মিডিয়ার কিছু নিউজপ্রিন্ট আজ-কাল খরচ হবে বটে, কিন্তু তারপর এ ইনিংস চলে যাবে ধুলোজমা রেকর্ডবুকের তলানিতে। লারার ৪০০-এর ওপরে থাকলে যা বুকমার্কের মতো জরুরি হতে পারত– তা রয়ে যাবে ফুটনোট হয়ে। কিন্তু ক্রিকেটের এ কিস্সার কাছে বারেবারে কি মুল্ডার আমাদের নত করবে না? অদৃশ্য ছায়ার মতো? থেকেও না থাকা কোনও অবয়ব হয়ে এ ইনিংসখানা কি টেস্টের সেই ব্যতিক্রম টাইমমেশিন হয়ে থাকবে না, যা আমাদের ফেরাবে পুরোনো কিছু স্মৃতির কাছে?
অতি সাধারণ, প্রায় ধুলোয় মিশে থাকা কাঁকড়, খালি পায়ে সামান্য অস্বস্তি ব্যতীত যা নেহাতই অস্তিত্বহীন– তেমনই নগণ্য উইয়ান মুল্ডারের টেস্ট কেরিয়ারখানা। খান তিনেক সেঞ্চুরি, একটি বাংলাদেশের বিপক্ষে, বাকি দু’টি জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে। দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটে মুল্ডারের যা ব্যাটিং পারফরম্যান্স, তাতে সর্বকালের সেরা তো দূর অস্ত, বর্তমান ব্যাটিং কিংবা অলরাউন্ডারদের স্ট্যাটাসেও তিনি প্রথমদিকে থাকবেন না। কিন্তু ওই যে, মাঝে মাঝে ক্রিকেট এমন কিছু মুহূর্তের জন্ম দেয়, যেখানে চরিত্রকে আচমকা নামিয়ে দেওয়া হয় স্পটলাইটের নিচে। জাত-অভিনেতা হলে সে সামলে নেয় অভ্যাসে, নইলে আনাড়ি হাত-পা চালিয়ে কোনওক্রমে বৈতরণি পার– মুল্ডারের ৩৬৭ রানের ইনিংসখানা অনেকটা তেমনই– অপ্রত্যাশিত! মুল্ডার, সেই জমকালো আলোয় অনভ্যস্ত যুবক হয়েও স্থাপন করে গেলেন এক অদ্ভুত কীর্তি; এমন কিছু, যা বালির ঘর– সময়ের সামান্য ঢেউ-এ যে কীর্তি ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যাবে।
তবু, মুল্ডার করে দেখালেন। ৩৬৭ রান। এক ইনিংসে। রেকর্ডবুক বলছে জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে এই ইনিংসটি টেস্টে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের ইনিংসের তালিকায় ৫ নম্বরে থাকবে। ব্রায়ান লারার ৪০০ নট আউট, ম্যাথু হেডেনের ৩৮০, লারার ৩৭৫ এবং মাহেলা জয়বর্ধনের ৩৭৪-এর পরেই মুল্ডারের ইনিংস। কিন্তু মজার ব্যাপার হল এই যে, এর আগে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের কাছাকাছি এসে সেই রানকে স্পর্শ না করে কেউ কখনও ইনিংস ডিক্লেয়ার করেনি। হেডেন লারার রেকর্ড ভেঙেছেন, লারা ফের ভেঙেছেন হেডেনের রেকর্ড আর মাহেলা তো ৩৭৪ রানে উইকেট হারিয়েছেন। কিন্তু মুল্ডারই প্রথম, যিনি এক ইনিংসে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ টেস্ট স্কোরের সামনে দাঁড়িয়ে বেমালুম ইনিংস ডিক্লেয়ার করে দিলেন!
……………………………..
মুল্ডারের মতো অতিসামান্য আন্তর্জাতিক স্ট্যাট-সম্পন্ন ক্রিকেটারের সামনে ব্রায়ান লারার মতো মহীরুহ– যাঁর রেকর্ড ভাঙার মতো পরিস্থিতি বকলমে এক দুঃসাহস, যেন ‘বামুন হয়ে চাঁদে হাত’-এর মতো মর্যালিটির সুতো টেনে রেখে দিল মুল্ডারকে। স্টিভ ওয়ার বিদায়ী টেস্টে সিডনিতে তাঁর মাঠে নামার মুহূর্তখানা স্মরণে আসে– ভারতকে ব্যথায় জর্জরিত করা ওয়া শেষ ইনিংসে মাঠে নামার সময়ে, সিরিজ ডিসাইডার টেস্টের স্নায়ুযুদ্ধের মধ্যেও আস্ত ভারতীয় দল হাততালি দিয়ে তাঁকে সম্মান দিচ্ছে।
……………………………..
দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে এই তাঁর প্রথম টেস্ট অধিনায়কত্ব। আর তাতেই কি না ‘নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত!’ আজ যদি মুল্ডার লারার রেকর্ড ভেঙে দিতেন, তবে ইতিহাস নিশ্চিতভাবেই মনে রাখত না স্কোরবোর্ডের পাশে প্রতিপক্ষ হিসেবে জিম্বাবোয়ের নাম। টেস্টে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রান-শিকারি হিসেবে নাম খোদাই হত মুল্ডারের। ম্যাথু হেডেনের ৩৮০ রানের ইনিংসের প্রতিপক্ষ যে জিম্বাবোয়ে, তাই বা কতজন মনে রেখেছে? কিন্তু একথা নিশ্চিত ভাবে জেনেও মুল্ডার ডিক্লেয়ারের সিদ্ধান্ত নিলেন।
নেহাতই দলের স্বার্থে এই আত্মত্যাগ? উঁহু! স্কোরবোর্ডের দিকে তাকালে একথা তো ক্রিকেটে সদ্য চোখেখড়ি হওয়া কিশোরও বুঝে যাবে যে, মুল্ডার আর ৩০টা রান করতে একটা আস্ত দিন নিয়ে নিলেও ম্যাচের ফলাফলের তেমন পরিবর্তন হত না। জিম্বাবোয়ে ম্যাচ প্রায় হেরেই গিয়েছে। এখানে এই ‘কেন’-র একেবারে সরাসরি উত্তর মুল্ডার স্বয়ং দিয়ে দিয়েছেন। কী বলছেন তিনি?
‘ব্রায়ান লারা একজন কিংবদন্তি, তাঁর রেকর্ড অটুট রাখা একজন ক্রিকেটার হিসেবে আমার কাছে সম্মানের। আমি যদি এ জীবনে আবার কোনওদিন এই রেকর্ড ভাঙার সুযোগ পাই– আমি একই কাজ করব।’
মুল্ডারের মতো অতিসামান্য আন্তর্জাতিক স্ট্যাট-সম্পন্ন ক্রিকেটারের সামনে ব্রায়ান লারার মতো মহীরুহ– যাঁর রেকর্ড ভাঙার মতো পরিস্থিতি বকলমে এক দুঃসাহস, যেন ‘বামুন হয়ে চাঁদে হাত’-এর মতো মর্যালিটির সুতো টেনে রেখে দিল মুল্ডারকে। স্টিভ ওয়ার বিদায়ী টেস্টে সিডনিতে তাঁর মাঠে নামার মুহূর্তখানা স্মরণে আসে– ভারতকে ব্যথায় জর্জরিত করা ওয়া শেষ ইনিংসে মাঠে নামার সময়ে, সিরিজ ডিসাইডার টেস্টের স্নায়ুযুদ্ধের মধ্যেও আস্ত ভারতীয় দল হাততালি দিয়ে তাঁকে সম্মান দিচ্ছে। টেস্ট ক্রিকেটের চিরন্তন রয়্যালিটি। প্রতিপক্ষকে চাউনিতে মেপেও প্রয়োজনে টুপি খুলে রাখা– এ সম্ভ্রম আসলে ক্রিকেটের আভিজাত্যের মৃতপ্রায় শরীরের ওপর ফুটে ওঠা জুঁইচারা।
রেকর্ডবুকের আগ্রাসনের ভিড়ে, তারকা-মহাতারকাদের একে অপরকে ছাপিয়ে যাওয়ার ভিড়ে মুল্ডার নেহাতই সেই ওসমান গনি– চিলেকোঠার সেপাই– লড়ে যাওয়া দুর্বল বিরুদ্ধস্রোত। মিডিয়ার কিছু নিউজ প্রিন্ট আজ-কাল খরচ হবে বটে, কিন্তু তারপর এ ইনিংস চলে যাবে ধুলোজমা রেকর্ড বুকের তলানিতে। লারার ৪০০-এর ওপরে থাকলে যা বুকমার্কের মতো জরুরি হতে পারত– তা রয়ে যাবে ফুটনোট হয়ে। কিন্তু ক্রিকেটের এ কিস্সার কাছে বারেবারে কি মুল্ডার আমাদের নত করবে না? অদৃশ্য ছায়ার মতো? থেকেও না থাকা কোনও অবয়ব হয়ে এ ইনিংসখানা কি টেস্টের সেই ব্যতিক্রম টাইমমেশিন হয়ে থাকবে না, যা আমাদের ফেরাবে পুরনো কিছু স্মৃতির কাছে? প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়ার দৌড়ের পাশে নির্লিপ্তভাবে বসে থাকা কোনও মগ্ন বালকের কাছে? নিশ্চিতভাবেই ফেরাবে।
উইয়ান মুল্ডার যে রেকর্ড না ভেঙেও বন্ধ হয়ে যাওয়া কুঠুরির তালা ভেঙে নতুন ভাবনার পাখিদের উড়ে যাওয়ার অনেকটা আকাশ দিলেন– এই বা কম কী?
…………………………..
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
…………………………..