এখনও মনে আছে, মুম্বইয়ে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে একটা ম্যাচে আমরা ০-২ গোলে হারছিলাম। আমরা ভালোই খেলছিলাম। কিন্তু ওরা কাউন্টার অ্যাটাকে গোল দিয়ে যায়। ওভাবে পরপর দুটো গোল খেয়ে মানসিকভাবে একটু ব্যাকফুটে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু হাবিবদা ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া। দ্বিতীয় গোলের পর মাঝমাঠ দৌড়ে গিয়ে জাল থেকে বলটা তুলে সেন্টার লাইনের দিকে দৌড়নোর সময় আমাদের বলে গেলেন, ‘ম্যাচটা শেষ হয়ে গিয়েছে নাকি!’ সেদিন দ্বিতীয়ার্ধে দুটো গোলই শোধ করেছিলাম আমরা।
জীবনে এমন একটা মুহূর্ত আসে, একটা দৃশ্য বা একটা মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়। হয়তো সঙ্গে সঙ্গে নয়, পরবর্তীতে ওই মুহূর্তের প্রভাব আমরা নিজেদের জীবনে টের পাই।
হাবিবদাকে প্রথমবার খুব কাছ থেকে দেখাটা আমার কাছে তেমনই একটা মুহূর্ত। হাবিবদার প্রথম কলকাতায় খেলতে আসা ’৬৬ সালে। তখন আমি প্রাইমারির পড়ুয়া, বছর দশেক বয়স। কলকাতার উপকণ্ঠে বাড়ি হলেও ময়দানে খেলা দেখতে আসার সুযোগ তেমন ছিল না। তাই সংবাদপত্র আর রেডিওর মাধ্যমেই হাবিবদাকে চিনেছিলাম। তখনও আমার কাছে ‘দাদা’ নয়, মহম্মদ হাবিব ছিলেন তারকা, ফুটবল অনুরাগী জনতার ‘বড়ে মিঞা’। পরে একটা সময় আমিও ফুটবলার হিসাবে ময়দানে এলাম। সামনাসামনি দেখা হল হাবিবদার সঙ্গে, প্রতিপক্ষ হিসাবে। আমরা একটা বছরই একসঙ্গে খেলেছি, ’৮০ সালে। সেই মরশুমের প্রথমেই হাবিবদাকে আমি কাছ থেকে জানার সুযোগ পাই।
আসলে সেবছর ইস্টবেঙ্গলের দল ভেঙে গিয়েছিল। বেশ কয়েকজন নামী ফুটবলার অন্য ক্লাবে চলে যান। আমাকে নিয়েও টানাটানি চরমে উঠেছিল। সেসময় প্লেয়াররা আইএফএ-র কাছে গিয়ে সই করত। প্লেয়ার যাতে অন্য ক্লাবের হাতে না চলে যায়, তাই সেই সই-পর্বের আগে থেকেও ক্লাবকর্তারা সাবধানে থাকতেন। প্লেয়ারদের হোটেল বা অন্যত্র কড়া নিরাপত্তায় রাখা হত। আমি অন্যান্য বছর সইয়ের আগে বাড়িতেই থাকতাম। তবে সেবার ক্লাবকর্তারা আমাকে নিয়ে ঝুঁকি নিতে চাননি। বাবাও বারণ করলেন বাড়িতে থাকতে। তাই বালিগঞ্জে এক ক্লাবকর্তার হোটেলে গিয়ে উঠলাম। আর সেখানেই হাবিবদাকে নতুনভাবে চেনার সৌভাগ্য হল আমার।
আসলে অফ সিজনে আমরা একটু অনিয়ম করতাম। যার মধ্যে অন্যতম ছিল আড্ডা দেওয়া। তো হোটেল-বাসের প্রথম দিন আমি একটু আড্ডা দিয়ে ন’টা-সাড়ে ন’টা নাগাদ হোটেলে যাই। সেখানে রিসেপশন থেকে বলে দেওয়া হল, ‘ওমুক ঘরে আপনি থাকবেন।’ গেলাম সে ঘরে। গিয়ে দেখি, আলো জ্বলছে না। আবার রিসেপশনে কথা বললাম। ওরা বলল, ‘ওই ঘরে আরও একজন আছে। আপনি গিয়ে দেখুন।’ আমি গিয়ে আলো জ্বালিয়ে দেখি একজন শুয়ে আছেন। আর আলো জ্বলতেই তিনি উঠে এসে আমার উপর চোটপাট শুরু করলেন! কেন আমি আলো জ্বালিয়ে তাঁর ঘুমের অসুবিধা করছি! আলো বন্ধ করতে বললেন। আমি বললাম, সবে এসেছি। এখনও খাওয়াদাওয়া করিনি, পোশাকও বদলাতে হবে। সেসব কানে না তুলেই জবাব দিলেন, ‘তু নিকল ঘর সে!’
সেই লোকটা অন্য কেউ নন, হাবিবদা! ভাবতে পারেন! অফ সিজন, কোনও খেলা নেই। পরদিন সকালে অনুশীলনে যাওয়ার নেই। সবাই রেস্তরাঁয় যাচ্ছে, আড্ডা দিচ্ছে। আর হাবিবদা রাত সাড়ে ন’টায় হোটেলে ফিরে ঘুমচ্ছেন! আসলে হাবিবদা এমনই। ঘড়ি ধরে চলা তাঁর অভ্যাস। সিজন আর অফ সিজনের কোনও তফাত ছিল না হাবিবদার কাছে। আনন্দ-উৎসবে অংশ নিলেও নিজের নিয়ম মেনে চলতেন অক্ষরে অক্ষরে। পরে বিভিন্ন টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়ে সেটা আরও ভালোভাবে দেখেছি। আর শিখেছি, নিয়মানুবর্তিতা কাকে বলে!
ময়দানে হাবিবদার মতো চরিত্র খুব বেশি দেখিনি। আসেওনি। এখনও মনে আছে, মুম্বইয়ে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে একটা ম্যাচে আমরা ০-২ গোলে হারছিলাম। আমরা ভালোই খেলছিলাম। কিন্তু ওরা কাউন্টার অ্যাটাকে গোল দিয়ে যায়। ওভাবে পরপর দুটো গোল খেয়ে মানসিকভাবে আমরা একটু ব্যাকফুটে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু হাবিবদা ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া। দ্বিতীয় গোলের পর মাঝমাঠ দৌড়ে গিয়ে জাল থেকে বলটা তুলে সেন্টার লাইনের দিকে দৌড়নোর সময় আমাদের বলে গেলেন, ‘ম্যাচটা শেষ হয়ে গিয়েছে নাকি!’ সেদিন দ্বিতীয়ার্ধে দুটো গোলই শোধ করেছিলাম আমরা। আর পাল্টা লড়াইয়ের সাহসটা হাবিবদার থেকেই সংক্রমিত হয়েছিল আমাদের মধ্যে।
শুধু মাঠ না, মাঠের বাইরেও হাবিবদার থেকে উপকার পেয়েছি। হাবিবদা অ্যালোপ্যাথিতে বিশেষ আস্থা ছিল না। চোট সারাতে বিভিন্ন টোটকার আশ্রয় নিতে দেখেছি হাবিবদাকে। এমনকী, যেবার ওঁর পা ভাঙে, ফিরে গিয়েছিলেন হায়দরাবাদে। সেখানে গিয়ে ওইসব টোটকার ভরসায় সুস্থ হয়ে আবার চলে এসে বল পায়ে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন ময়দান। সেসময় হাঁটুর একটা চোটে আমি বারবার সমস্যায় পড়তাম। একদিন হাবিবদা ডিমের সাদা অংশটার সঙ্গে আদা মিশিয়ে একটা মিশ্রণ তৈরি করে নিজেই সেটা আমার হাঁটুতে মাখিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না ময়দানে তিন প্রধানের হয়ে দাপিয়ে খেলা, জাতীয় দলের একজন ফুটবলার আমার পায়ের কাছে বসে হাঁটুতে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছেন!
হাবিবদা এমনই। একজন সত্যিকারের ভালো মানুষ। মাঠে হোক বা মাঠের বাইরে, একেবারে শান্ত-নির্বিবাদী একজন মানুষ। কারও সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটিতে নেই। অত্যন্ত পরিশ্রমী। সেসময় কোনও ফুটবলারকেই দেখিনি হাবিবদার মতো মাঠজুড়ে খেলতে। নীচে নেমে এসে ডিফেন্স থেকে বল ক্লিয়ার হোক, কিংবা উপরে উঠে মাপা পাসে গোল করা, হাবিবদা ছিলেন সেই ভূমিকায় অদ্বিতীয়। স্ট্রাইকাররা যেখানেই থাকুন না কেন, হাবিবদার পাস ঠিক খুঁজে নিত তাদের।
খেলা ছাড়ার পরও কলকাতার সঙ্গে নিবিড় যোগ ছিন্ন হয়নি হাবিবদার। তখনও দেখাসাক্ষাৎ হত, কথা হত। আধুনিক ফুটবল নিয়ে প্রচুক জ্ঞান ছিল হাবিবদার। বিশেষত কোচ হিসাবে অল্প সময়র মধ্যেই নিজের একটা জায়গা করে সমস্যা হয়নি ‘বড়ে মিঞা’র। হাবিবদার সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ হয়েছিল ইস্টবেঙ্গলের শতবর্ষের অনুষ্ঠানে। আকবর সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। তখন থেকেই হাবিবদা বেশ অসুস্থ। আমাদের চিনতে সমস্যা হচ্ছিল। খারাপ লাগছিল দেখে। যার খেলা দেখে বড় হয়েছি, মাঠে যার থেকে এতকিছু শিখেছি– তাকে এই অবস্থায় দেখা সহজ নয়।
হাবিবদার সঙ্গে এক দলে আমি বেশিদিন খেলার সুযোগ পাইনি। ’৮০ সালের ওই একটা বছরই। এরপর হাবিবদা অন্য দলে চলে যান। কিন্তু ওই একটা বছরেই যা শিখেছি, পরবর্তীতে কাজে লেগেছে। এখনও আফসোস হয়, আরও কয়েকটা বছর যদি হাবিবদার সঙ্গে খেলার সুযোগ পেতাম!