অশোক মুখোপাধ্যায় প্রণীত ‘সমার্থশব্দকোষ’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৭ সালে, তারপর আরও দু’টি সংস্করণ হয়েছে। নতুন সংযোজনের ফলে বইটির উৎকর্ষসাধনও ঘটেছে। মুদ্রণ হয়েছে অজস্রবার। এই বইয়ের প্রকাশের এক দশকেরও পর ১৯৯৮ সালে অশোক মুখোপাধ্যায় আরেকটি কীর্তি স্থাপন করেন ‘বানান অভিধান’ লিখে। ১২ অক্টোবর, প্রয়াত হয়েছে তিনি।
বাংলা ভাষার শব্দচর্চার জগতে ইন্দ্রপতন হল। অশোক মুখোপাধ্যায়ের জীবনাবসান হয়েছে ১২ অক্টোবর। শিক্ষাগত যোগ্যতায় তিনি ছিলেন একজন মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই বিভাগেই অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘকাল। বিজ্ঞানের লোক হওয়া সত্ত্বেও বাংলা শব্দ ও বানান নিয়ে তাঁর আগ্রহ ভাবনাচিন্তা ও ব্যুৎপত্তি আমাদের যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি ও রাজশেখর বসুর কথা মনে পড়ায়। এই ভালোবাসা থেকেই অধ্যাপনা ও কমপিউটার ল্যাবের তত্ত্বাবধানের পাশাপাশি অবলীলায় সৃষ্টি করে ফেলেছিলেন এক মহাগ্রন্থ, ‘সংসদ সমার্থশব্দকোষ’ নামে যা ভাষানুরাগীদের কাছে পরম সমাদরের বস্তু হয়ে রইল।
‘সমার্থশব্দকোষ’ একটি বাংলা অভিধান বটে, তবে অন্যান্য শব্দকোষের সঙ্গে এর চরিত্রগত প্রভেদ আছে। এটি বাংলা ভাষার ‘থিসরাস’। অভিধান আমাদের শব্দের অর্থ জানায়, ব্যুৎপত্তির ব্যাখ্যা দেয়, কিন্তু প্রয়োজনমতো উপযুক্ত স্থানে উপযুক্ত শব্দের জোগান দিতে পারে না। সেই প্রয়োজন মেটাতে পারে থিসরাস। ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত পিটার মার্ক রজে-র ইংরেজি ভাষার বিখ্যাত থিসরাসের আদর্শে অশোকবাবু তাঁর থিসরাস সাজিয়েছেন। উল্লেখ করা যেতে পারে এই রজে-ও পেশায় ছিলেন একজন চিকিৎসক। সাবেক অভিধানের ধরনে অশোকবাবুর থিসরাসেও শব্দগুলিকে বর্ণানুক্রম অনুযায়ী বিন্যস্ত করা হয়নি, শব্দের বর্ণনা এখানে বিষয়ভিত্তিক। যেমন মহাবিশ্ব-প্রকৃতি-পৃথিবী-গাছপালা, প্রাণ-প্রাণী-শরীর, কাজ-প্রয়োগ-ব্যবস্থা, ধর্ম-দেবতা-উপাসনা, এইরকম। এই ব্যাপ্তার্থক শিরোনামগুলির ভিতরে নানারকম প্রাসঙ্গিক উপশিরোনাম আছে, সেই উপশিরোনামের ভিতরে আছে বিষয়ভিত্তিক শব্দ, তার প্রতিশব্দ, এমনকী, তার আনুষঙ্গিক ও সমশ্রেণিভুক্ত শব্দ। অনেক সময়ে এমন হয় যে, একটি ভাবনা মনের ভিতরে আছে, কিন্তু তাকে প্রকাশ করার উপযোগী শব্দ মাথায় আসছে না, বা সেরকম শব্দ জানা নেই, তখন ‘সমার্থশব্দকোষ’ সেই কাঙ্ক্ষিত শব্দটির হদিশ দিতে পারে। সেই যে সুকুুমার রায় লিখেছিলেন, ‘কার নাম দুন্দুভি, কাকে বলে অরণি’, অশোকবাবু লঘুচ্ছলে জানিয়েছেন সে-প্রশ্নের কোনও সরাসরি উত্তর এ-বইয়ে পাওয়া যাবে না হয়তো, তবে ‘দুন্দুভি’ যে আনদ্ধ শ্রেণির বাদ্যযন্ত্র সেটা জানা যাবে, আরও জানা যাবে ওই পর্যায়ে আর কী-কী বাদ্যযন্ত্র আছে। ‘অরণি’র সমার্থ শব্দ যে ‘চকমকি’ এবং তা যে ‘অনলোৎপাদক’ তাও জানা যাবে।
আরও পড়ুন: ‘সমার্থ শব্দকোষ’-এর মতো বিশাল কর্মকাণ্ড এ দেশে ব্যক্তিগত উদ্যোগেরই মুখ চেয়ে বসে থাকে
ভূমিকায় অশোকবাবুর একটি কথা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। ‘সমার্থশব্দকোষ’-কে ঠিকঠাক ব্যবহার করতে গেলে ভাষাবিষয়ে কিছুটা পূর্বজ্ঞান দরকার। হাতের কাছে দশটা সমার্থবোধক শব্দ থাকলে প্রাচুর্যের সুখ হয় বটে, তবে কোন প্রসঙ্গে কোন শব্দটি সর্বাধিক সুপ্রযুক্ত হবে– সে-বিচারের ভার কিন্তু ব্যবহারকারীর। থিসরাস হলেও এ-বইয়ে বিশেষ একটি শব্দকে খুঁজে পেতেও কোনও অসুবিধে নেই, তার জন্য একটি বর্ণানুক্রমিক সূচি বইয়ের দ্বিতীয় অর্ধাংশে সংবলিত হয়েছে। যাঁরা ব্যবহার করেছেন তাঁরা এই বইয়ের অমূল্য উপযোগিতার কথা জানেন। বিশেষ করে, যাঁরা বাংলা ভাষায় লেখালিখি করেন।
‘সমার্থশব্দকোষ’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৭ সালে, তারপর আরও দু’টি সংস্করণ হয়েছে। নতুন সংযোজনের ফলে বইটির উৎকর্ষসাধনও ঘটেছে। মুদ্রণ হয়েছে অজস্রবার। এই বইয়ের প্রকাশের এক দশকেরও পর ১৯৯৮ সালে অশোকবাবু আরেকটি কীর্তি স্থাপন করেন ‘বানান অভিধান’ লিখে। সাধু বাংলা যখন সর্বজনমান্য লেখার ভাষা ছিল, তখন বৃহৎ বঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ মুখে যে যা বলুন, লিখতেন সেই একই সাধু ভাষায়। বোঝার কোনও অসুবিধে ছিল না। ধীরে ধীরে চলিত ভাষা যখন সাধু বাংলাকে সরিয়ে লেখার ভাষা হয়ে উঠল তখনই বানানে সমতারক্ষা একটি প্রধান সমস্যা হয়ে দেখা দিল। সংস্কৃতে বিকল্প বানানের ছড়াছড়ি থাকলেও আধুনিক বাঙালি শব্দচিন্তকরা বাংলা ভাষার পক্ষে বৈকল্পিকতাকে আদর্শ মনে করেননি। তাতে বানানে নৈরাজ্যের সম্ভাবনা প্রবল। সেটা এড়াতে তাঁরা চেয়েছেন এক শব্দের বানান সবাই একইভাবে লিখুক। ভাবনাটা বহু পুরোনো। রবীন্দ্রনাথের পরামর্শে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩৬ সালে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বানান সংস্কারের উদ্যোগ নেন। তাতে অনেকটা কাজ হলেও সব সমস্যার নিরসন হয়নি। গত ২০-২৫ বছরে নতুন করে আবার সমতাবিধানের চেষ্টা হয়। আনন্দবাজার পত্রিকা, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, সাহিত্য সংসদ বানান সমিতি প্রভৃতি বিভিন্ন সংস্থা নিজেদের চিন্তাভাবনাগুলিকে নিয়মের আকারে প্রকাশ করেন। বাংলা আকাদেমি ও সংসদ বানান সমিতির বানানবিধিতে অবশ্য তেমন পার্থক্য নেই। শেষোক্ত সমিতিতে অশোকবাবু নিজেও একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। তাঁর ‘বানান অভিধান’-এ সংসদ বানান সমিতির নিয়মাবলি পরিশিষ্ট ৪ অংশে দেওয়া হয়েছে।
শব্দ ও তার বানান বিষয়ে অশোকবাবুর প্রজ্ঞা ও বিবেচনার পরিচয় এই অভিধানে ছড়ানো আছে। এখানে শব্দের অর্থ কিংবা ব্যুৎপত্তি দেওয়া নেই। সংস্কৃত শব্দ ছাড়া অর্ধতৎসম তদ্ভব বা বিদেশি শব্দের বানানে বিকল্প রাখা হয়নি। তবে বিকল্প রূপ থাকলে তা দেখানো আছে। সংস্কৃত শব্দে বিকল্প দু’টি বানানকে পাশাপাশি রেখে বলা হয়েছে, প্রথম বানানটি লেখাই সমীচীন। একটি নিয়মের কথা বলি। সংসদ বানান সমিতির বিবেচনায় সংস্কৃত শব্দে বিকল্পে ই-কার ও ঈ-কার দুটোই সিদ্ধ হলে বাংলা বানানে হ্রস্বরূপটিই ব্যবহৃত হবে। অশোকবাবুর অনন্যতা এই যে, তিনি ঐতিহ্য, অভ্যাস ও ধারাবাহিকতার গুরুত্বকে যান্ত্রিক নিয়মের মোহে বিস্মৃত হননি। তাই অবনি-অবনী তরি-তরী রজনি-রজনী শ্রেণি-শ্রেণী অনুক্রমে শব্দ সাজালেও যুবতি-যুবতী অনুক্রম মানেননি। গৃহীত নীতির বিরুদ্ধে গিয়েই লিখেছেন: যুবতী-যুবতি। তৃতীয় সংস্করণের ভূমিকায় ব্যতিক্রমের ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। সত্যি বলতে কী, ক-জন বাঙালি ‘যুবতি’ বানান লেখেন? মুষ্টিমেয় কয়েকজনই তো? বানান-সমতার খাতিরে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিকে ‘যুবতি’ লেখার পরামর্শ না দিয়ে ওই মুষ্টিমেয় কয়েকজনকেই বরং ‘যুবতী’ লিখতে উৎসাহিত করা বাস্তববোধের পরিচায়ক নয় কি? একই কারণে প্রচলন মেনে ‘কোষ’ বানানকে আগে রেখে তিনি ‘কোশ’ বানানকে স্থান দিয়েছেন পরে। এরকম স্বচ্ছ নমনীয়তার কারণে তাঁর সম্পর্কে আমার মুগ্ধতা বেড়েছে।
মূলত এই দু’টি বইয়ের জন্য শিক্ষিত বাঙালির মনে অশোক মুখোপাাধ্যায়ের স্মৃতি অক্ষয় হয়ে থাকবে। এ-ছাড়াও ‘ব্যাকরণ অভিধান’, ‘কথার কী ছিরি’ ও ‘কম্পিউটারের কত কথা’ নামে আরও তিনটি বই আছে তাঁর। ছবি তোলায় উৎসাহী ও বিশেষ পারদর্শী এই মানুষটি ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোটোগ্রাফি ক্লাবের প্রাণপুরুষ। ছাত্রবৎসল অধ্যাপক তো ছিলেনই, সুরসিক হিসেবেও বন্ধুমহলে তাঁর খ্যাতি ছিল। কয়েকবার তাঁর বাড়িতে বই ও পত্রিকা দিতে গিয়ে আমিও তাঁর রসস্নিগ্ধ ব্যক্তিত্বের পরিচয় পেয়েছি। আমার বানান-বিষয়ক বইটি নিয়ে তাঁর সঙ্গে কিছু কথাও হয়েছিল। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটির প্রয়াণে তাঁর অগণিত ছাত্র-ছাত্রী ও অনুরাগী অনুজদের হৃদয়ে এক শূন্যতার সৃষ্টি হল। একজন সামান্য শব্দোৎসাহী হিসেবে এই বিষাদ আমাকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে।