ছোটবেলার বিকেলে, লেম ম্যান খেলার সময় এক পায়ে যখন ব্যথা ধরে যেত, অবলীলায় বদলে নিতাম সেই পা। অন্য পায়ে ল্যাংচাব কিছুক্ষণ। ডানদিক বাঁদিক তাকিয়ে, কখনও একটু অপেক্ষা করে তারপর হঠাৎ স্পিড বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেব বন্ধুকে। তৎক্ষণাৎ সে হয়ে হবে ল্যাংড়া।
১৩.
আমের সিজন ফুরিয়ে গেলে ল্যাংড়া তার আসল অর্থ খুঁজে পায়। খঞ্জ বা খোঁড়া। তখন শাঁস খেয়ে ফেলে দেওয়া আঁটিসম তাকে ঠোকরায় কাক আর হাত-পা-অলা মনুষ্যকুল মুখ ঘুরিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে হরি বুধা মাগর-এর মতো কেউ দু’পা না থাকা সত্ত্বেও, প্রস্থেটিক পা নিয়ে এভারেস্টে উঠে পড়েন। দুর্ভাগ্যক্রমে ২০২৩-এর আমের সিজনে, তাই ল্যাংড়ার স্বাদ কেন ভালো হল না– তা নিয়ে আমরা যত তার্কিক আলোচনায় মাতি, ‘ল্যাংড়া’ হরি তাঁর কানাকড়িও ফুটেজ পান না।
আসল ব্যাপার হল যাঁর পা-ই নেই, তিনি ফুটেজ পাবেন কী করে! হরি, নেপালে প্রায় সাড়ে সাত হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের গায়ে, একটি গোশালায় জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ১৯ বছর বয়সে ‘রয়্যাল গোর্খা রাইফেলস’-এর মাধ্যমে ব্রিটিশ আর্মিতে যোগদান। ২০১০ সাল নাগাদ আফগানিস্থানে একটি ইম্প্রভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) মাড়িয়ে ফেলার কারণে যে বিস্ফোরণ হয়, তার ফলশ্রুতি দু’টি পায়ের-ই হাঁটুর নিচের অংশ বিলকুল ভ্যানিশ। এই অবস্থায় তো যুদ্ধ করা যায় না, তাই উনি অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস-এ মনোনিবেশ করেন। কী আশ্চর্য! কোথায় একটু হাতের ওপর ভর দিয়ে জিরবেন, তা নয়, একেবারে স্কাইডাইভিং, রক ক্লাইম্বিং ইত্যাদি কঠিন খেলায়! কে বলতে পারে ২০১২-তে যখন অস্কার প্রিটোরিয়াস নকল পা নিয়ে দৌড়েছিলেন আসল মানুষদের অলিম্পিক্সে, হরি হয়তো ভরসা পেয়েছিলেন। প্রিটোরিয়াস নিজের বান্ধবীকে ধাঁই করে গুলি করে মেরে ফেললেন। আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়লাম তাঁর তিন, পাঁচ নাকি পনেরো বছরের জেল হবে, সেই আলোচনায়। তাঁর প্রতিবন্ধকতাকে ছাপিয়ে গেল সেই জঘন্য অপরাধ। অসাধারণ অ্যাথলিট থেকে তিনি সাধারণ ক্রিমিনাল হয়ে গেলেন।
ছোটবেলার বিকেলে, লেম ম্যান খেলার সময় এক পায়ে যখন ব্যথা ধরে যেত, অবলীলায় বদলে নিতাম সেই পা। অন্য পায়ে ল্যাংচাব কিছুক্ষণ। ডানদিক-বাঁদিক তাকিয়ে, কখনও একটু অপেক্ষা করে তারপর হঠাৎ স্পিড বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেব বন্ধুকে। তৎক্ষণাৎ সে হয়ে যাবে ল্যাংড়া। কখনও পাশ দিয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে যাবেন বাবার বন্ধু ধূর্জটিকাকু। একহাতে লাঠি। আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসবেন। ধূর্জটিকাকুর একটি পা চলে গিয়েছিল ডাবল ডেকার বাসের নিচে। কম্পাউন্ড ফ্র্যাকচার। সেই পায়ে আর জোর ফেরেনি। তা সত্ত্বেও তিনি চষে ফেলতেন সারা কলকাতা। নাটক করতেন, অভিনয়, নির্দেশনা। বাবার জন্মদিনে, প্রতি বছর সন্ধেবেলা তিনি আসতেন হাতে কিছু না কিছু উপহার নিয়ে, মিষ্টির বাক্স, বা বই, ফাউন্টেন পেন। এক জন্মদিনে, অনেক রান্না করেছেন মা, তিনি এলেন না। মনে আছে, দীর্ঘ লোডশেডিং তখন। বাবা অভিমান করে বললেন, ‘ধূ আমায় ভুলে গেছে।’ তার দিন চারেক পরে বোঝা গেল আমরাই ওঁকে ভুল বুঝেছিলাম। কাকু হাসপাতালে। এবার ট্রাম থেকে নামতে গিয়ে অঘটন। ভুল করে খোঁড়া পায়ে ভর দিয়েছিলেন, ব্যালান্স রাখতে পারেননি। ট্রামের চাকা বাসের মতো সদয় নয়। তাঁর সমর্থ পায়ের পাতা কুচুৎ করে কেটে দিয়েছে। ফাউ হিসেবে লাঠিটাও দু’-টুকরো। বাবা হাসপাতাল থেকে ফিরলেন চোখে জল নিয়ে। আর আত্মগ্লানি পুষে রাখলেন অনেক দিন। এরপর যখন ধূর্জটিকাকু আমাদের বাড়ি এলেন, তখন তাঁর এক হাতের ফাঁকে ক্রাচ, এক পায়ে জয়পুর ফুট। অন্যবারের মতোই প্রণাম করতে গিয়েছিলাম। উনি মাঝপথে থামিয়ে দিলেন। যত দিন গেল ওঁর ওই কাটা পা-টি ছোট হতে থাকল। তারপর একদিন বিছানায় বসে লম্বা প্রস্থেটিক পা খুলে দেখালেন। মুখে হাসি, যেন একটু নিশ্চিন্ত। অপারেশনের ঝক্কি আর পোহাতে হবে না। আমার প্রতিবেশীদেরও খুব উৎসাহ। কয়েকজনকে, বিশেষ করে কমবয়সিদের, আড়ালে-আবডালে হাসাহাসি করতেও শুনেছি। আম ও ধূর্জটিকাকুকে গুলিয়ে ফেলার অদম্য ইচ্ছা তাদের মধ্যে প্রকট, এই উপলব্ধি আমায় কিঞ্চিৎ বিষণ্ণ করেছিল।
কলকাতার প্রিটোরিয়াসরা কোথায় জেল খাটছেন জানা নেই। ধূর্জটিকাকু রানি ব্রাঞ্চ রোড ছেড়ে চলে গেছেন অনেক দিন, মহাশূন্যে। এই সেদিন, সন্ধে হব হব, হরি বুধা মাগর-এর মতো কাউকে দেখলাম মনে হল কলেজ স্ট্রিটে। দু’হাতে ভর দিয়ে ফুটপাথের ওপর হাঁটুসর্বস্ব পা দু’টি ঘষটে এগিয়ে চলেছেন। এবার বোধহয় ম্যারাথনে নাম লিখিয়েছেন।