জুতো খুলে ঢোকার নিয়ম; যেন এ বাড়িটা এখনও বসতি, মানুষের। বৈঠকখানায় পাতা দরাজ টেবিল ও চেয়ার; যেন এখুনি এসে, আলাপ জুড়বেন সদাহাস্য আর. কে. নারায়ণ। তিনি না এলেও, তাঁর আলো এসে পড়ে, জানলার কারচুপি বেয়ে। আগাগোড়া লাল মেঝে আর চুন-সাদা দেওয়ালে, তা আসলে রোদের প্রণাম। ১০ অক্টোবর চলে গেল তাঁর জন্মদিন।
লেখকের রোয়াব কী জিনিস, দেখতে হলে, মাইসোরে আসুন। এদিক-ওদিক আলতো হেঁটে, পৌঁছে যান যাদবগিরি। যে কোনও স্থানীয় মানুষকে জিজ্ঞাসা করুন, কোনদিকে থাকতেন আর. কে. নারায়ণ– তিনি সাগ্রহে দেখিয়ে দেবেন।
গেট খোলা। গোটা বাড়ি হাট করে খোলা। টুক করে ঢুকে পড়ুন ছায়া-ঘেরা তাঁর ভবনে। উঁহু, টিকিট লাগবে না, কোনও পারমিশনও না। চারিপাশে সুবৃদ্ধ বৃক্ষরাজি ছাড়া, কোথাও কেউ পাহারায়ও নেই। হ্যাঁ, সরকারের তরফে, একজন অ্যাটেন্ডেন্ট আছেন বটে। মহিলা, কৃষ্ণবর্ণা, পরনে সুনীল শাড়ি। আপনি ঢুকলেই, হাতজোড় নমস্কার করবেন তিনি। আপনার কোনও প্রশ্ন থাকলে, বিশেষ সুবিধে হবে না। কানাড়া ছাড়া, বাকি সব জাগতিক ভাষায়, একটাই উত্তরে পারঙ্গম তিনি– সুস্মিত হাসি।
জুতো খুলে ঢোকার নিয়ম; যেন এ বাড়িটা এখনও বসতি, মানুষের। বৈঠকখানায় পাতা দরাজ টেবিল ও চেয়ার; যেন এখুনি এসে, আলাপ জুড়বেন সদাহাস্য লেখক। তিনি না এলেও, তাঁর আলো এসে পড়ে, জানলার কারচুপি বেয়ে। আগাগোড়া লাল মেঝে আর চুন-সাদা দেওয়ালে, তা আসলে রোদের প্রণাম।
যে কোনও ঘরে চলে যান। তাঁর জামা, তাঁর প্যান্ট, কোট, কাফলিং, ঘড়ি, বইপত্র, মায় পদ্মবিভূষণ– অপার তাকিয়ে। চারিপাশে টাঙানো তাঁর উদ্ধৃতি, যথেচ্ছ, সুশোভিত ফলকে। ধীর হয়ে পড়ুন, স্থির হয়ে পড়ুন। দুয়েক পলক ভেবে, আবার পড়ুন। এ যেন কবিতা, এক-একটা শব্দ যেন মুহূর্তে মূর্ছনা, বাঙ্ময়।
আর. কে. নারায়ণের উদ্ধৃতি
একতলায় যান, দোতলায় যান, বারান্দায়, রান্নাঘরে, স্নানঘরে, প্রার্থনা ঘরে– কেউ আটকাবে না, কেউ রাঙাবে না চোখ। সবকিছু গোছানো, তকতকে পরিচ্ছন্ন সব, সবকিছু। আদিগন্ত ব্যালকনিতে, দাঁড়িয়ে বা বসে, জিরোন একটু। অনেক তো দৌড়লেন সকাল বিকেল; এখন একটু মন মেলে, ভরে নিন কাবেরি ও কাবিনির হাওয়া। সামনে তাকিয়ে দেখুন, ঝরে ঝরে পড়ছে শেষ ঋতুর কাঠচাঁপা কিছু, গুঁড়ো বরফের মতো। উঠোনে গালচে পেতেছে শত শত বোগেনভেলিয়া। ব্যস্ত এক কাঠবিড়ালী তাড়াতাড়ি তুলে রাখছে টুকরো বাদাম– আসন্ন শীতে তো সংসার চালাতে হবে, না কি!
প্রকাশ্যে না হলেও, অন্দরে টের পাবেন, এবার কলকল করছে সেই শিশুটি, ৩৬৪ দিন যার গলা চেপে রেখেছেন নিজের ভেতরে। করবেই তো! ওই যে দেওয়ালে দেওয়ালে ঝুলছে ‘মালগুড়ি ডেজ’ শুটিংয়ের কত কত স্টিল। যা পড়ে, দেখে, এই বড়টা হলেন– এখন দেখুন, নানা দিক থেকে আপনাকে দেখছেন সেইসব মানুষ– গিরীশ কারনাড, বৈশালী কাসারাভাল্লি, হরিশ প্যাটেল, অনন্ত নাগ, শঙ্কর নাগ, দীনা পাঠক…।
এ সবের মাঝে, একটা ঘরে, শুধুমাত্র একটাই ঘরে, এক কোণে, আক্ষরিক এক কোণে, ফেলে রাখা একটা ডিভিডি, ‘গাইড’-এর। ব্যাস, ওটুকুই। এমনকী, তন্নতন্ন করে দেখবেন, গোটা বাড়িতে কোথাও নামমাত্র উল্লেখ নেই, ওঁর লেখা থেকেই তৈরি হয়েছিল ওই কালজয়ী ফিল্ম।
কর্ণাটক সরকার জানে, মাইসোর মিউনিসিপ্যালিটি নিশ্চয়ই জানে, ‘গাইড’-এর আরও আরও ঝালর ঝোলালে, ডোমেস্টিক তো বটেই, ইন্টারন্যাশনাল ভিজিটরের লেগে যাবে ভিড়! দেব আনন্দের তিরছি নজর আর ওয়াহিদা রেহমানের তন্বী তনহার পাশে হুড়োহুড়ি হবে সেলফি তোলার, হ্যাঁ, জেনারেশন জেডয়েরও!
কিন্তু, ওই! লেখকের রোয়াব! নারায়ণের না-পসন্দ ছিল ‘গাইড’-এর ফিল্মায়ন– ইংরেজি, হিন্দি– দুটোই। সপাটে বলেছিলেন তিনি, ‘দ্য মিসগাইডেড গাইড’। লেখকের রোয়াবটা আজও নতশিরে মেনে চলেছে মাইসোরের মানুষ, কর্ণাটকের সরকার।
যেমনটি হয় ভোগ্য নিয়মে, এ বাড়িও বিক্রি হয়েছিল এস্টেট কনট্রাক্টরের কাছে। প্ল্যান ছিল, ভেঙে, তৈরি হবে দামড়া হাউজিং। কনট্রাক্টরের হাত থেকে, প্রিয় লেখকের বাড়ি ফিরিয়ে এনেছে নাগরিক দল আর সিটি কর্পোরেশন। লেখককে তারা পণ্য করেনি, বরং পাঠককে ডেকে এনে, বসিয়েছে তাঁর আঙিনায়।
লেখার সঙ্গে ব্যবহৃত শেষ তিনটি ছবিই লেখকের সূত্রে প্রাপ্ত।