বহু জন্মদিন কেটেছে তাঁর মাঠেই, এ বছর পরিবারের সঙ্গে একান্তে জন্মদিন কাটাচ্ছেন ঝুলন গোস্বামী। দুপুর-বিকেলে রোববার.ইন-এর ফোন, ‘কথা বলতে পারবেন?’ কী আশ্চর্য, উত্তর এল ‘হ্যাঁ’। তিনি ঝুলন গোস্বামী, ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক, টেস্টে ৪৪, ওয়ান ডে-তে ২৫৫, টি-টোয়েন্টিতে ৫৬ উইকেট নিয়েও কী নিদারুণ আটপৌরে বাঙালি! রোববার.ইন-এর হয়ে কথা বললেন সরোজ দরবার
এখন জন্মদিন মানে তো নানা ঘটনার সমাহার। অনেক অনুষ্ঠান, শুভেচ্ছা, উত্তর দেওয়া ইত্যাদি। এত কিছুর মধ্যে আপনি নিজে জন্মদিনে কী করতে ভালোবাসেন?
ঝুলন এত বছর জন্মদিন তো বাইরে বাইরেই কেটে গিয়েছে। ঘরে বিশেষ থাকা হয়নি। জন্মদিন মোটের ওপর মাঠেই কাটিয়েছি। এখন তাই সময়-সুযোগ হলে এই দিনটায় বাড়িতেই থাকতে ভালোবাসি। পরিবারের সকলের সঙ্গে, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে জন্মদিন কাটাতেই এখন বেশি ভালো লাগে।
আচ্ছা, ছোটবেলার জন্মদিন তো খুব স্পেশাল হয় সকলেরই। সেরকম কোনও স্মৃতি কি এখনও ফিরে ফিরে আসে?
ঝুলন একটা ব্যাপার তো ছিল যে, জন্মদিনে যা-ই করি না কেন বকাঝকা খাব না। সে পড়তে না বসি কি অন্য কিছু! আর আমাদের সময়ে এত কেক কাটার রীতি রেওয়াজ ছিল না। কেকের দোকানের তখন দেখাও মিলত না তেমন। মায়ের হাতের পায়েসটাই ছিল অমৃত। মা কখন পায়েস বানাবে, সেই আশায় বসে থাকতাম। তারপর বাঙালি-ঘরে যা হয়, লুচি আর মাংস-ভাত। বিকেলে বন্ধুবান্ধবরা আসত। গিফট-ও পেতাম। হাতে করে সাজানো গিফটের বক্স আনত বন্ধুরা। কে কী গিফট দিয়েছে দেখার আগ্রহ ছিল খুব। ছোটবেলার জন্মদিনের কোনও নির্দিষ্ট ঘটনা নেই। তবে এই স্মৃতির টুকরোগুলোই আজও মনের অ্যালবামে কোলাজ হয়ে আটকে আছে।
আপনার হোয়াটস্অ্যাপ বায়োতে যা লেখা, বাংলা করলে অর্থ হয়– নিঃশব্দে কাজ করে যাও, সাফল্য তোমার হয়ে কথা বলবে। আমরা জানি, আপনি নিজের জীবনে তা প্রমাণ করেছেন। এখনকার এই তীব্র ইঁদুরদৌড়ের যুগে, যেখানে প্রতিনিয়ত সফল হয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়, সেখানে নীরবে কাজ করে যাওয়ার শক্তি কোথা থেকে পাওয়া যাবে?
ঝুলন আমি একটা কথা বিশ্বাস করি, প্রত্যেক মানুষই কোনও না কোনওভাবে গুণী। অর্থাৎ তাঁর নিজের একটা কোনও বিশেষত্ব আছে। কেউ হয়তো ভালো লিখতে পারেন, কেউ ভালো কথা বলেন, কেউ বা খেলেন। যে যাই করুন না কেন, নিজের সেই কাজ এবং বিশেষত্বটার ওপরই মন দিতে হবে। এইটা যদি করা যায়, তাহলে আর অন্য দিকে তাকানোর দরকার হয় না। আগে নিজের ভিতরকার ওই গুণটিকে খুঁজে বের করতে হবে যে, আমি কোন কাজটা ভালো পারি। তারপর সেই স্কিলকে আরও ঘষামাজা করে ধারালো করে তুলতে হবে। এতটাই তীক্ষ্ণ হয়ে উঠতে হবে সেই কাজে, যে, নিজের কাজটাই তখন হয়ে উঠবে নিজের পরিচয়। ‘আত্মপরিচয়’ বলতে আমরা যা বুঝি, সেটা হবে আমার কাজই। তখন আর নিজেকে হাইলাইট করার জন্য, বা কোনও কিছুকে তুলে ধরার জন্যই আলাদা করে কোনও কসরত করতে হয় না। নিজের কাজই যা বলার বলে দেয়। অনেকেই হয়তো এই কথাটা বুঝতে দেরি করে ফেলেন। তাতে বিভ্রান্তি বাড়ে। তবে, যত তাড়াতাড়ি নিজেকে চিনে নিয়ে যাওয়া ততই ভালো। কাজই তখন আমাদের পরিচয়পত্র হয়ে ওঠে। যা যা বলার কথা, কাজই বলে দেয়।
তবু ব্যর্থতাও তো আসে, যন্ত্রণাও বয়ে আনে…
ঝুলন আসবে না কেন! তবে, যেটা মনে রাখার, তা হল সাফল্যই আমাদের একমাত্র কিংবা চূড়ান্ত গন্তব্য নয়। এর মানে আমি কখনওই বলছি না যে, সাফল্যের দরকার নেই। নিশ্চিতই আছে। কিন্তু এই যে পথের অর্জনটুকু অর্থাৎ প্রসেসটুকু তো ভুলে গেলে চলবে না। সেই-ই তো সবথেকে বড় সম্পদটা দিয়ে যায়– অভিজ্ঞতা। জীবনের সাফল্য-ব্যর্থতা যাই আসুক না কেন, যে অভিজ্ঞতা অর্জন হচ্ছে তার তুলনা হয় না। এই অভিজ্ঞতা মানুষকে এগিয়ে দেয়। সাফল্যকে পাখির চোখ করতেই হয়। কিন্তু সেটাই একমাত্র পাকাপাকি কোনও কিছু নয়। বরং সাফল্য কেন এল না, এই বিশ্লেষণে ফেলে নিজেকে যখন দেখা হয় তখন নিজেকেই আরও চেনা যায়। জীবনের আগামী পরিস্থিতিগুলোর সঙ্গে লড়াই করা তখন সহজ হয়ে যায়। আর এই অভিজ্ঞতা অনেকের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায়। তাতে ভবিষ্যতে যাঁরা সংকটের মুখোমুখি হবেন, তাঁরা মোকাবিলার একটা রূপরেখা পেয়ে যান। নিজেকে প্রস্তুত রাখতে পারেন। এর মূল্যও তো কম নয়!
এবারের বিশ্বকাপ ফাইনালে ভারত হেরে গেল। শক্তিশালী টিম নিয়েও পরাজয় স্বীকার করতে হল রোহিত শর্মাকে। বহু সমালোচনার শিকারও হতে হচ্ছে। এই হারকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
ঝুলন এত বড় একটা দেশ। কোটি কোটি মানুষ একত্র হয়েছেন একটা ইভেন্টকে কেন্দ্র করে। অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে হয়তো অন্যান্য খেলার ভূমিকা আছে, আমাদের দেশে ক্রিকেট গোটা জাতিকে এক সুতোয় বেঁধে রাখে। সেখানে প্রত্যাশার কাঁটা নির্দিষ্ট জায়গায় না পৌঁছলে, চাওয়া-পাওয়ার সমীকরণ না মিললে প্রতিক্রিয়া আসবেই। সেটা বাস্তব, অস্বীকার করা যায় না। তবে, এটাও তো ভেবে দেখার যে, কোনও প্লেয়ারই হারার জন্য মাঠে নামেন না। বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া মানে, চার বছরের প্রস্তুতি। একটা লক্ষ্যে চোখ রেখে নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দেওয়া। সবকিছু ছেড়ে চূড়ান্ত মঞ্চে নিজের দেশকে সেরা করে তোলাই সেখানে পাখির চোখ। প্লেয়ারদের সেই ত্যাগ, উৎসর্গ, পরিশ্রম, চ্যালঞ্জের কথাও মাথায় রাখা হোক। জানি, অনেকেই নানা কথা বলছেন। কিন্তু একবার খেয়াল করে দেখুন, খেলোয়াড়দের হৃদয়ে কতখানি বেদনা বেজেছে, তাঁদের অন্তরের রক্তক্ষরণও অনুভবও করুন। যখন তাঁরা ভালো খেলছিলেন, তখন তো পাশে দাঁড়িয়ে প্রশংসাই করেছিলেন সকলে। একটা খারাপ দিন, একটা পরাজয়ে সেই সব কিছু তো মুছে যেতে পারে না। সব ভালো ভালো কথা এক লহমায় মন্দ হয়ে যেতে পারে না। একটা পরিবারে কেউ যদি খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যায়, আমরা কি তাঁকে আরও খারাপের মধ্যে ঠেলে দিই, না তাঁর পাশে দাঁড়াই! আমাদের এই দিকটাও একটু ভেবে দেখা উচিত।
ইদানীং খেলা আর রাজনীতি খুব মিশে যাচ্ছে বলে অনেকেই অভিযোগ করছেন। সোশাল মিডিয়ায় এ নিয়ে বহু কথাবার্তাও হচ্ছে। আপনার কি মনে হয়, সত্যি এরকমটা হচ্ছে?
ঝুলন আমি আবারও বলছি, আমাদের দেশ ক্রিকেট নিয়ে একসূত্রে সকলে বাঁধা পড়েন। সেখানে সবাই খেলা দেখে আসতে পারেন। আসার অধিকার আছে। সকলেই চাইবেন, একেবারে সামনে থেকে এই ঘটনার সাক্ষী থাকতে। জয় বা পরাজয় আলাদা কথা। কিন্তু এই বিষয়টার রাজনৈতিকীকরণ করা উচিত নয়। টিমের একটা খারাপ দিন গেছে। অফিসে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদেরও তো সব দিন ভালো যায় না। এটাও সেরকম। রাজনীতি না খুঁজে আমরা বরং ভাবি, এর পরে আমরা কীভাবে এগোব। কীভাবে টিম ঘুরে দাঁড়াবে। আমার মনে হয়, এভাবেই সকলের রিঅ্যাক্ট করা উচিত।
মহিলা ক্রিকেট নিয়ে দেশ এখন অনেকটাই আগ্রহী হয়ে উঠেছে। দর্শক বেড়েছে। বেতনসাম্যও এসেছে। আপনারা এই লড়াইটা লড়েছিলেন। এখন এই বিন্দুতে দাঁড়িয়ে আগামীর পথকে কি আরও উজ্জ্বল দেখছেন?
ঝুলন এটা হওয়ারই ছিল। দেরি হয়েছে, সে কথা ঠিক। তবে বেশিদিন এই আগ্রহকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়নি। সোশাল মিডিয়া এই ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা নিয়েছে বলে আমি মনে করি। ২০১৫-’১৬ সাল থেকে এই মাধ্যম যত বেড়েছে, মহিলা ক্রিকেট সাধারণ মানুষের কাছে অনেক বেশি পৌঁছেছে। প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় সেভাবে প্রচারটা আগে হয়নি, গুরুত্বও কম ছিল। সোশাল মিডিয়া এসে সেই জায়গাটা পূরণ করে দিয়েছে। দর্শক মহিলা ক্রিকেটের খুঁটিনাটি জানছে, কমিউনিকেশন অনেক বেড়েছে, ফলে আগ্রহও বেড়েছে। নির্দিষ্ট একটা ফ্যানবেস তৈরি হয়েছে। সোশাল মিডিয়ার খারাপ দিক হয়তো অনেক আছে, কিন্তু এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, যেটা অস্বীকার করা যায় না। আইসিসি এবং বিসিসিআই-ও মহিলা ক্রিকেটকে ছড়িয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। IPL-এর মতো WPL শুরু হয়েছে, তাতে গ্রাম-গঞ্জে ছড়িয়ে গিয়েছে মেয়েদের ক্রিকেটের কথা। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি নিশ্চিতই আশাবাদী। আগামীর পথটা যে আরও উজ্জ্বল হবে, তা নিয়ে দ্বিমত নেই।
শচীন তেন্ডুলকরের আত্মজীবনী পড়তে পড়তে আপনি নিজের জীবনের একটি ঘটনা রিলেট করেছিলেন, একটি লেখায় জানিয়েছিলে সে-কথা। আপনি কি বই পড়তে ভালোবাসেন?
ঝুলন খুব ভালোবাসি বলব না, তবে বই পড়তাম। বিশেষত অটোবায়োগ্রাফি পড়তে আমার খুব ভাল লাগত। আগে তো ফ্লাইটে বই পড়ার অভ্যাসই ছিল। ইদানীং সেই জায়গাটা নিয়েছে ওয়েব-সিরিজ। তবে, বই এখনও পড়ি।
‘চাকদা এক্সপ্রেস’-এর মুক্তি কবে?
ঝুলন খুব শিগগিরই। দিনক্ষণ আনুষ্ঠানিক ভাবে জানিয়ে দেওয়া হবে। যেহেতু এটা একটা আলাদা প্রসেস, তাই বিশেষ করে কিছু বলছি না। তবে, যাঁরা দেখতে চাইছেন, তাঁদের বলি, বেশি অপেক্ষা করতে হবে না আর।
নিজের জীবন নিজে কি পর্দায় ফিরে দেখবেন?
ঝুলন নিশ্চয়ই দেখব। আমি যদি আমাকেই না দেখি, অন্যে দেখবে কেন!