বঙ্গভঙ্গের সময়ে যে স্বদেশী হাওয়া উঠল তাতে প্রথমবার মার্কপোলোর সঙ্গে চ্যালেঞ্জ নিয়ে বসল ‘ইস্ট ইন্ডিয়া সিগারেট ম্যানুফ্যাকচারিং কোং’ ঠিক করল তাঁরাও সিগারেট বানাবে। দেশি পদ্ধতিতে। জয় কালী বলে শুরু করলে যে কোনও কাজ নাকি উতরে যায়। তাই সিগারেটের নামও হল ‘কালী সিগারেট’। একমাত্র ডিস্ট্রিবিউটার হলেন ১৩৯, হ্যারিসন রোডের এ এইচ জহর।
সে এক দারুণ সময়!
মাত্র কয়েক বছর হল জ্যাকোয়া নিকট সাহেব পর্তুগাল থেকে ফ্রান্সে ফিরে আসার সময় বড় বড় পাতার তামাক গাছ সঙ্গে নিয়ে এলেন। ফরাসিরা আগে এ গাছ দেখেনি। তাই সেখান থেকে যা পাওয়া গেল, তার নাম হয়ে গেল ‘নিকোটিন’। আর সেই গাছের পাতা মুড়ে ভিতরে পাতার গুঁড়ো পুরে তৈরি হল সিগার। এই সিগারে কাগজের খোল লাগতেই নাম বদলে সিগারেট। ছোট্ট সিগার। এই সিগারেট হাতে পেতেই গোটা ফ্রান্স আর লন্ডন জুড়ে যে মাতামাতি শুরু হল, তা দেখার মতো!
পৃথিবীর প্রথম আধুনিক গোয়েন্দা দুপঁর ছিল সিগারেটের নেশা। সারাদিন ঘরে দরজা বন্ধ করে সিগারেট খেতেন আর বই পড়তেন। হোমসের তো কোকেন, আফিম কিছুই বাদ ছিল না। তবে পাতলা কাগজে সিগারেট বানিয়ে খেতেও দেখি তাঁকে। পোয়ারো এসব ব্যাপারে আলসে। সরু ছোট ভিয়ানিজ সিগারেট কখনও কখনও খান। বিদেশি গোয়েন্দাদের দেখাদেখি বাংলাতেও সিগারেট নতুন স্টাইল স্টেটমেন্ট হয়ে গেল খুব তাড়াতাড়ি। জেমস বন্ড গুপ্তচর এবং গোয়েন্দা। সেকেন নট স্টারড মার্টিনির সঙ্গে চেরি মার্কা, তিনটে সোনালি রিবন মার্কা নানারকম সিগারেট খান তিনি। মহিলাদের মতো সিগারেট বিষয়েও তাঁর তেমন বাছবিচার নেই।
নতুন আর সহজে বহনযোগ্য এই নেশা বাঙালিকে পেড়ে ফেলল একেবারে। বাঙালি গোয়েন্দাদের মধ্যে প্রিয়নাথ দারোগা সিগারেট চুরুট দুটোই খেতেন। ফেলুদা শুরু থেকে চারমিনারের ধোঁয়ায় রিং বানায়। জীবনে কোনও দিন চা আর তামাকের ব্র্যান্ড পাল্টায়নি সে। ‘চিত্রচোর’-এর সময় ব্যোমকেশের সিগারেট খাওয়া কমেছিল, এ তো সবাই জানে। ঘনাদা গোয়েন্দা নন, কিন্তু বনমালী নস্কর লেনের মেসে শিশিরের আনা টাটকা সিগারেট ছাড়া তাঁর গল্পও ঠিক জমে না।
ঘনাদার সিগারেটের কৌটো আসত কোন দোকান থেকে? খুব যদি ভুল না করি, তবে শিশির নিশ্চয়ই সেটা ১৩/৩, গভার্নমেন্ট প্লেসের মার্কপোলোর দোকান থেকে কিনে আনত। ১৮৮৫ সালে এদেশে এসে সিগারেটের ব্যবসায় ‘মার্কপোলো’ জাঁকিয়ে বসেছিল। ‘মোস্ট ডেলিকেট অ্যান্ড এরোমেটিক’ নামে তাদের বিরাট বিজ্ঞাপন পড়ত রাস্তাজুড়ে। ১০০টা সিগারেটের একটিনের দাম ৩ টাকা ৮০ পয়সা।
বঙ্গভঙ্গের সময়ে যে স্বদেশী হাওয়া উঠল তাতে প্রথমবার মার্কপোলোর সঙ্গে চ্যালেঞ্জ নিয়ে বসল ‘ইস্ট ইন্ডিয়া সিগারেট ম্যানুফ্যাকচারিং কোং’ ঠিক করল তাঁরাও সিগারেট বানাবে। দেশি পদ্ধতিতে। জয় কালী বলে শুরু করলে যে কোনও কাজ নাকি উতরে যায়। তাই সিগারেটের নামও হল ‘কালী সিগারেট’। একমাত্র ডিস্ট্রিবিউটার হলেন ১৩৯, হ্যারিসন রোডের এ এইচ জহর। অবশ্য মনে রাখতে হবে, একই সময়ে বাংলার বিপ্লবীরা ব্রিটিশ হটাতে যে বোমা বানাচ্ছেন, তার গোপন নাম ‘কালী বোমা’।
কালী সিগারেটের অবশ্য তেমন মহৎ আদর্শ কিছু ছিল না। যে সময় চা-কে বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে বিজ্ঞাপন লেখা হচ্ছে ‘যাহাতে নাহিক মাদকতা দোষ/ কিন্তু পানে করে চিত্ত পরিতোষ’, তেমনি এই কালী সিগারেটের বিজ্ঞাপনে লেখা হল–
‘যদি বিশুদ্ধ স্বদেশী সিগারেট ব্যবহার করিয়া শ্বাস কাশ প্রভৃতি পীড়ার আক্রমণ হইতে অব্যাহতি পাইতে চাহেন, তবে *ক* এই চিহ্ন অঙ্কিত কালী সিগারেট ব্যবহার করুন। কালী সিগারেটের তুল্য নির্দ্দোষ সিগারেট এ পর্য্যন্ত আবিষ্কৃত হয় নাই’।
এই ‘বিশুদ্ধ’ শব্দের একটাই মানে। কোনও ইংরেজের হাত এতে পড়েনি। যেমন প্রথমবার ‘অন্নদামঙ্গল’ ছাপার সময় বিজ্ঞাপিত হয়েছিল ছাপার কালি নাকি গঙ্গাজলে তৈরি। এটুকু মেনে নেওয়াই যায়। কিন্তু তা বলে কাশি থেকে অব্যাহতি পেতে সিগারেট? একটু চমকালেও সেকালের বেশ কিছু লেখায়, বিশেষ করে ওডহাউসের জিভসে ইংরেজ ডাক্তারদের নিউমোনিয়ায় রক্ষা পেতে সিগারেট প্রেসক্রিপশান করতে দেখি। স্বয়ং শিবরাম-ও ‘ইউক্যালিপটাস’ সিগারেটের কথা লিখেছেন। সম্ভবত সিগারেটের কাগজে এই ইউক্যালিপটাস অয়েল জাতীয় কিছু মেশানো হয়ে থাকবে। নইলে বিজ্ঞাপনের পাশেই কেন লেখা হবে–
‘যে কাগজে কালী সিগারেট আবৃত উহাতে এমন এক অভিনব পদার্থ সংমিশ্রিত হইয়াছে যে উহার ধূমপান করিলে শ্বাস, কাস প্রভৃতি পীড়া হইবার আশঙ্কা থাকে না। ইহা ইষ্ট ইণ্ডিয়া সিগারেট ম্যানুফ্যাক্চরিং কোম্পানীর দ্বারা কলিকাতা সহরে প্রস্তুত’।
আরও পড়ুন: অবসাদের বন্ধু যখন অবহেলায় বাঁচে
কিন্তু শুধু নিজের সিগারেটের বিজ্ঞাপন দিয়েই জহরবাবুর কোম্পানি থামেননি। চারিদিকের আগুনখেকো বিপ্লবের সঙ্গে একে মিশিয়ে দিয়ে দেশপ্রেমের যে ভয়ানক সুড়সুড়ি দিয়েছিলেন, তার জবাব নেই। বিজ্ঞাপনে এ-ও লেখা ছিল–
‘যদি স্বদেশী দ্রব্যের উন্নতি সাধনে আপনাদের যত্ন থাকে, যদি দীন দুঃখী শ্রমজীবীদিগকে প্রতিপালন করা আপনাদের কর্তব্য হয়, যদি যথার্থই ভাল মন্দ বিচার করেন, তবে হে হিন্দু ভাতৃগণ! এই কালী সিগারেট ব্যবহার করুন’।
সোজা কথা, যেটা সেই স্বদেশী আমলের বৈশিষ্ট্য ছিল, ‘দেখতে খারাপ, চলে কম, দামটা একটু বেশি’ তেমনই কোনও এক সিগারেট বানিয়ে এই নব্য জাগ্রত দেশপ্রেমের আগুনে নিজেদের সেঁকে নিতে চেয়েছিলেন তারা। ‘কালী’ নামে যদি মদ্যপান, গাঁজা সেবন করা যায়, তবে সিগারেট নয়ই বা কেন? স্বভাবতই কালী সিগারেটের আয়ু খুব বেশিদিন ছিল না। এর অর্ধেক দামে কিছু দিন পর থেকেই কাঁচি সিগারেট আর পাসিং শো- এসে কালীর বাজার এতটাই মেরে দেয় যে, স্বয়ং তারানাথ তান্ত্রিক পর্যন্ত কালী ছেড়ে পাসিং শো-তে টান মারেন।
আরও পড়ুন: জয় শ্রীরাম নয়, রাম হায়দারের গল্প বলেছিলেন ত্রৈলোক্যনাথ
তাহলে এতদিন পরেও এই বিজ্ঞাপন নিয়ে আলোচনার কারণ কী?
১৮৭৮ সালে দেবদেবীর লিথোগ্রাফ ছবি বানানোর জন্য বউবাজার স্ট্রিটে স্থাপিত হয়েছিল চোরবাগান আর্ট স্টুডিয়ো। মূলত অন্নদাপ্রসাদ বাগচীর উৎসাহে। সঙ্গে ছিলেন তাঁর শিষ্যসম নবকুমার বিশ্বাস, ফণীভূষণ সেন, কৃষ্ণচন্দ্র পাল আর যোগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। তাঁরাই জহরবাবুকে ৪২ সেমি বাই ৩২ সেমির এক লিথো বিজ্ঞাপনটি বানিয়ে দেন। মা কালীর এমন আশ্চর্য জীবন্ত ছবি খুব কম দেখা গেছে। কালীর ঘন নীল গায়ের রং, মাটিতে লুটিয়ে আছেন শিব, আকাশের সব দেবদেবীরা হাত জোড় করে তাঁর বন্দনায় রত, মাটিতে ডাকিনী যোগিনীরা অসুর সংহারে মগ্ন। মায়ের খাঁড়া থেকে রক্তের একটি ফোটা যেন এখুনি ঝরে পড়বে মাটিতে। যেন এক দক্ষ ফোটোগ্রাফার যুদ্ধের এক ক্ষণকালকে নিজের ক্যামেরায় বন্দি করেছেন। কালীর সারাদেহ রক্তস্নাত। তবু মুখটি অদ্ভুত স্নিগ্ধ, মায়াময়ী। মায়ের মতো ভালো।
পরবর্তীকালে এ ছবির কত নকল কতবার হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। বিপ্লবীদের ঘরে ঘরে শোভা পেয়েছে এ ছবির কপি। অনেক পরে স্বাধীন ক্যালেন্ডার আর্ট হিসেবেও পৌঁছে গেছে আমজনতার ঘর থেকে লীনা মনিমেকালাইয়ের সিনেমা অবধি।
কালী সিগারেট তাই পৃথিবীর সেই দুর্লভ বিজ্ঞাপনের একটা, যেখানে প্রোডাক্ট ক্ষণকালের। ব্র্যান্ড চিরকালীন।