নাম বদলের এই পুরো ব্যাপারটাই আসছে সেই অশিক্ষিত ধারণা থেকে যে, ‘ইন্ডিয়া’ একটা ইংরেজি শব্দ। কাজেই হিন্দিপ্রেমী রাষ্ট্রপ্রধানদের তার উপর সাত্ত্বিক রাগ হয়েছে। কিন্তু তা তো নয়। সিন্ধু থেকে পারস্যের লোকেরা পূর্ববঙ্গ আর অসমের ধরনে ‘হিন্দু’ করেছিল। তার সূত্র ধরে প্রাচীন গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোদোতস্ আবার ‘হ্’ ফেলে দিয়ে ‘ইন্দ্’ কথাটা নিয়েছিলেন, নিয়ে ‘ইন্দিয়া’ (গ্রিকে ট্, ড্ নেই, আমাদেরই মতো ত্, দ্ আছে) ব্যবহার করেছিলেন। ‘ইয়া’-টা তখন ছিল দেশবোধক প্রত্যয়, যেমন পারসিয়া, রুশিয়া, রুমানিয়া, এমনকী, ব্রিটানিয়া। পাঠ্যবই থেকে ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটা বাদ দিয়ে ‘ভারত’ করার দাবি অন্যায্য।
আমাদের দেশের এখনকার শাসকেরা যেন নিজেরা কত ছেলেমানুষ আর ফালতু আতঙ্কের শিকার– তাই প্রমাণ করতে উঠে-পড়ে লেগেছে। আচ্ছা, সবাই জানে যে, বিজেপি-বিরোধী দলগুলির একটি জোট হয়েছে। তাতে আদর্শের দিক থেকে পরস্পরের মধ্যে লাঠালাঠি চলে এমন নানা দলও আছে, যেমন বাংলায় সিপিআই (এম), তৃণমূল। অনেকেই এ ব্যাপারটায় অবাক হলেও নিশ্চিতভাবেই একটা জোট হয়েছে। এবং যেসব খবর বেরচ্ছে, সে জোটও এখনও খুব পোক্ত হয়নি। বেশ নড়বড়ে, আদৌ কোমর বেঁধে লড়াইয়ে নামতে পারবে কি না সন্দেহ।
কিন্তু তাতে কী! বিরোধীদের জোট হয়েছে, এতেই শাসকেরা ভয়ংকর ঘাবড়ে গেছে। ঘাবড়ে যে গেছে, তার প্রমাণ মিলেছে, ‘ইন্ডিয়া বনাম ভারত’ যুদ্ধে। ‘ইন্ডিয়া’ কী? না, ‘ভারত’ নামে দেশটা নয়, তা আপাতত বিরোধীদের দলের জোটটির সমবেত নাম। কতকগুলি ভালো-ভালো কথার প্রথম অক্ষর জুড়ে ‘acrostic’ বা অগ্রবর্ণীয় নাম, ‘Indian National Developmental Inclusive Alliance’-এর সংক্ষেপ। এ বছর জুলাইয়ের ১৮ তারিখে বোধহয় তৈরি হল এ জোট।
এবং আর কিছু নয়, তার শরীর-স্বাস্থ্য কেমন দাঁড়ায়, সে হামাগুড়ি দিচ্ছে না হাঁটছে– তা দেখার আগেই আমাদের ছাপ্পান্ন ইঞ্চির ভদ্রলোক তাঁর টেবিলের কাঠের নামপাটায় ‘ইন্ডিয়া’-র জায়গায় ‘ভারত’ কথাটা বসিয়ে দিলেন, বোঝালেন যে ‘ইন্ডিয়া’ কথাটা তিনি আর ব্যবহার করবেন না। যেন ‘ইন্ডিয়া’ কথাটা তাঁর বা তাঁর দলের গায়ে ছ্যাঁকা দিচ্ছে, কোথাও ইন্ডিয়া কথাটার নামগন্ধ থাকলে ২০২৪-এর সংসদের নির্বাচনে তাঁদের ভরাডুবি সুনিশ্চিত। ওই যে বাংলার গাঁয়ের লোকেদের বিশ্বাস থাকে যে, রাত্রিবেলায় সাপের বা বাঘের নাম করতে নেই, করলেই এসে কামড়াবে– এ অনেকটা সেইরকম। তাই দাও ওদের নাম বদলে: সাপকে বলো ‘লতা’, আর বাঘকে বলো ‘বড়মিঞা’ বা ‘বড় শেয়াল’। ব্যস, নিশ্চিন্দি। এ এক অদ্ভুত কুসংস্কার, কে ভাবতে পেরেছিল যে, একটা বানানো নাম তাঁদের কাছে এমন আতঙ্ককর হয়ে উঠবে। অবিশ্যি কুসংস্কার এঁদের প্রিয় ব্যসন, কারণ কুসংস্কারই এঁদের কাছে বিজ্ঞান। ফলে, মনে হয়, আগামী নির্বাচনে যাই হোক, এই একটি কাজ করেই তাঁরা একটা অগ্রিম পরাজয় স্বীকার করে নিলেন। ভয় পেয়ে গেছেন যে, তা এত সহজে সকলকে বুঝতে দেবেন, তা ভাবতেই কীরকম লাগে। ছাপ্পান্ন ইঞ্চি বুকের ছাতির কি এটা মানায়?
আরও পড়ুন: নিজেকে অপরাধ মুক্ত করি জেলের ছেলেমেয়েদের নাচ শিখিয়েই
কুসংস্কার মূর্খতারই নামান্তর, একটা অন্যের যমজ। এর পুরো ব্যাপারটাই, আমাদের মনে হয়, আসছে সেই অশিক্ষিত ধারণা থেকে যে, ‘ইন্ডিয়া’ একটা ইংরেজি শব্দ। কাজেই হিন্দিপ্রেমী রাষ্ট্রপ্রধানদের তার উপর সাত্ত্বিক রাগ হয়েছে। কিন্তু তা তো নয়। সিন্ধু থেকে পারস্যের লোকেরা পূর্ববঙ্গ আর অসমের ধরনে ‘হিন্দু’ করেছিল। পুব বাংলার লোকেরা ‘শালা’-কে কী বলে, তা আপনারা জানেন, আর অসমিয়ারা অসম সাহিত্য সভার সভাপতি সত্যেন্দ্রনাথ শর্মাকে বলেন ‘অহম হাহিত্য হভার হভাপতি হত্যেন্দ্রনাথ হর্মা’। তার সূত্র ধরে প্রাচীন গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোদোতস্ আবার ‘হ্’ ফেলে দিয়ে ‘ইন্দ্’ কথাটা নিয়েছিলেন, নিয়ে ‘ইন্দিয়া’ (গ্রিকে ট্, ড্ নেই, আমাদেরই মতো ত্, দ্ আছে) ব্যবহার করেছিলেন। ‘ইয়া’-টা তখন ছিল দেশবোধক প্রত্যয়, যেমন পারসিয়া, রুশিয়া, রুমানিয়া, এমনকী, ব্রিটানিয়া। আমাদের শাসকদের ‘আংরেজি হটাও’ বলে একটা স্লোগান আছে আমরা জানি, হিন্দিকে ভারতের সর্বত্র গিলিয়ে দিতে পারলে, এঁরা বিমল আনন্দ পাবেন। ফলে ‘ইন্ডিয়া’ কথাটা যে ইংরেজরা তৈরি করেনি, ফলে তাঁদের ক্রোধ আর বিদ্বেষের যোগ্য নয়, সেটা তাঁরা বুঝবেন কি না, জানি না।
আরে ‘ইন্ডিয়া’ ছেড়ে দিন মশাইরা। এখন তো দেখছি ‘হিন্দু’ কথাটাই বাদ দেওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়েছে, ফেসবুকে ক’দিন থেকে ‘সনাতন ধর্ম’ কথাটা খুব ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি জানি না, হিন্দু– এই ছোট্ট কথাটার বদলে ‘সনাতনী’ বা ‘সনাতন ধর্মী’ কথাটা আমরা হিন্দুরা কীভাবে সামলাব। সনাতন মানে যদি প্রাচীন হয়, হিন্দুধর্মের সব কিছু কি সমান প্রাচীন? ঔপনিষদিক আর বৈষ্ণব ধর্ম কি সমান প্রাচীন? এইসব পুরাতাত্ত্বিক প্রশ্নের উত্তর কে দেবেন, জানি না।
আরও পড়ুন: প্রতিটা অনৈতিক গ্রেপ্তারির সমান্তরালে ক্ষয়ে যায় গণতন্ত্র
২.
কিন্তু মোদ্দা ফল যা দাঁড়াল, এই শব্দযুদ্ধের কারণে নির্বাচনের আগে, ভারতবাসীর ঘাড়ে আর একটা বিপুল খরচের দায় চাপল। এমন নয় যে, ভারতের দারিদ্র সম্পূর্ণ দূর হয়ে গেছে অমৃত মহোৎসবের মওকায়, শিক্ষায়, সমৃদ্ধিতে, স্বাস্থ্যে আনন্দে থইথই করছে দেশে, রাষ্ট্রের কর্তব্যের হাত একেবারে খালি, কাজেই ইন্ডিয়াকে ভাগাও, ভারতকে লাগাও। দেখা যাচ্ছে, থরহরি কম্পমান শাসকেরা নির্বাচনকে ছাড়িয়ে এটাকে একটা পাকাপাকি ব্যবস্থার রূপ দিতে চলেছে। এর মূলে আছে আর-একটা কুসংস্কার, যেন সব ‘ইন্ডিয়া’ মুছে ‘ভারত’ করলে শাসকদের দল চিরস্থায়ীভাবে ভারতের সিংহাসনে অনড় হয়ে সেঁটে থাকবে। তা যদি এরা ভেবে থাকে সে গুড়ে যথেষ্ট পরিমাণ বালি শুধু নেই, প্রচুর কাঁকরও আছে।
কী কী পরিবর্তন করতে হবে, তার তালিকা করা হয়তো আমাদের মতো লোকের অসাধ্য। আমি ঐতিহাসিক নই, নথিসংগ্রাহক তথ্যভাণ্ডারীও নই, জিজ্ঞাসু নাগরিকমাত্র। এর মধ্যেই স্বাধিকারপ্রাপ্ত সংগঠন এনসিইআরটি-র কাছে নির্দেশ চলে গেছে, আর সে নির্দেশ তারা মাথা নত করে মান্যও করেছে যে, সিবিএসই আইএসসি ইত্যাদির যত পাঠ্যবই আছে, সব জায়গাতেই ‘ইন্ডিয়া’ কেটে ‘ভারত’ করতে হবে। কীভাবে তা সম্ভব হবে, জানি না। যেখানে সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্য বা প্রপার নাউন আছে, সেখানেও কি এই কর্ম হবে? ধরা যাক, বিভার্লি নিকলসের ‘মাদার ইন্ডিয়া’ বইটার উল্লেখ আছে কোথাও, সেটাও কি কেটে ‘মাদার ভারত’ করবে? বা ব্যাশাম সাহেবের ‘দ্য ওয়ান্ডার দ্যাট ওয়াজ ইন্ডিয়া’? এরা আমাদের সংবিধানের প্রথম বাক্য ‘ইন্ডিয়া দ্যাট ইজ ভারত’ কেটে ‘ভারত দ্যাট ইজ ভারত’ করবে না তো? আমি তো সেই ভেবেই আতঙ্কে শিউরে আছি। শুনেছি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছেও নির্দেশ গেছে, এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কও নাকি চটপট নোটিস জারি করেছে। এবার ‘রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ভারত’ হবে, ‘স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ভারত’ হবে (আমার ব্যাঙ্কের নাম আর নথিপত্রও বদলে যাবে, ‘ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্ক’ ‘ভার্তীয় ব্যাঙ্ক’ হবে।) শুধু তাই নয়, যত নোট, মুদ্রা সমস্ত কিছুতে ইন্ডিয়া কেটে ভারত বসাতে হবে। অনেকগুলিতে মহাত্মা গান্ধী হাসিমুখে বসে আছেন, তিনি ব্যাপারটা কীভাবে দেখবেন, জানি না। আমাদের ডাকঘরগুলিতে ‘ইন্ডিয়া পোস্ট’ লেখা আছে, দেশজুড়ে তার লক্ষ লক্ষ সাইনবোর্ড নতুন করে লেখাতে হবে। ভারতে যতকিছু উৎপাদিত হয়, ওষুধ ও প্রসাধনদ্রব্য, যন্ত্রপাতি, জামাকাপড়, বাসনকোশন, বইপত্র, টুথ ব্রাশ, পেস্ট থেকে দাড়ি কামানোর জিনিসপত্র, অর্থাৎ যা কিছু ব্র্যান্ডিং আর প্যাকেজ করতে হয়, সব কিছুতে ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’র বদলে ‘মেড ইন ভারত’ লিখতে হবে। এমনকী, ভারতের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং সিংহাসনে বসার কিছু পরে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ বলে একটা স্লোগান দিয়েছিলেন, তারও কী সদগতি হবে, জানি না।
এখানেই শেষ নয়। সরকারি এলাকার বাইরে, প্রাইভেট যে কোম্পানিগুলি, তাদের নামে ‘ইন্ডিয়া’ থাকলে তাদেরও কি সেগুলো বদলাতে বাধ্য করা হবে? তারা তো সরকারের নির্দেশ মানতে বাধ্য নয়! বা এই পরিবর্তন কি ‘মেরা ভারত মহান’-এর সীমানায় আবদ্ধ থাকবে? ধরুন, বিদেশে, সেখানে কী হবে? সেখানে প্রচুর ‘ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট’ আছে, যাতে ‘ইন্ডিয়ান কুইজিন’ পরিবেশন করা হয়, তাদের নাম বলাতে বাধ্য করা হবে? রাজার হাত কতটা লম্বা, তাই ভাবছি আমরা। মুম্বইয়ের সমুদ্রতীরে, তাজ বেঙ্গলের সামনেকার ‘গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া’-এ কী হবে? দিল্লিতেও তো বোধহয় একটা ‘ইন্ডিয়া গেট’ আছে, তার? আরও আছে। এই যে অন্য দেশের নাম নিয়ে হাজারও প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে– ইন্ডো-বাংলা, ইন্ডো-জার্মান, ইন্ডো-হাঙ্গেরিয়ান ইত্যাদি ইত্যাদি, সেগুলোও বদলাতে হবে।
বাংলাদেশের মানুষদের বলতে হবে, ভাইগণ, আপাগণ, আপনারা কথায়-কথায় আর ‘ইন্ডিয়ান ইন্ডিয়ান’ কইয়েন না দয়া কইরা, ভারতীয় বলা অভ্যেস করুন।
এর নানা কর্মে যে বিপুল খরচ হবে, তা তো জনসাধারণের দেওয়া ট্যাক্সের টাকারই এক রকমের শ্রাদ্ধশান্তি, তাই না? তা তো শাসক বা শাসকদলের পকেট থেকে আসবে না, তাঁদের বন্ধু শিল্পপতিরাও জোগাবেন না। তাহলে? এ এক উন্মাদের কারবার বলে আমার মনে হয়, গোষ্ঠীবিশেষের একটা রাজনৈতিক আতঙ্ক থেকে এই মূঢ় অপব্যয়ের দায়। আমি এই ‘তাহলে’-র হেঁয়ালির সামনে আমার বিহ্বল জিজ্ঞাসা নিয়ে বসে থাকি।
৩.
আমার এক অতিচালাক বন্ধু এই বিষয়টা নিয়ে এক বিচিত্র ঠাট্টা করল। বলল দ্যাখ, আমেরিকানরা আমাদের শাসকদের বুকজোড়া বন্ধু, তা শুধু প্যালেস্তাইন নীতি কেন, এই ব্যাপারটা থেকেও বোঝা যায়। আমি বোকার মতো বললাম, কীরকম? সে বলল, কেন, এই যে ওরা রেড ইন্ডিয়ান নামটা তুলে দিয়ে ‘নেটিভ আমেরিকান’ করে নিল, তাতে কি এর ইঙ্গিত নেই? কিংবা ওদের একটা রাজ্যের নামও রেখেছে ‘ইন্ডিয়ানা’, তার রাজধানীর নাম ‘ইন্ডিয়ানাপোলিস’। ইন্ডিয়ানা মানে ‘ইন্ডিয়া-না’। সহজ ব্যাপার!
আমি হাসব না কাঁদব, বুঝতে পারলাম না।