কে কীভাবে খাবে– আমেরিকান রাজনীতির যেমন অংশ করে তোলা হল বেমক্কা, তেমনই কে কী খাবে ও কেন খাবে– এ নিয়ে ঢের দিন রাজনীতি হল আমাদের দেশে। তোমার টিফিনবাক্সে মাংস কেন, উত্তর চায় রাষ্ট্র। তুমি শনিবারে মাছ খেয়েছ কেন, উত্তর চায় রাষ্ট্র। এ-রাজনীতি করে বিশ্বগুরু হওয়া সম্ভব কি? তেমনই নিউ ইয়র্কের কোনও মেয়র চামচ দিয়ে বিরিয়ানি খেলেই আমেরিকা ‘গ্রেট’ হয়ে যায় না।
আসলে সবাই বলছে, ঘেন্না করতে। ইহজগতের ভালোবাসার পরিসর ক্ষয়ে ক্ষয়ে একেবারে ক্ষুদ্র। আপনার ভালোবাসায় বা মতাদর্শে যে অসম্মত, অনুগত নয় কিংবা আপনার তৈরি করা সুন্দরের প্যারামিটারে যে মানুষ আঁটছে না কোনও মতেই– সে হয় আপনার জানে দুশমান। প্রতিপক্ষ! অথচ এ-লড়াইয়ে যুদ্ধের যাবতীয় রুলবুক ধুচ্ছাই করে, আপনি অস্ত্র হিসেবে কেবলমাত্র পাকড়েছেন ঘৃণা। যেমন আমেরিকার অতি-দক্ষিণপন্থী পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্ট লরা লুমার। নিউ ইয়র্কের মেয়র পদপ্রার্থী জোহরান মামদানির (Zohran Mamdani) উদ্দেশ্যে লিখলেন: মামদানির জন্ম যে উগান্ডায়, তা খাওয়ার ধরন দেখেই টের পাওয়া যাচ্ছে। আমার বাড়ির কুকুরগুলো মামদানির চেয়ে সভ্য এবং সাফ। কে খায় হাত দিয়ে? ডিজগাস্টিং!
ট্রাম্পপ্রীতি আমাদের দেশে প্রবল। সুচিন্তিত হত্যা অথবা গণহত্যায় খুব একটা খেই হারাই না এখন। ইতিহাসের শিকড়ে ঘুণ, তবু নিশ্চিত মগজে গেঁথে আছে পরাধীন ভারতবর্ষে রেস্তরাঁর দরজায় সেঁটে দেওয়া একটা নোটিস: ‘ডগস অ্যান্ড ইন্ডিয়ান্স নট অ্যালাউড।’ প্রথম বিশ্বের সেই ঔপনিবেশিক মন, সেই বর্ণবাদের পুঁজভরা মনগুলো বোধ করি বদলে যায়নি। সমগ্র তৃতীয় বিশ্বের প্রতি সেই দৃষ্টি থেকেই ফিরে ফিরে আসে, মানুষ ও কুকুর সমতুল্য।
জোহরান মামদানি কে? নিউ ইয়র্কের মেয়রপ্রার্থী। ডেমোক্র্যাট। সোশালিস্ট। প্যালেস্তাইনের পক্ষে। ফিল্মমেকার মীরা নায়ার এবং কলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাহমুদ মামদানির সন্তান। একটি ভিডিওতে দেখা গেল, জোহরান বিরিয়ানি খাচ্ছেন। যথারীতি হাত দিয়ে। ডোনাল্ড ট্রাম্প, রিপাবলিকান পার্টি এবং মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন (MAGA) ক্যাম্পেইন– সকলের আঁতে ঘা পড়েছে তাই। তুমি কী অসভ্য, হ্যাঁ! নিউ ইয়র্কের মেয়র হতে চাইছ অথচ বিরিয়ানি খাবে হাত দিয়ে? ছি! তৃতীয় বিশ্বে ফিরে যাও। যেন আমেরিকা তোমায় খেদিয়ে দিতে পারলে বেঁচে যায়।
আক্ষরিক অর্থেই বেঁচে যায়। কারণ তৃতীয় বিশ্বের রক্ত, ধর্মে মুসলিম, তার ওপর সোশ্যালিজমের প্রচারক। আমেরিকার সমস্ত প্যারামিটারেই জোহরান ‘বেমানান’। তিনি জলবায়ুর কথা বলেন। অভিবাসনের কথা বলেন। এম্প্যাথির কথা বলেন। প্যালেস্তাইন আপনার রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ কেন? জোহরান বলছেন, তৃতীয় বিশ্বের মাটিতে বেড়ে উঠেছি আমি। প্যালেস্তাইনের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে আমার সমঝোতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রথম বিশ্বের মতো নয়। সহজেই অনুমেয়, কেন রিপাবলিকানদের চক্ষুশূল হয়েছেন!
পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে ছুরি, চামচ ও কাঁটাচামচ দিয়ে খাওয়াটাই রেওয়াজ। টেবিল এটিকেটের শামিল। তবে ‘ফিঙ্গার ফুড’ বলে একটি শব্দবন্ধটি আবিশ্বে জনপ্রিয়। অর্থ হয়, যে সমস্ত খাদ্য হাত দিয়েই খাওয়া চলে আরামসে। বহু আমেরিকান নাগরিক বলছেন– পিৎজা, বার্গার, ফ্রায়েড চিকেন, ট্যাকোস কি তবে ছুরি আর কাঁটাচামচ দিতে খেতে হবে? তাহলে জোহরান মামদানি হাত দিয়ে বিরিয়ানি খেলে আপত্তি কী! নীতি-পুলিশের নাক সুড়সুড় করে বুঝি কিঞ্চিৎ? হতেই পারে, আপনি বিরুদ্ধদল। রিপাবলিকান। কিন্তু আঘাত করুন যোগ্য যুক্তির কারসাজি দিয়ে। বরং দ্বিধাহীনভাবে এ-কথা বলা যায়, জোহরান মামদানি আপন সংস্কৃতি, তৃতীয় বিশ্বের সংস্কৃতি লালন ও পালন করতে শিখেছেন দুর্দান্ত। অপর সংস্কৃতিকে বাঁকা চোখে না দেখেই। আপনি পারছেন? উঁহু। পাঁচতারা রেস্তোরাঁয় বসে আপনার বন্ধুটি যদি স্ট্রেট হাত দিয়ে চিলি চিকেন খেতে শুরু করেন, নির্ঘাত মুখ টেরিয়ে যায়! অস্ফুটেই বলে ওঠেন, বাঙালি যে কবে ‘ম্যানার্স’ শিখবে! সিলভিয়া প্লাথের একটি উপন্যাসের কথা মনে পড়ে। ‘দ্য বেল জার’। তিনি লিখেছেন: I’d discovered, after a lot of extreme apprehension about what spoons to use, that if you do something incorrect at table with a certain arrogance… nobody will think you are bad-mannered or poorly brought up. They will think you are original and very witty.
হে পাঠক, মনোযোগ দিন দু’টি শব্দে। ‘অরিজিনাল’ এবং ‘উইটি’। এইবার একটি মোক্ষম প্রশ্ন পেড়ে ফেলা যাক! ম্যানার্সের চক্করে জোম্যাটোর ডেলিভারি বয়কে ভেবেছেন না-মানুষ। সহনাগরিককে ভেবেছেন মিম। বাড়ির পাশের বৃক্ষসমান দুটো শিরীষ গাছ কেটে, প্রতি মঙ্গলবার নিদারুণ হনুমান চালিশা পাঠ করে ভেবেছেন, আহ্! চমৎকার ধার্মিক হওয়া গেল! একটা আশ্চর্য ডিপফেক মোড়ক শরীরে পেঁচিয়ে বেঁচে আছেন বাঙালিভাই, না অরিজিনাল, না উইটি। ইলিশমাছের কাঁটা বাছতে কাঁটাচামচ ট্রাই করতে পারেন। খাসা রগড় হবে মশাই!
কে কীভাবে খাবে– আমেরিকান রাজনীতির যেমন অংশ করে তোলা হল বেমক্কা, তেমনই কে কী খাবে ও কেন খাবে– এ নিয়ে ঢের দিন রাজনীতি হল আমাদের দেশে। তোমার টিফিনবাক্সে মাংস কেন, উত্তর চায় রাষ্ট্র। তুমি শনিবারে মাছ খেয়েছ কেন, উত্তর চায় রাষ্ট্র। এ-রাজনীতি করে বিশ্বগুরু হওয়া সম্ভব কি? তেমনই নিউ ইয়র্কের কোনও মেয়র চামচ দিয়ে বিরিয়ানি খেলেই আমেরিকা ‘গ্রেট’ হয়ে যায় না। শুধুমাত্র কতকগুলো সংকুচিত মন পৃথিবীর আয়নায় ধরা দেয়। বরং দুই ভিন্ন সংস্কৃতির এহেন মেলবন্ধনের গণতান্ত্রিক ক্ষেত্রটিকে অতি-দক্ষিণপন্থীরা পাত্তাই দেখলেন না। আশা করাটাও বেকুবের কাজ। ভেবে দেখুন, নিউ ইয়র্কের জনগণ, পাশ্চাত্যের মানুষ এমন কাউকে মেয়র পদে নিযুক্ত করতে চাইছে, যে কিনা হাত দিয়ে ভাত খায়! সমান্তরাল পথে একটা নির্মাণ ও বিনির্মাণের রাস্তা তৈরি হচ্ছে, রেসিজমের অন্ধ, কালো চোখগুলো অল্প আলো পাচ্ছিল হয়তো(?)– সেই মুহূর্তেই ডোনাল্ড ট্রাম্প বলছেন, জোহরান মামদানিকে জেলে বন্দি করবেন। শুরুতেই বলছিলাম যে কথা, আমার প্যারামিটারে তোমাকে মাপতে পারছি না, তাই তুমি আসামি। অসুন্দর। পাপী। তুমি আমার ব্যাকরণে কথা বলছ না, তাই তুমি দেশদ্রোহী। যে কারণে ১২৪৮ দিন ধরে উমর খালিদ কারাগারে। বিচারহীন। শেষ যখন তিনি সূর্যের আলোয় মুখ ধুয়েছিলেন, একটা মুষ্টিবদ্ধ হাত ছুড়ে দিয়েছিলেন। আসলে ডোনাল্ড ট্রাম্প, ট্রাম্পের সমর্থক, অনুগামী, কিংবা ট্রাম্পের বন্ধু নরেন্দ্র মোদি– প্রত্যেকেই ভুলে গিয়েছেন এ-সভ্যতা, আমাদের যাবতীয় রোয়াব ও খোয়াব নির্মাণ করেছিল নগ্ন মলিন হাত। যখন আমরা ছিলাম উদোম। অসভ্য। ম্যানার কিংবা এটিকেটলেস। পৃথিবীর প্রাচীনতম সত্য সেটিই। তার কিছু কিছু না চাইতেও থেকে যাবে উত্তরাধিকারের মতো। অনন্তকাল।
ক্রিকেট তো আসলে জীবনের কথাই বলে। যে জীবন লড়তে জানে। লড়ে জিততে জানে। এমন লড়াইয়ের মঞ্চে কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গ মেলবন্ধন– এমনটাই তো চেয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। চেয়েছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। কৈশোরের স্বপ্নের মাঠে সেই আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে পরিণত করলেন বাভুমা।