আজ্ঞে ক্রিকেট খেলাটা রক্ত-ঘাম ছেঁচে ছেঁচে তৈরি। সেখানে যুদ্ধ করতে হয়। ক্রিজে টিকে থাকতে হয়। নাছোড়বান্দা হতে হয়। অস্ট্রেলিয়া সেটাই করেছে। দিনশেষে ঘরে তুলেছে বিশ্বকাপ। এই নিয়ে ছ’বার! এক, দুই, তিন করে ছ’বার! এরপর তারা বিশ্বকাপে চুমু খাবে। আদর করবে। মদ ঢালবে। পা তুলে দিয়ে প্রশান্তির হাসি হাসবে। আমাদের বড়জোর দৃষ্টিকটু লাগতে পারে। কিন্তু বিশ্বকাপ তো আমাদের নয় মশাই। আমাদের ব্যক্তিগত মালিকানায় ঠ্যাং তোলেনি। আর বিশ্বকাপ ব্যাপারখানা আসবাবপত্রর মতোই হয়ে গিয়েছে অস্ট্রেলিয়ানদের।
অঙ্গ নিয়ে ভারতীয়দের অংবংচং ঢের বেশি। একচোখ দেখাবে না, জন্মবারে চুল কাটা যাবে না, বাঁহাতে টাকা দেবে না– হরেক গাজোয়ারি কুসংস্কৃতির ছর্রা! কথা হল সংস্কৃতি হোক বা অপসংস্কৃতি, তা দেশ-কাল-সময় অনুযায়ী বদলে বদলে যায়। আমরা এক ক্লিকে বিশ্বভুবন দেখতে পাচ্ছি বইকি, কিন্তু আমাদের ওপর নেই ভুবনের ভার, একথা বুঝতে পারলেই ভালো। আমরা নিজেদের সংস্কারের আতশকাচ দিয়ে মোটেই অন্য দেশের, অন্য সংস্কৃতির বিচার করতে পারি না। এসব কথা বলছি, একটাই কারণে, ক্রিকেট বিশ্বকাপ জেতার পর মিচেল মার্শ নাকি বেজায় কুকম্ম করেছেন। কী সেটা, এই যে, সকলের সাধের বিশ্বকাপে ঠ্যাং তুলে তিনি বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। সে ছবি, ভাইরাল হল, তীব্র নিন্দা-টিন্দাও– কোনও কোনও বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই এ-ও বলেছেন যে, কাপ-টাপ কেড়ে নেওয়া হোক। এ পাড়ার ডাকাবুকো কোনও মাস্তানের বয়ান হতে পারে, কিন্তু যুক্তিনিষ্ঠতা এর মধ্যে বিন্দুমাত্র পেলাম না।
মিচেল মার্শ যদি বিশ্বকাপের ওপর পা তুলে দেন সটান– তৎক্ষণাৎ, একেবারে গাঁতিয়ে-গুঁতিয়ে আমাদের সেঁধিয়ে যেতে হয় ভারতীয় সংস্কৃতির ছাতার তলায়। বিশ্বকাপের গায়ে কেউ পা ঠেকায়? ঘোর অমঙ্গল! অমন পবিত্র একটা বস্তুতে! ফাইনালে হেরে যাওয়ার পরেও এটুকুই তো আছে আমাদের। কোনও এক উপায়ে অস্ট্রেলিয়াকে দাবড়ে দিতে পারলে আমাদের নৈতিক জয় হয় বটে! দাও তবে গালাগাল, বিলিয়ে দাও সহবত শিক্ষা। সেই উদ্দেশ্যেই অস্ট্রেলিয়ান প্লেয়ারদের খিস্তিখামারি। এমনকী, রেপথ্রেট। এও আমাদের সংস্কৃতি কিনা!
আরও পড়ুন: সেই উপেক্ষার পৃথিবী পাওনা রইল দ্রাবিড়ের
ক্রিকেট বিশ্বকাপ যখন শুরু হল, অস্ট্রেলিয়া দল মোটামুটি ছন্নছাড়া। কিছুটা অসংগঠিত। ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে পরপর দু’টি ম্যাচে হেরে যাওয়ামাত্র রব উঠেই গিয়েছিল, গেল গেল! এইবার অস্ট্রেলিয়া বড় দুর্বল! একেবারেই প্রস্তুতি নিয়ে আসেনি। কোথায় সেই অপ্রতিরোধ্য দল– এই বলে নস্টালজিয়ার লাভা গলগল করে বেরতে থাকে। অথচ দেড়মাস পরে দৃশ্য সম্পূর্ণ বদলে গেল। অস্ট্রেলিয়া চ্যাম্পিয়ান!
আজ্ঞে ক্রিকেট খেলাটা রক্ত-ঘাম ছেঁচে ছেঁচে তৈরি। সেখানে যুদ্ধ করতে হয়। ক্রিজে টিকে থাকতে হয়। নাছোড়বান্দা হতে হয়। অস্ট্রেলিয়া সেটাই করেছে। দিনশেষে ঘরে তুলেছে বিশ্বকাপ। এই নিয়ে ছ’বার! এক, দুই, তিন করে ছ’বার! এরপর তারা বিশ্বকাপে চুমু খাবে। আদর করবে। মদ ঢালবে। পা তুলে দিয়ে প্রশান্তির হাসি হাসবে। আমাদের বড়জোর দৃষ্টিকটু লাগতে পারে। কিন্তু বিশ্বকাপ তো আমাদের নয় মশাই। আমাদের ব্যক্তিগত মালিকানায় ঠ্যাং তোলেনি। আর বিশ্বকাপ ব্যাপারখানা আসবাবপত্রর মতোই হয়ে গিয়েছে অস্ট্রেলিয়ানদের। তা ধুয়ে-মুছে রাখে। পাড়া কিংবা ইশকুলের যে ম্যাচ-ট্যাচের ট্রফি, সার্টিফিকেট সেসব কি সকলে খুব যত্ন করে মাঞ্জা মেরে সাজিয়ে রেখেছেন? কেউ কেউ রেখেছেন হয়তো, কিন্তু আপনি রেখেছেন বলেই মিচেল মার্শ রাখবেন– কেন? আপনি কি মিচেলের প্রাইভেট টিউটর?
মনে করে দেখুন, নীল আর্মস্ট্রংকে। কী পাপই না করেছিলেন তিনি! চাঁদে পা দিয়েছিলেন। চন্দ্র তো পুরাণের দেবতা, সেখানে পা দিলেন। কী চিত্তির! ওঁর তো হাতের ওপর ভর দিয়ে হাঁটাচলা করা উচিত ছিল? এসব দিক দিয়ে দেখতে গেলে একমাত্র পুণ্য রাজনৈতিক দল কিন্তু কংগ্রেস!
আসলে দেবতার পা এবং মানুষের পা– দুইয়ের মধ্যে ভক্তির হেবি চাতুরি আছে। পা এবং ভারতীয় সংস্কৃতি– দুইয়ের মধ্যে আবার সন্তর্পণ দূরত্ব। হাত আর পা যে একই মানবশরীরের অঙ্গ, মেনে নেওয়ার বেলায় যত বদহজম! জেলুসিল খাই, আর ভুলে যাই কৃষকের খালি পা, শ্রমিকের শ্রান্ত, ক্লান্ত পা। অতিমারি-কালে মাইলের পর মাইল হেঁটে যাওয়া শ্রমিকের খালি পায়ে সভ্যতার ক্ষত ছিল বেজায়। সে পা দেখে আমাদের মাথা নিচু হয়ে যায়নি কেন লজ্জায়? কেন সেই পা এই প্রচার পেল না, যে প্রচার পেল মিচেল মার্শ?
আরও পড়ুন: বদলা নয়, যুদ্ধ থামানোর পক্ষে কথা বলল বিশ্বকাপ ফাইনাল
এই সমস্ত পায়ের স্মৃতি থেকে উবে গেছে আমাদের। বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। স্থায়ী হলেন মিচেল মার্শ। খেলার দুনিয়ার আরও কতশত সুপারস্টারের ছবি সোশাল মিডিয়ার টাইমলাইন ফুঁড়ে উঠে এল। জলাতান ইব্রাহিমোভিচ সিরি-আ ট্রফির মধ্যেই পা ঢুকিয়ে দিয়েছেন। হাতে চুরুট। গায়ে এসি মিলানের জার্সি। লিভারপুল যেদিন চ্যাম্পিয়ান্স লিগ জিতে ফিরল ইংল্যান্ডে, দলের ক্যাপ্টেন জর্ডান হেন্ডারসনও পা রেখেছিলেন ট্রফির গায়ে। হুবহু মিচেল মার্শের মতো।
আমরা পায়ের ওপর যতখানি মর্যাদা অর্পণ করেছি, একইসঙ্গে করে রেখেছি অচ্ছুৎ, ছোটলোকের, যেন শরীর-বহির্ভূত, পশ্চিমি দুনিয়া পা নিয়ে ততখানি কুল। জঁ-লুক গোদার থেকে কোয়েন্টিন ট্যারান্টিনো– প্রত্যেকের ছবিতেই কিন্তু মানুষের পা দু’খানি আকর্ষণের কেন্দ্রে।
হয়েছে কী, যে খেলায় যে অঙ্গের নিষেধাজ্ঞা, সেটি ব্যবহার করলেই বিপদ। স্পটলাইট চতুর্দিকে। রাতারাতি ভাইরাল। যেমন মারাদোনার হাত দিয়ে গোল। বিশ্বকাপের ওপর মিচেল মার্শের পা। মাথার ওপরে একটা অদৃশ্য পা, ক্রমাগত পিষে চলেছে আমাদের। ভারত, ইউক্রেন, প্যালেস্তাইন– সর্বত্র, তার বেলা? অপবিত্র, অশুচি, ইত্যাদি আরও অ-কারান্ত শব্দগুলো তখন কীসে আটকায়?
অভিনেতা হিসেবে অভিনয়ের যে জায়গাগুলো তিনি আবিষ্কার করেছিলেন, যা আমি আগেও বলেছি, সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা, ভালো থাকার আকাঙ্ক্ষা, জয়ী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা, সাধারণ মানুষ যা প্রকাশ করতে পারে না চট করে। মনোজ মিত্র তাঁর সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে তাকে বড় করে দেখিয়েছেন।