, তাকে সেটুকু দেখতেই আমি স্বচ্ছন্দ, হিসেবের বাইরে হলে, মেলাতে অসুবিধে। ঋতুদার যে একটা অন্য মন থাকতে পারে, ভেবেই দেখিনি কখনও।