এতদিনের সমস্ত আধার তুড়ি মেরে উড়িয়ে এল নতুন কাগজের খোঁজ। ১৯৮৭-র জুলাই মাসের আগে জন্মালে লাগবে ১১ রকমের যে কোনও একটি কাগজ। তাতে বহু কষ্টে সংগৃহীত আধার নেই। না, রেশন কার্ডও নেই। না আছে ১০০ দিনের কাজের জব কার্ড। আছে ১১টা কাগজের নতুন ফর্দ। এই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আর্থিক দিক থেকে ও জাতিগত দিক থেকে পিছিয়ে থাকা শ্রেণি। তারপর কাগজ দিতে না পারলে…?
আচ্ছা, মানচিত্রটা চিবিয়ে খেলে তার স্বাদ কেমন হবে? নিশ্চিত তার স্বাদ হবে মানুষের মাংসের মতো। কাঁটাতার দিয়ে আলাদা করে রাখা ভূখণ্ডগুলোর মাঝে কি শুধুই কাঁটাতার? অসংখ্য মানুষের রোজকার ক্ষত, মাংসপিণ্ড, দুমড়ে-মুচড়ে দেওয়া স্বপ্ন সেই কাঁটাতারে ঝুলে। কাঁটাতার দিয়ে বানানো সীমানাগুলো আসলে সেলাই করা মানুষের ক্ষরণ। মানুষের মনের তীব্র হাহাকার।
যেমন গাজা ভূখণ্ডের চারিদিকে আটকে রাখা তারে আছে শুধুই মানুষের ক্ষুধা, বোমা বিস্ফোরণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আসা মাংসপিণ্ড। ভাবছি, একদিন মানচিত্রটা চিবিয়ে খাব। চিবিয়ে চিবিয়ে ছিবড়ে করে খাব মানচিত্র। মানচিত্র চিবিয়ে খেলে কি মুছে যাবে সব কনসার্টিনা ওয়ার? আর মুক্ত হবে পৃথিবী? কেউ চাইবে না কাগজ, কাগজ আর কাগজ?
লম্বা লাইন, রিক্ত, নিঃস্ব ঘামে ভেজা মানুষগুলোর লাইন। কাগজ চাইছে। কে চাইছে– জানার শক্তি নেই, জানার ক্ষমতা সেই লাইনের নেই। তাই লাইনে ভিড় বাড়ছে। বেড়েই চলছে। কবে থেকে সেই লাইন দাড়িয়ে? জানা নেই। হয়তো অনন্তকাল। বাপ দাঁড়িয়ে ছিল, তার বাপ, তার বাপও। এই তো কিছুদিন আগেও খামচাখামচি আধার কার্ড নিয়ে। কার্ড যদি-বা হয়, তারপর নাম ভুল। সেই আধার ঠিক করতে আবার লাইন। ১০০ দিনের কাজের জব কার্ড। অমুক বড় নেতা, তমুক বুথ সভাপতির বাড়িতে লাইন। সারাদিন কাজ না করতে পেরে, পেটে লাথি দিয়ে লাইন। কাগজ চাই। কাগজ। তারপর?
নানা সময় আসে নানা বিধান। আর নতুন করে আসে কাগজের খোঁজ। এখন যেমন বিহারে চালু হয়েছে স্পেশাল ইনটেনসিভ ভোটার লিস্ট-এর জন্য কাগজপত্রের নিরীক্ষণ।
এতদিনের সমস্ত আধার তুড়ি মেরে উড়িয়ে এল নতুন কাগজের খোঁজ। ১৯৮৭-র জুলাই মাসের আগে জন্মালে লাগবে ১১ রকমের যে কোনও একটি কাগজ। তাতে বহু কষ্টে সংগৃহীত আধার নেই। না, রেশন কার্ডও নেই। না আছে ১০০ দিনের কাজের জব কার্ড। আছে ১১টা কাগজের নতুন ফর্দ। এই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আর্থিক দিক থেকে এবং জাতিগত দিক থেকে পিছিয়ে থাকা শ্রেণি। তারপর কাগজ দিতে না পারলে…?
উত্তর আছে অসমে।
খায়রুল ইসলাম। বহু বছর চাকরি করার পর হঠাৎ তাকে পুশ ব্যাক করা হল নো ম্যানস্ ল্যান্ড-এ। দু’ পাশে দুটো দেশের মাঝের ভূখণ্ড, বড় বড় প্রসাদ তুলে কত বড় মোটা সংবিধান নিয়ে দাঁড়িয়ে। সেই সংবিধানে শুধু বোধহয় খায়রুল ইসলাম নেই। সেদিন কি জোছনা ছিল, নাকি ঘন অন্ধকার? এক মুঠো কাদা তুলে খায়রুলের কি ইচ্ছে করছিল ছুঁড়ে মারে চাঁদটার দিকে। কী দরকার আলোর? যে আলো একমুঠো খাবার দিতে পারে না, ঠেলে দেয় ছিটমহলে। তারপর খায়রুলকে তুলে নিয়ে আসা হল। বলা হল, নাকি ভুল হয়েছে! কে দেবে সেই ভুলের মাশুল? খায়রুল তথা সাধারণ পাবলিক।
বাবুল ইসলাম, মাটিয়া ডিটেনশন ক্যাম্প, গোয়ালপাড়া, অসমের চারপাশে একটি ব্যাগ হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার বাবা আলতাফ ইসলামের খোঁজে। গত সেপ্টেম্বরে যাকে বিদেশি বলে ঘোষণা করা হয়েছিল ফরেনার ট্রাইব্যুনাল-এ। হাইকোর্টে সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানাবে ভাবছিল বাবুল। কিন্তু তার আগেই আলতাফকে পুলিশ তুলে নিয়ে আসে। অসহায় বাবুল এখন খুঁজে বেড়ায় বাবাকে।
আশঙ্কা করা হচ্ছে দু’ কোটির ওপরে লোক বিহারে ভোটাধিকার হারাতে পারে। এই দেশে, চরম অর্থনৈতিক বৈষম্যের মাঝে, হয়তো ভোটাধিকারই একমাত্র অধিকার, যা সবার আছে। সেই ভোটাধিকার চলে যাওয়া মানে এক শ্রেণির মানুষের বিপন্ন হতে হতে সম্পূর্ণ মুছে যাওয়া।
ছোট হয়ে আসছে কাঁটাতার। আরও ঘন হয়ে দেশের মধ্যেই যেন জন্ম নিচ্ছে অনেকগুলো দেশ, কাঁটাতারকে স্পষ্ট করে। এই ভারতের লোক হয়েই ভারতে বসবাসকারী পরিযায়ী শ্রমিকদের পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশে, বাংলা ভাষা বলার অপরাধে, বাংলাদেশি মনে করে। একদিকে বুলডোজার দিয়ে বাড়ি ভেঙে ছিনিয়ে নাও পা রাখার মতো জায়গা, আর তারপর দুটো ভাতের খোঁজে বাইরে গেলে বাংলাদেশি সন্দেহে পাঠিয়ে দাও বাংলাদেশ! আধার নাকি নাগরিক হওয়ার প্রমাণপত্র নয়, ভোটার কার্ডও নয়! আরও কাগজ চাই। বাড়ি না থাকা, জায়গা না থাকা মানুষগুলো কাগজ কোথায় পাবে?
এখনও ওড়িশায় আটকে আছে পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাওয়া এক পরিযায়ী শ্রমিকের দল। তাহলে এদেশের মধ্যেই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে কাগজ লাগবে? আর কোন কাগজ? যাদের বাসস্থানের ঠিক নেই তারা কাগজ কোথায় পাবে? আর কাগজ দেখাবেই বা কেন!
গোটা পৃথিবী জুড়েই কর্পোরেট লুটের সুযোগ করে দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ ডানপন্থী সরকারগুলো মিথ্যে শত্রু তৈরি করছে প্রতিনিয়ত। আমেরিকায় শত্রু খাড়া করেছে অভিবাসীদের; ভারতে শত্রু তেমন আদিবাসী, দলিত, মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। অসমে, বিহারে এই অবস্থা দেখে ২০২৬-এ বিধানসভা ভোটের জন্য তৈরি হওয়া পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের বুক কেঁপে ওঠে। যে রাজ্যে কথায় কথায় শুনতে হয়, ‘ও তুমি মুসলমান, আমি ভেবেছিলাম, বাঙালি!’ সে রাজ্যে একবার এই গালভরা, ‘স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন অফ ভোটার লিস্ট’ থুড়ি বকলমে এনআরসি চালু হলে আর রক্ষা থাকবে না।
যে রাজ্যে, যে দেশে তিনবেলার খাবারের সংস্থান এখনও হয়ে ওঠেনি, সেই ভূখণ্ডে মানুষের যা আছে তা-ও কেড়ে নেওয়ার সব ফন্দি নিয়ে হাজির শাসক দল। বুলডোজার দিয়ে ক্রমাগত বাড়ি ভেঙে দেওয়া হচ্ছে অসমে। এই জুলাই মাসের শুরুর দিকেই ভেঙে দেওয়া হয়েছে ১৪০০ বাড়ি। এক গৃহহীন মহিলা বুক চাপড়ে কাঁদছেন আর বলছেন, ‘হিমন্তক হামরা কুন দোষ কইরছি গো? হামার মাথায় বাড়ি দিল গো…’! হৃদয়বিদারক এই কথাগুলো নিয়ে মিম হচ্ছে। খিল্লি করে লোকে বাংলাদেশে চলে যেতে বলছে।
অবশ্য দেশের এক বিশাল জনসংখ্যা কারণে-অকারণে এই শুনতেই এখন অভ্যস্ত যে, ‘পাকিস্তানে যাও’, ‘বাংলাদেশে যাও’! ধুবড়ি থেকে কোচবিহার ফেরত বাস থেকে নামছি চেক পোস্টে। পিছনেই একদল ২০ পেরনো বা তারও কমবয়সি যুবক। পিঠে ব্যাগ। কেমন যেন আলগোছে। এই রুটে যাতায়াতকারী সবাই জানে, এরা সেই গৌহাটি-বিকানের এক্সপ্রেস ধরবে। রোজ বৃহস্পতিবার এদের সাথে মোলাকাত হয় আমার। হ্যাঁ, এরা– এদের একটাই নাম পরিযায়ী। চেপে বসলাম টোটোতে। মেলাচ্ছিল তারা কোনটা খেলে কম দাম পড়বে, পুরি না ভাত!
আমি পাশের জনকে বললাম, ভাই ধুবরি জেলায় তো অনেক বাড়ি ভাঙছে অসম সরকার? একটু থতমত খেল, বলবে কী বলবে না ভেবে আমার দিকে তাকাল, তারপর বলল, ‘আপনি কই যাবেন?’ আমি আমার পুরো নাম বললাম পদবি-সহ, কী কাজ করি তাও বললাম। কোথায় যেন ভরসা পেল, তারপর আস্তে করে, নিচু গলায় বলল, ‘ম্যাডাম হামরা মিয়া মুসলমান। আমাগো জাতের বাড়িই ভাঙছে। কী জানি ক্যান!’
যে রাজ্যে লাখ লাখ লোক প্রতিবছর বন্যার আর ভাঙনের জন্য বাড়িঘর হারায়, তারা কোথায় পাবে এত কাগজ? বিকানেরগামী এই ছেলেগুলির নাম আমি জিজ্ঞেস করিনি। কী হবে জিজ্ঞেস করে। এই দেশ জানে মানুষকে ‘না-মানুষ’ করার রেসিপি। এক কবি যেমন বলে দেন, মানুষকে ‘না-মানুষ’ করার ফর্দ:
কী করে একটি মানুষকে না–মানুষ করা যায়?
ভারতে একজন মানুষকে মুছে ফেলার জন্য
বেশি কিছু করতে হবে না তোমায়
একটি স্বরবর্ণ
অথবা একটি ব্যঞ্জনবর্ণ
পালটে দিতে হবে
অথবা ওলটপালট করে দিতে হবে
জন্ম-তারিখের একটি সংখ্যা।
এজন্য শুধুই দরকার মাউসের একটি খোঁচা।
ব্যস
খায়রুলকে করে দিতে হবে খয়রুল
জামিলাকে জমিলা/জোমিলা
ফাতিমাকে ফতিমা/ফেতিমা।
একটি ভুল উচ্চারণ
ব্যস
একজন মানুষ হয়ে যাবে না-মানুষ।
নেতা চিল্লিয়ে বলবে–
মানুষটির আর কোনও অস্তিত্ব নেই
এক হাতে এনআরসি লিস্ট নিয়ে
আরেক হাতে পুশ-ইন করবে
ছিটমহলে।
ব্যস এটুকুই
একটি মানুষকে না-মানুষ করার জন্য যথেষ্ট
এই ভারতবর্ষে।
আচ্ছা পৃথিবীর সব না-মানুষের দল মিলে এই মানচিত্র চিবিয়ে খেলে হয় না! তাতেও কি থাকবে কনসার্টিনা ওয়ার?
…………………………..
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
…………………………..
পণপ্রথার ভিত আসলে লিঙ্গ-ভিত্তিক শ্রমবিভাজন এবং নারী-পুরুষের শ্রমের ‘মূল্য’-র পার্থক্যের ওপর দাঁড়িয়ে। এটি আসলে পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের ঐতিহ্যকে তুলে ধরে, যেখানে পুরুষ উপার্জন করবে, নিরাপত্তা দেবে; আর নারী পালন-পোষণ করবে এবং তার পুনরুৎপাদনমূলক শ্রম পুরুষের শ্রমের অধীন থাকবে।
আমবাগানে গজল-সম্রাজ্ঞীকে গোর দেওয়া হয়ে যাওয়ার পর, রাত জেগে শাহিদ লেখেন ‘In Memory of Begum Akhtar’ নামে একটি কবিতা, যে কবিতাটা পরে উৎসর্গ করেছিলেন সেলিমকে। এর বেশ কয়েক বছর পর শাহিদের একটা কবিতার বই বের হয় ‘In Memory of Begum Akhtar’ নামে।