ঠাকুরবাড়ির কোনও ঘরে চিলতে আলোরও দেখা নেই। আর দেরি নয়। এবার স্ত্রী সারদাকে ডাক পাঠানো যেতেই পারে। আর তো মাত্র দু’-দিন তিনি কলকাতায় থাকবেন। তারপর আবার হিমালয়ে। নির্জন সাধনায়। না, স্ত্রীকে আনন্দ থেকে বঞ্চিত করা উচিত কাজ নয়। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কর্তব্যে অবহেলায় কখনওই সায় দেয় না দেবেন্দ্রর মন।
১৩,
মশারির মধ্যে পালঙ্কে পরস্পরের হাতে হাত রেখে জ্ঞানদানন্দিনী আর মনোমোহন। সত্যেন্দ্র যে হঠাৎ ঘরে চলে আসবেন, খেয়াল ছিল না। মনোমোহন নার্ভাস এবং অপ্রস্তুত। সরিয়ে নিতে চায় হাত। পারে না। জ্ঞানদা হাতটা শক্ত করে ধ’রে সত্যেন্দ্রর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, ‘ঢুকে পড়ো ভিতরে। তুমি না এলে আড্ডা জমছে না। এত দেরি করলে কেন?’
সত্যেন্দ্র জ্ঞানদার স্মার্টনেসে ঠিক ততখানি ইমপ্রেসড্ হয়, যতটা হতাশ হয় মনোমোহনের অপ্রস্তুত অবস্থায়।
–মনো, কেমন দেখলি আমার বউকে? হেসে প্রশ্ন করেন সত্যেন্দ্র।
ব্যারিস্টার মনোমোহন উত্তর খুঁজে পান না। কী বলবেন? তাঁর বুক ধড়ফড় করছে। ছিঃ ছিঃ, সত্যেন্দ্র কী ভাবছে! এখনও তার হাতটা শক্ত করে ধরে আছে সত্যেন্দ্রর বউ। এটা কি দুঃস্বপ্ন না বাস্তব?
–কী রে মনো? তোর হল কী? বাড়ি যাবি না? বউকে কী বলবি? পালঙ্কের পাশে দাঁড়িয়ে হেসে প্রশ্ন করে সত্যেন্দ্র।
–তুমি মনোঠাকুরপোকে ইচ্ছে করে নার্ভাস করে দিচ্ছ কিন্তু। দিস ইজ নট ফেয়ার! বলে জ্ঞানদা। তারপর ছেড়ে দেয় মনোমোহনের হাত।
–এবার তুই মুক্ত। বেরিয়ে আয়। তোকে তো বাড়ির দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিতে হবে। সদরে ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তোকে বাড়ি পৌঁছে দেবে। বেশ রাত হয়ে গেছে রে। আর দেরি না করাই মঙ্গল।
মেজবউঠাকরুণ পর্ব ১২: ঠাকুরবাড়ির দেওয়ালেরও কান আছে
মনোমোহন মশারির বাইরে পা রাখেন। তার শরীর কাঁপছে।
–শরীর খারাপ লাগছে না কি? মৃদু হেসে প্রশ্ন সত্যেন্দ্রর।
মনোমোহন কোনও উত্তর দেন না। বুক পকেট থেকে সোনার ঘড়ি বের করে সময় দেখেন। বলেন, ‘সত্যেন, কথায়-কথায় বেশ রাত হয়ে গেল রে। যাক, তুই যে গাড়ির ব্যবস্থা রেখেছিস, বেঁচে গেছি। না হলে এত রাত্রে হেঁটে বাড়ি ফিরতে হত।’
–এবার ঠিক সেইভাবে আমার সঙ্গে পা মিলিয়ে হাঁটতে থাক। বাবামশায় অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকেন। এবং তাঁর কানও খাড়া থাকে।
–কেন তুমি মনোঠাকুরপোকে নার্ভাস করে দিচ্ছ বলো তো?
সত্যেন্দ্র জ্ঞানদার প্রশ্নের কোনও উত্তর না দিয়ে মনোমোহনের হাত ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। এবং সত্যেন্দ্রর সঙ্গে পা মিলিয়ে হাঁটতে থাকেন অন্দরমহল থেকে বারমহলের দিকে। দু’টি মানুষ হাঁটছে। কিন্তু যেন একজন মানুষেরই হাঁটার শব্দ। দেবেন্দ্র কান খাড়া করে শোনেন। এত রাত্রে বাড়ির বাইরে যাচ্ছে কে? দেবেন্দ্রনাথ বারান্দায় আসেন। না, কাউকে চোখে পড়ে না। এই রকমই হচ্ছে আজকাল। প্রায়ই পায়ের শব্দ শুনতে পান। অথচ কাউকে দেখতে পান না।
মেজবউঠাকরুণ পর্ব ১২: ঠাকুর পরিবারে গাঢ় হবে একমাত্র যাঁর দ্রোহের কণ্ঠ, তিনি জ্ঞানদানন্দিনী
দেবেন্দ্র ঘরে ফিরে জানলার ধারে বসে টেবিলের ওপর উসকে দেন কোজের আলো। প্রবিষ্ট হন উপনিষদে।
–কেমন দেখলি রে আমার বউকে? ঘোড়ার গাড়িতে মনোমোহনকে তুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করেন সত্যেন্দ্র।
–সামলে রাখিস, বলেন মনোমোহন।
সম্পূর্ণ নিঃশব্দে বারমহল-অন্দরমহল পেরিয়ে, কারও ঘুম না-ভেঙে, ঘরে ফিরে আসেন সত্যেন্দ্র। দেবেন্দ্র উপনিষদে নিবিড়। মনে মনে ভাবেন, উপনিষদে সেই নিবিড়তার মধ্যে, স্ত্রী সারদাকে ঘরে ডাকবেন কি না। ঘড়ির দিকে তাকান। না, আরও ঘণ্টাখানেক তাঁকে অপেক্ষা করতেই হবে। ঘরে ঘরে আলো নিভে গেলেও, বাড়ির সবাই এখনও ঘুমিয়েছে কি? সে-বিষয়ে নিশ্চিত না হয়ে স্ত্রীকে ঘরে ডাকেন না মহর্ষি দেবেন্দ্র। সংযত ধৈর্যের অভাব নেই তাঁর নিয়ন্ত্রিত মনে। মহর্ষি দেবেন্দ্র চোখ বুজে তাঁর অন্তরের আলোটিকে দেখার চেষ্টা করেন। কিন্তু ক্রমাগত বিষয়চিন্তা, জমিদারির সমস্যা এবং সংসারে তাঁর শাসন ও প্রতাপ বজায় রাখার চিন্তা পেয়ে বসছে আজকাল। এ-সংসারে কেউ নেই তাঁর ভার গ্রহণের। তিনি ছেড়ে যেতে চান। ডুবে থাকতে চান ব্রহ্মসাধনায়, কিন্তু ছেড়ে যাওয়ার উপায় নেই। তাঁর সমস্ত রাগ আছড়ে পড়ে পিতৃদেব দ্বারকানাথ ঠাকুরের ওপর। পিতৃঋণ শোধ করতে-করতে তিনি আজ নিঃস্ব! কে বুঝবে তাঁর দুঃখ? দেবেন্দ্র উপনিষদ পাঠ বন্ধ করে খোলা জানলার সামনে দাঁড়ান। বেশ রাত এখন। ঠাকুরবাড়ির কোনও ঘরে চিলতে আলোরও দেখা নেই। আর দেরি নয়। এবার স্ত্রী সারদাকে ডাক পাঠানো যেতেই পারে। আর তো মাত্র দু’-দিন তিনি কলকাতায় থাকবেন। তারপর আবার হিমালয়ে। নির্জন সাধনায়। না, স্ত্রীকে আনন্দ থেকে বঞ্চিত করা উচিত কাজ নয়। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কর্তব্যে অবহেলায় কখনওই সায় দেয় না দেবেন্দ্রর মন।
–ব্যাপারটা নিরাপদে চুকেছে তো? সত্যেন্দ্র ঘরে ঢুকতেই প্রশ্ন করে জ্ঞানদা।
সত্যেন্দ্র চুপ!
–মশারির ভেতরে এসো, কথা আছে, বলে জ্ঞানদা।
সত্যেন্দ্র একটিও কথা না বলে মশারির মধ্যে ঢুকে পড়ে। জ্ঞানদা সত্যেন্দ্রর গলা জড়িয়ে তাকে বুকের মধ্যে টেনে নেয় জ্ঞানদা। স্ত্রীর বুকের মাঝখানে সত্যেন্দ্র নাক গুঁজে শ্বাস টানে। ঠিক এই নরম টান, এই গন্ধ, পৃথিবীর আর কোথাও নেই, সত্যেন্দ্র নিশ্চিত। বিলেতের মেয়েদের দেখে সত্যেন্দ্র তো সত্যিই মুগ্ধ হয়েছিল। কিন্তু জ্ঞানদার বুকের মাঝখানটি, – বিলেতে এ-জিনিস নেই। আর নেই জ্ঞানদার চোখের মতো কালো চোখ। আর নেই…
–আর কী কী নেই গো তোমার বিলেতের মেমসায়েবদের, জানতে চায় জ্ঞানদা।
–তোমার সব একে একে দেখাও, তাহলে তো বলবো কী কী নেই তোমার মতো, বিলেতের মেয়েদের।
–একে একে দেখাও মানে? বললেই দেখাতে হবে? তাহলে দাম থাকবে না। সবই তো দেখেছ। নতুন করে দেখারই বা কী আছে?
–রোজ মনে হয়, এই প্রথম দেখলাম, বলেন সত্যেন্দ্র।
–সত্যি? না বানিয়ে বলছ?
–বিশ্বাস করো, প্রত্যেকদিন, নতুন করে পাই। কাল রাত্তিরে…
–কাল রাত্রে কী?
–চাঁদের আলো গায়ে মেখে…
–কী সুন্দর বলো তুমি…
–মশারির মধ্যে এসে পড়েছে চাঁদের আলো। আর জ্ঞানদা, তুমি শুয়ে আছো…
–আর বলতে হবে না, বাকিটুকু না বলা থাক।
–কেন?
–লজ্জা করে।
–লজ্জা করে!– কিন্তু বউ, লজ্জা করতে খুব কি খারাপ লাগে? যদি তা লাগত, তাহলে তুমি ওইভাবে সারা গায়ে চাঁদের আলো মাখতে পারতে?
–আমি সারা গায়ে চাঁদের আলো মাখছিলেম?
–না, ঠিক তা নয়।
–তবে?
–তুমি বললে, সত্যেন্দ্র, অমন তাকিয়ে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখছো কী? তুমি নিজের হাতে চাঁদের আলো আমার সারা গায়ে মাখিয়ে দিতে পার না?
সত্যেন্দ্রর কথা শেষ হতেই হো হো করে হেসে ওঠে জ্ঞানদা। তারপর বলে, বিলেতের চাঁদে কি এমন জ্যোৎস্না আছে?
–না, নেই জ্ঞানু।
–তাহলে বিলেতের মেয়েরা রাত্রে কী মাখে?
–তোমার মনের আসল প্রশ্নটা হল, তাহলে রাত্রে বিলেতের মেয়েদের গায়ে কী মাখিয়ে দিতে?
–কী? কী মাখাতে? ছোট্ট প্রশ্নটি ভেবে কেঁপে ওঠে জ্ঞানদার কণ্ঠে।
(চলবে)