পাঁচশো ডাকাত শিশুর উচ্ছ্বাসে সেই রত্ন কুড়িয়ে এনে জড়ো করল তাদের সর্দারের সামনে। এক পুঁটলিতে সেইসব মহার্ঘ রতন বেঁধে রাখল। ব্রাহ্মণকে খাতির যত্ন করল খুব। দেখতে দেখতে ভোরের আলো ফুটল। তারা বলল, ঠাকুর, চলুন বন পার করে আপনাকে চেতিয় রাজ্যে পৌছে দিয়ে আসি।
মন্ত্রের নাম ‘বেদব্ভ’। হসন্ত দিয়ে লিখলাম বটে, আসলে যুক্তাক্ষর। লেটার প্রেসের আমল হলে লেখকের কাছে তলব যেত, কী শব্দ লিখেছেন, মশায়, ‘ব’-এ ‘ভ’-এ বলে কোনও টাইপ হয় না কি? তা বিদঘুটে নামের এই মন্ত্রের ক্ষমতা সাংঘাতিক। ঠিক ঠিক তিথি-নক্ষত্র যোগ মেনে আকাশের দিকে তাকিয়ে এই মন্ত্রপাঠ করলে সাতরকম রত্নের বৃষ্টি হয়।
ব্রহ্মদত্তের আমলে বারাণসীর এক ব্রাহ্মণ এই মন্ত্র জানতেন। তাঁকে আর তাঁর শিষ্য বোধিসত্ত্বকে নিয়ে এই কাহিনি। তাঁরা দু’জন চেতিয় রাজ্যে যাচ্ছেন। পথে পড়ে এক গভীর বন। সেখানে ‘প্রেষণক’ নামে ৫০০ ডাকাতের এক দল থাকে। ‘প্রেষণ’ মানে প্রেরণ, ‘প্রেষণক’ মানে প্রেরক। তাদের কাজের এক অদ্ভুত ধারার জন্য তাদের এই নাম। পথিকরা সাধারণত জোড়ায় যাওয়াই রেওয়াজ। এরা একজনকে বেঁধে রেখে অপর জনকে মুক্তিপণ আনার জন্য ছেড়ে দেয়।
এক্ষেত্রে ডাকাতরা বেঁধে রাখল গুরুকে। আর শিষ্যকে বলল, তোমাকে দু’দিন সময় দিচ্ছি, টাকা জোগাড় করে আনো।
বোধিসত্ত্ব ব্রাহ্মণকে আশ্বস্ত করেন, আপনি চিন্তা করবেন না, আমি দু’-দিনের আগেই টাকা-পয়সা নিয়ে ফিরে আসব। কিন্তু একটা কথা, আজ বেদব্ভ যোগ আছে, আপনি কিন্তু তাড়াতাড়ি ছাড়া পাওয়ার আশায় মন্ত্র প্রয়োগ করবেন না। তাহলেই বিপদ।
পড়ুন ‘নব জাতক’-এর আগের পর্ব: সীতা যখন রামের বোন, দিতে হয়নি অগ্নিপরীক্ষাও
গুরুদেব মাথা নেড়ে সায় দেন। কিন্তু রাত যত বাড়তে থাকে, তাঁর মনে হয়, ডাকাতরা তো অর্থের জন্যই আমাকে আটকে রেখেছে। তিথিযোগ সমাগত, এখন ইচ্ছে করলেই আমি ওদের আশার অতিরিক্ত রত্ন দিয়ে সসম্মানে মুক্তি পেতে পারি। বোধিসত্ত্ব ছেলেমানুষ, ও না বুঝে আমাকে কীসব বলে গেল। তিনি ডাকাতদের উদ্দেশে চিৎকার করলেন, ওহে শুনছ, আমার বাঁধন খুলে দাও। তোমরা যা মুক্তিপণ চাইছ তার অনেক গুণ বেশি তোমাদের দেব।
ডাকাতরা এমন কথা জন্মে শোনেনি। তারা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল।
ব্রাহ্মণ বললেন, আর দেরি করলে কিন্তু রত্নবর্ষণ-যোগ কেটে যাবে।
ডাকাতরা ভাবল এই বৃদ্ধ পালাতে তো পারবে না, দেখাই যাক। বাঁধন থেকে মুক্ত হওয়ার পর ব্রাহ্মণ স্নান করে শুদ্ধ হলেন। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় বেদব্ভ মন্ত্র উচ্চারণ করলেন। আর কী আশ্চর্য, মাথার ওপরের আকাশ থেকে সাতরঙা রত্ন টুপটাপ করে পড়তে লাগল।
পাঁচশো ডাকাত শিশুর উচ্ছ্বাসে সেই রত্ন কুড়িয়ে এনে জড়ো করল তাদের সর্দারের সামনে। এক পুঁটলিতে সেইসব মহার্ঘ রতন বেঁধে রাখল। ব্রাহ্মণকে খাতির যত্ন করল খুব। দেখতে দেখতে ভোরের আলো ফুটল। তারা বলল, ঠাকুর, চলুন বন পার করে আপনাকে চেতিয় রাজ্যে পৌছে দিয়ে আসি।
ব্রাহ্মণ সানন্দে তাদের সঙ্গে পা বাড়ালেন। তাঁর অনুগত শিষ্যের কথা তিনি ভুলে গেলেন; একবারও মনে হল না, কষ্টেসৃষ্টে মুক্তিপণের অর্থ নিয়ে হাজির হয়ে বোধিসত্ত্ব কতটা বিপদে পড়তে পারেন।
কিন্তু সে বিপদের কথা থাক, কিছু পথ এগোতে না এগোতে ব্রাহ্মণ নিজেই পড়লেন এক অভাবিত বিপদে। গভীরতর বনে হারে-রেরে-রেরে শব্দে দৌড়ে এসে পাঁচশো জন প্রেষণক আর ব্রাহ্মণকে ঘিরে ধরল অন্য এক দলের পাঁচশো ডাকাত। তারা হুংকার দিল, যা আছে সব দিয়ে দাও।
প্রেষণকরা বলল, আমাদের যা আছে তা তোমরাও পেতে পারো অনায়াসেই। এই বামুন ঠাকুর ইচ্ছে করলেই মন্তর আওড়ে তোমাদের মণি মানিক্যে ভরিয়ে দিতে পারে, আমাদের যেমন দিয়েছে।
নতুন ডাকাতের দল ঘিরে ধরল ব্রাহ্মণকে। তিনি বললেন, বাপু, বেদব্ভ যোগ তো কেটে গেছে, এখন হবে না। তোমাদের আরও এক বছর অপেক্ষা করতে হবে।
কিন্তু দুষ্কৃতির কি আর অপেক্ষা সয়? তারা হুংকার দিল, এক্ষুনি চাই।
ব্রাহ্মণ বললেন, আমি নিরুপায়।
দ্বিরুক্তি না করে দ্বিতীয় দলের সর্দার তরোয়ালের এক কোপে ব্রাহ্মণের মাথা নামিয়ে দিল, তার বাকি সাগরেদরা ঝাঁপিয়ে পড়ল অপ্রস্তুত প্রেষণকদের ওপর। হিংস্র তাণ্ডবে পাঁচশো প্রেষণককে হত্যা করে রত্নের পুঁটলি হাতে লাফিয়ে উঠল দ্বিতীয় দলের সর্দার।
কিন্তু মাটিতে পা দেওয়ার আগেই তার শরীর দ্বিখন্ডিত হল তরোয়ালের তীক্ষ্ণ ফলায়। তারই দলের একজন আক্রমণ করেছে তাকে। সর্দারের শিথিল মুঠো থেকে সে রত্নের পুঁটলি হস্তগত করার মুহূর্তে সর্দার-যশোপ্রার্থীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বাকি ৪৯৮জন ডাকাত। নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে মাটিতে একে একে শুয়ে পড়ল তাদের ক্ষত-বিক্ষত শরীর।
শুধু দু’জন রক্তাক্ত শরীরে আঁকড়ে ধরে রইল সেই রত্নের পুঁটলি। অনেকক্ষণ পর একজন অস্ফুট স্বরে বলল, বড় খিদে পেয়েছে।
দ্বিতীয় জন বলল, আমারও।
কিন্তু রত্ন খেয়ে তো পেট ভরে না। একজন বললে, তুমি কিছু খাবার সংগ্রহ করে আনো। আমি পেটিকা পাহারা দিই।
অন্যজন বলল, বেশ আনছি। কিন্তু পালানোর চেষ্টা করলে আর জ্যান্ত থাকবে না।
প্রথম জন মুচকি হেসে বললে, জানি।
দ্বিতীয় জন কিছু ফল-পাকুড় নিয়ে এলো। তৈরি ছিল প্রথম জন। আচম্বিতে তীক্ষ্ণ তরোয়ালে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল তার জন্য খাবার সংগ্রহ করে আনা সঙ্গীর হৃৎপিণ্ড। তারপর হাত ধুয়ে খেতে বসল।
প্রথম ফল শেষ করে দ্বিতীয় ফলে কামড় দিয়েই সন্দেহ হয়েছিল তার। তৃতীয় ফল শেষ করার আগেই মৃত্যু কোল পেতে দিল তাকে। রত্নের ভাগ বাঁটোয়ারা থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য ফলে তীব্র ভেষজ বিষ মাখিয়ে এনেছিল তার সদ্যমৃত বন্ধু।
বোধিসত্ত্ব মুক্তিপণ নিয়ে ফিরে এসে বুঝতে পারলেন সব। তাঁর গুরুদেবের দেহ খুঁজে বের করে চিতায় অগ্নি সংযোগ করলেন। চারপাশে পড়ে রইল এক হাজার দস্যুর লাশ। আর পড়ে রইল সেই রত্ন পেটিকা। তার দিকে লোভাতুর হাত বাড়ানোর মতো আর কেউ আপাতত বেঁচে নেই।
ঋণ: বেদব্ভ জাতক