গত শতকের শেষভাগে ‘ফ্যাবইন্ডিয়া’কে চেনা এক আশ্চর্য চোখ-ফোটা! ঋতুদাকে দেখেছি এ ধরনের পোশাক পরতে, কাটগুলো সব একরকম, অচেনা, বাহারি প্রিন্ট, কাঠবোতাম। লজ্জায় আর জিজ্ঞেস করিনি, উঁকিঝুঁকি মেরে ‘ইন্ডিয়া’ কথাটুকু পড়তে পেরেছিলাম। তারপর জেনেছিলাম, এসব বস্তু কেবল দিল্লিতে পাওয়া যায়, রাজধানী কি না! সেই ‘ফ্যাবইন্ডিয়া’ চোখের সামনে দেখে অবিশ্বাস্য আনন্দ হয়েছিল! উত্তেজনা এতটাই, একটা ভুল সাইজের কুর্তা কিনে ফেলেছিলাম।
১১.
লোরেটো হাউসের দিক থেকে পার্ক স্ট্রিটের দিকে হেঁটে এলে ডানদিকে একটা দোকান পড়ত। এমনিতে ইংরেজি হরফে লেখা ‘আবিষ্কার’, কিন্তু ঋতুদা ‘আভিষ্কার’ বলত। স্থানমাহাত্ম্যের ওপর ভাষার বিকাশ বা ‘ভিকাশ’ চিহ্নিত হয়। ওই বিপণিতে একটা দুরন্ত আবিষ্কার ছিল আমার। কলকাতার একমাত্র জায়গা যেখানে ‘ফ্যাবইন্ডিয়া’র পাঞ্জাবি পাওয়া যেত। অবশ্য পাঞ্জাবি নয়– কুর্তা, যার ঝুলটি সবসময়ই আলখাল্লাসম বৃহৎ। গত শতকের শেষভাগে ‘ফ্যাবইন্ডিয়া’কে চেনা এক আশ্চর্য চোখ-ফোটা! ঋতুদাকে দেখেছি এ ধরনের পোশাক পরতে, কাটগুলো সব একরকম, অচেনা, বাহারি প্রিন্ট, কাঠবোতাম। লজ্জায় আর জিজ্ঞেস করিনি, উঁকিঝুঁকি মেরে ‘ইন্ডিয়া’ কথাটুকু পড়তে পেরেছিলাম। তারপর জেনেছিলাম, এসব বস্তু কেবল দিল্লিতে পাওয়া যায়, রাজধানী কি না! সেই ‘ফ্যাবইন্ডিয়া’ চোখের সামনে দেখে অবিশ্বাস্য আনন্দ হয়েছিল! উত্তেজনা এতটাই, একটা ভুল সাইজের কুর্তা কিনে ফেলেছিলাম। পরে লোকাল দর্জি দিয়ে ঝুলটা ছোট করাতে হয়। ঘরে নেই তেল, এদিকে আখাম্বা চিতলমাছ কিনে আনলে যা হয়। শুধু ‘ফ্যাবইন্ডিয়া’ নয়, আরও অপূর্ব সব উপহার সামগ্রী মিলত ‘আভিষ্কার’-এ। একটু এগোলেই বাঁদিকে ‘মিউজিক ওয়ার্ল্ড’। সেরা দশের ক্যাসেট র্যাক দেখতে যেতাম।
ঋইউনিয়ন। ১০ম পর্ব: পরিচালক হলে খিস্তি দিতে হয় নাকি!
ভারতীয় মার্গসংগীত, ওয়েস্টার্ন, হিন্দি ফিল্মস– সব আলাদা আলাদা গলি ছিল। বিদেশি অ্যালবামের অমন সম্ভার তার আগে দেখেনি কলকাতা! প্রতিটি গলির মুখে রাখা হেডফোন। ইচ্ছে করলে সারাদিন দাঁড়িয়ে শোনো। ‘দ্য কিংসটন ট্রায়ো’র একটা গোটা ক্যাসেট একবার শুনেছিলাম এক বিকেলে। ওপাশে বাংলা ব্যান্ডের জায়গা। খোঁজ নিতাম, বিক্রি হচ্ছে কি না। ‘মিউজিক ওয়ার্ল্ড’-এর ভেতর একটা ছোট স্টেজ ছিল। ২ বছর পর ওই মঞ্চে আমাদের ‘চ’ অ্যালবাম রিলিজ করবেন শঙ্খ ঘোষ, মমতাশঙ্কর ও ঋতুদা। সে গল্প পরে।
ঋইউনিয়ন। ৯ম পর্ব: সেই প্রথম কেউ আমায় ‘ডিরেক্টর’ বলল
গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কলকাতার প্রথম টি-রুম ফ্লুরিজ। পুরনো নামটিতে একখানি অ্যাপোসট্রফি ঝুলে, ঊর্ধ্বগগনে ঊর্ধ্বকমাটি অহংকারী পার্ক স্ট্রিটের অঙ্গে একচিলতে অলংকার। তারা-য় চাকরি পাওয়ার পরই সাহস পেয়েছিলাম এই মার্বেল মেঝেতে পা রাখার। ফ্লুরিজ-এর টি-স্যান্ডউইচ বা বাবা কেকের স্বাদ সেই কলকাতার মতোই লোভনীয় ছিল। টিভি চ্যানেলের অফিসে সিটিং-এ ঝুটঝামেলা সারাদিন লেগেই থাকে। কাজ যত না, তার চেয়ে মিটিং অনেক বেশি! তখনও বুঝিনি ‘মিটিং’ জিনিসটা কোভিডের চেয়েও বড় ভাইরাস। জীবনে একবার লেগে গেলে আর ছাড়ে না। পার্ক স্ট্রিট ছিল আমার বিকেলের সান্ত্বনা। একলা হাঁটার রাজপথ। অকশন হাউসগুলোর ভিতর দাঁড়ালে ফিটন গাড়ির শব্দ শোনা যেত।
চ্যানেলে চাকরির একটাই শর্ত, ২৪ ঘণ্টার দাসখত। ফলে বিকেলের পালিয়ে যাওয়াটুকু খুব প্রয়োজনীয় ছিল। তারপর আসর বসত এডিট আর গ্রাফিক্সের দপ্তরে। দেবাশিস, ইন্দ্র ছিল এডিটর, কৌশিক আর দেবু ছিল গ্রাফিক্স আর্টিস্ট। মেশিনগুলো কেমন স্পিডে কাজ করত, তা ওইসময়ে আর এখনকার রানরেটের তুলনা টানলে বোঝা যায়। ‘রেন্ডারিং’ বলে একটা নতুন শব্দ শিখলাম।
–কী রে হল?
এ প্রশ্নের একটাই জবাব, ‘রেন্ডার হচ্ছে।’
–কখন শেষ হবে?
–মেশিন জানে।
রান্না চাপিয়ে যেমন ‘বিবিধ ভারতী’ শুনত মানুষ, তেমনই রেন্ডার চাপিয়ে আমরা রাতের পর রাত জাগতাম। ক্যামাক স্ট্রিটের এককোণে ছিল আর এক বিখ্যাত দোকান– লালুজ। কলকাতার সেরা সালামি, হ্যাম পাওয়া যেত ওখানে। দুশো গ্রাম কনকনে ঠান্ডা হ্যামের মধ্যে বরফকুচির মতো আমাদের হ্যাহ্যাহিহিরা মিশে ছিল। সেসময় কুইজের কমন প্রশ্ন ছিল: ‘অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর সরণী রাস্তাটিকে কী নামে আমরা চিনি?’ উত্তর, ক্যামাক স্ট্রিট। ওই সময় রাস্তাটি ছিল উচ্চ-মধ্যবিত্তের বাস। বাণিজ্যবেনিয়ারা তখন সবে ছিপ ফেলতে শুরু করেছে। রাস্তার এককোণে ছিল দেশজ হ্যান্ডলুমের দোকান– বেঙ্গল হোম। কাঠের সিঁড়িওলা বাড়িটি ছিল সম্ভ্রম ও আভিজাত্যে মোড়া। দীর্ঘদিন থেকেছেন অবনীন্দ্রনাথ। কলকাতা তখনও অবধি কলকাতাতেই থাকত। কেনিলওয়ার্থের পাশ দিয়ে হেঁটে, রাসেল স্ট্রিট ধরে, ডানদিকে পার্ক স্ট্রিট রেখে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ পেরিয়ে কবরতলা, অলস পাগল উপুড় হয়ে পড়ে থাকত ঘাসে। ইলিয়ট রোডে ট্রামলাইনের নীচে ছিল কব্লস্টোন, মন্থর সাপের মতো আঁকাবাঁকা সে লাইন।
পার্ক স্ট্রিটের হকারেরা ইংরেজিতে কথা বলত, যদি তাতে দু’টি পশরা বেশি বিক্রি হয়। রাত দুটো-তিনটেয় অফিস থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি মিলত ক্যামাক স্ট্রিট-পার্ক স্ট্রিটের সংযোগস্থলে– বাড়ি ফিরে যেতে যেতে মনে হত, হয়তো অন্য কোথাও যাওয়ার কথা ছিল আমার। সেই বদলে যাওয়া কলকাতায় আমার স্পর্ধার যৌবন মিশে আছে। ওই উদ্দেশ্যবিহীন দিনগুলি রাতগুলি, ওপর থেকে পড়তে পড়তে, ফ্রিজশটের মতো ঝরতে ঝরতে, পি সি সরকারের সেই জাদু গ্লাসটপটার মতোই, ভাঙেনি।