চিনের হাংচৌতে প্যারা এশিয়ান গেমস চলছে; নিঃশব্দে। বিশ্বকাপ ক্রিকেট আর পুজো আবহে সেদিকে তেমন নজর নেই আমাদের কারও। অথচ, মিডিয়া লাইমলাইট একা হাতে কিছুটা টেনে নিলেন শীতল দেবী, তাঁর একটি ছবি ভাইরাল হতেই নেটমাধ্যম সরগরম, দেখা যাচ্ছে পা দিয়ে লক্ষ্যভেদ করছেন শীতল, সঙ্গে এশিয়ান প্যারা গেমসের অফিশিয়াল টুইটার হ্যান্ডেল থেকে ট্যুইট যেখানে তাঁরা লিখছেন যে শীতল দেবী শেষ দু’রাউন্ডে পরপর ছয়বার টেন রিংস মেরেছেন, এবং বিশ্বের প্রথম এবং একমাত্র হাতবিহীন তিরন্দাজ হিসেবে এই সম্মান পাচ্ছেন তিনি।
শীতল দেবী, দেবীপক্ষে সোনা জিতলেন। বয়স মাত্র ১৬। অদ্ভুতভাবে, সে সোনার পদক হাতে তুলে নেওয়ার মতো হাত-ই নেই তার। আজ্ঞে হ্যাঁ, হাত ছাড়া স্রেফ পা দিয়ে তির ছুড়ে দু’-দুটো সোনার মেডেল দেশকে এনে দিয়েছে মেয়েটা। পঞ্জিকা যদিও বলছে কোজাগরী পূর্ণিমা কেটে গেছে। দেবীপক্ষ শেষ। কিন্তু শীতল দেবী, সেই মেয়ে, যে তোয়াক্কাই করে না সমাজের আরোপিত দেবীত্বের, যে বিশ্বাস করে, এবং অবশ্যই প্রমাণ করে দেয় যে মানুষের ভেতরের ইচ্ছাশক্তির কোনও পক্ষ হয় না, সে চাইলে পাহাড় ডিঙোতে পারে নিঃশব্দে– আর সেই সাফল্যের আলো দেবীপক্ষকে জিইয়ে রাখে আরও কিছুদিন।
চিনের হাংচৌতে প্যারা এশিয়ান গেমস চলছে; নিঃশব্দে। বিশ্বকাপ ক্রিকেট আর পুজো আবহে সেদিকে তেমন নজর নেই আমাদের কারও। অথচ, মিডিয়া লাইমলাইট একা হাতে কিছুটা টেনে নিলেন শীতল দেবী, তাঁর একটি ছবি ভাইরাল হতেই নেটমাধ্যম সরগরম, দেখা যাচ্ছে পা দিয়ে লক্ষ্যভেদ করছেন শীতল, সঙ্গে এশিয়ান প্যারা গেমসের অফিশিয়াল টুইটার হ্যান্ডেল থেকে ট্যুইট যেখানে তাঁরা লিখছেন যে শীতল দেবী শেষ দু’রাউন্ডে পরপর ছয়বার টেন রিংস মেরেছেন, এবং বিশ্বের প্রথম এবং একমাত্র হাতবিহীন তিরন্দাজ হিসেবে এই সম্মান পাচ্ছেন তিনি। এ যুগের একলব্য হিসেবে অনেকেই চিহ্নিত করছেন শীতল দেবী-কে, তবে একথা আমাদের স্মরণে রাখা আশু প্রয়োজন যে, একলব্যের অসহায়তাকে শীতল নিজের সবচেয়ে বড় শক্তিতে পরিণত করতে পেরেছেন, এই তার সাফল্য– মহাকাব্যেও যা বিরল।
জম্মু কাশ্মীরের মেয়ে শীতল জন্ম থেকেই এক বিরল রোগের শিকার– ফোকালিয়া। তাঁর হাতের গঠন অসম্পূর্ণ, ন’বছর বয়স থেকে জীবনের চার চারটে বছর শীতলের সময় লেগেছে কেবল পা দিয়ে ধনুক তুলতে, তবু, হাল ছাড়েননি তিনি। ২০১৯ সালে ভারতীয় আর্মি কিয়স্টারের এক তিরন্দাজি প্রতিযোগিতায় শীতলকে দেখে চমকে যান কোচ কুলদীপ কুমার। তারপর সময় লেগেছে চার বছর, তাঁকে হয়ে উঠতে হয়েছে সেই একলব্য, যার পাশে অর্জুনেরা হাত দিয়ে তির ছুড়েও তাঁকে ছুঁতে পারে না। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে অরুণিমা সিনহার কথা। অনেকেই হয়তো একডাকে চিনবেন না। অরুণিমা ছিলেন জাতীয় স্তরের ভলিবল প্লেয়ার, ট্রেন ডাকাতির সময়ে ছিনতাইকারীরা তাঁকে ট্রেন থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেন, কাটা পড়ে পা। এই অবধি পড়ে শিউরে উঠবেন অনেকে, কিন্তু অরুণিমা এরপরও ঘটিয়ে ফেলেছেন বিপ্লব। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলছেন, ‘২০১১ সালে যুবরাজ সিং যখন লাং ক্যানসার নিয়ে দেশের জন্য খেলল, তখন এত সহজে হার মানতে ইচ্ছে হল না।’ হার মানেননি অরুণিমা। তিনি এরপর ঠিক করলেন প্রথম প্রতিবন্ধী মহিলা হিসেবে এভারেস্টে চড়বেন। যেমন কথা তেমন কাজ, একটি কাঠের পা নিয়ে এভারেস্ট জয় করলেন অরুণিমা। শুধু এভারেস্ট নয়, মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো, মাউন্ট এলব্রাস, মাউন্ট কসিয়াস্কু-সহ একাধিক পর্বতারোহণ করেছেন তিনি। অস্কার পিস্টোরিয়াস, দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি দৌড়বীর, যিনি দু’টি প্রস্থেটিক পা নিয়ে দৌড়ে বিশ্বকে চমকে দিয়েছিলেন, তাঁর একটি উক্তি মনে পড়ে, তিনি যা বলেছিলেন তাঁর বাংলা তরজমা করলে দাঁড়ায়, ‘তোমার যা অক্ষমতা, তাঁর জন্য তুমি অক্ষম নও, তোমার যা ক্ষমতা, সেই ক্ষমতার জোরে তুমি সক্ষম…’
খেলার ময়দানে শীতল দেবী এক উদাহরণমাত্র, যেমন উদাহরণ অরুণিমা সিংহ কিংবা মাসুদুর রহমান বৈদ্য। শীতল দেবী বুঝেছেন, তাঁর হাত নেই এ যেমন সত্যি, তেমনই তাঁর মতো মানসিক দৃঢ়তাও বহির্বিশ্বে বহু মানুষের নেই– এ-ও সমান সত্যি। পিস্টোরিয়াসের সেই কথাকে আপ্তবাক্য মেনে তিনি পায়েই তুলে নিয়েছেন ধনুক, সবুজ ময়দান– তাঁর প্রসার ও ব্যপ্তি নিয়ে অপেক্ষা করে মানুষের ক্ষমতার সর্বোত্তম স্ফুরণের, তাঁর যা কিছু অক্ষমতা ময়দান ভুলিয়ে দেয় রোজ। আর এ সত্যি ময়দান পেরিয়ে এসে পড়ে বাস্তব জীবনেও।
শীতল দেবীর ছোড়া তির আদতে পৌঁছে যায় এ সত্যের কাছেই…