ফ্রিডম থিয়েটার আজও লড়ে যাচ্ছে রিফিউজি ক্যাম্পে। শারীরিক ও অর্থনৈতিক আক্রমণের সামনে ক্যাম্পের শিশুরা শিখছে শোষণের সমাজে শিল্পের মানে কী। প্রতিষ্ঠাতাদের একজন বেঁচে আছেন– জাকারিয়া জুবেইদি, এই মুহূর্তে তিনি ইজরায়েলের জেলে। কী করছেন এই আক্রান্ত সময়ে? হয়তো পরবর্তী প্রযোজনার প্রপ নিয়ে ভাবছেন– গোলাপ থাকবে না এ-কে-ফর্টি সেভেন কিংবা শুধু চামচ– নিশ্চিত নই, তবে এটা নিশ্চিত যে, সেটা হবে ভায়োলেন্টলি পলিটিকাল।
৩. হিপ-হপ
১৯৯৭ সালে তামের নাফার-এর নেতৃত্বে ফিলিস্তিনে প্রথম হিপ-হপ গ্রুপ আত্মপ্রকাশ করে– DAM. হিপ-হপ/র্যাপের উৎপত্তিই হয়েছে আমেরিকায় কালো মানুষদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের শিল্প হিসাবে। স্বাভাবিকভাবেই ফিলিস্তিনি যুবসম্প্রদায় এই শিল্পধারাকে হাতিয়ার করে নেয়। ২০০১ পরবর্তী সাম্রাজ্যবাদীদের ‘ওয়ার অন টেরোরিজম’-এর প্রপাগান্ডার মোকাবিলায় আরবি ভাষার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি, ফরাসি ইত্যাদি ভাষাতেও গান রচনা শুরু হয়। লক্ষ্য আন্তর্জাতিক দর্শককে এক বিপরীত বাস্তবতায় সচেতন করে তোলা।
গানের বক্তব্যে অধিকৃত দৈনন্দিন ক্যাম্প-জীবনের গল্প, নির্যাতনের বাস্তবতা, অপমান, ব্যঙ্গ এবং প্রতিবাদ মুখরিত হয়। শুধু তাই নয়, এর সঙ্গে গানে উঠে আসে প্রতিক্রিয়াশীল, মৌলবাদী, দক্ষিণপন্থার বিরোধিতা– বাইরের শত্রুপক্ষের এবং নিজেদের ঘরেরও। নয়ের দশকের শুরুতে ফিলিস্তিনে (PFLP, PCP সমর্থিত PLO) এবং ইজরায়েলে বামপন্থী দল (লেবার পার্টি) ক্ষমতায় থাকায় শান্তিপ্রস্তাব– ‘অসলো চুক্তি’ তৈরি হয়। কিন্তু যুদ্ধ-ব্যবসায়ী সাম্রাজ্যের জন্য এটা অলাভজনক, তারা দু’-পক্ষেই কট্টর মৌলবাদী, দক্ষিণপন্থার উত্থানে মদত জোগাতে থাকে– ইজরায়েলে ‘লিকুড পার্টি’ এবং ফিলিস্তিনের ‘হামাস’ (আফগানিস্তানের বাম সরকারকে হারানোর জন্য যেমন তালিবান-মুজাহিদিন উত্থানে মদত দেওয়া হয়)। এই দুইয়ের পার্টির ক্ষমতায়ন সাম্রাজ্যকে লাভবান করে, লেবার পার্টির নেতা খুন হন, ‘লিকুড’ ক্ষমতায় আসে ও শান্তিচুক্তি ভেস্তে যায়। মৌলবাদী হামাসের নারীর ক্ষমতায়নের বিরোধিতা, মুক্ত প্রগতিশীল শিক্ষার বিরোধিতা, শিল্প-সংগীত বিরোধিতাকেও ফিলিস্তিনি র্যাপ সংগীতে আক্রমণ করা হয়।
পড়ুন মৃত্যু উপত্যকায় শিল্পীরা-র প্রথম পর্ব: যে দেশ স্বপ্নে আকাঙ্ক্ষায় বেঁচে থাকে
DAM-এর সঙ্গে সঙ্গে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের রিফিউজি ক্যাম্পে ‘SAZ’, ‘Happiness Kids’, ‘Arapeyat’ (মানে যে আরব মহিলা র্যাপ করে); গাজা স্ট্রিপে ‘Ortega’, ‘PR’, ‘MC Gaza’ এবং হালে ১২ বছরের কিশোর ‘MC Abdul’ জনপ্রিয় হয়। এছাড়াও ‘দেইশেহ রিফিউজি ক্যাম্প’-এর তিন কিশোরীর বানানো প্রথম সম্পূর্ণ মহিলা-র্যাপ গ্রুপ ‘Ettijah’ তাদের তীক্ষ্ণ গানের মাধ্যমে নাড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বকে।
বহু চেকপোস্ট আর আইডি নিরীক্ষণ পেরিয়ে তারা মাঝেমধ্যেই ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের উদ্বাস্তু ক্যাম্পগুলিতে জড়ো হয় হিপ-হপ সংগীত মেলায়। নিজেদের মধ্যে কোলাবরেট করে, আরও তরুণ-তরুণীকে উৎসাহ দেয়। শুধু গাজার শিল্পীদের বাদে। কারণ গাজা ২ লাখ অধিবাসী নিয়ে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প’– সেখান থেকে বেরনো নিষিদ্ধ। ১২ বছরের কিশোর আবদুল রাহমান আল-শান্তি ওরফে ‘MC Abdul’ ২০১৮ সালে সদ্য বোমায় ধুলোয় মিশে যাওয়া শহরকে ব্যাকড্রপে রেখেই অকুস্থলে গান ‘Shouting at The Wall’.
‘‘I want freedom
For the population
2 millions Prisoner
Living in this location
Shouting at the wall
But nothing is ever Changing
That’s Life
Under an Occupation…’’
পড়ুন মৃত্যু উপত্যকায় শিল্পীরা-র দ্বিতীয় পর্ব: দেশ নেই, পরিচয় নেই: প্রতিরোধ শিল্পের প্রথম যুগ (১৯৫০-১৯৮৭)
গানের আট লাইনের শক্তিশালী অন্তরা নিয়ে আড়াই মিনিটের গান মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায়। দু’বছর আগে নাফার তাঁর সঙ্গে কোলাবরেট করার পরিকল্পনা করেন, কিন্তু আবদুল গাজাবাসী, ফলে গাজা ছেড়ে বেরনো তাঁর জন্যে নিষিদ্ধ, তাই তাঁর গান ভিডিও করে পাঠান তামের নাফারকে। ২০২১-এ সেই ভিডিও চালিয়েই নাফার, আবদুলের সঙ্গে যুগলবন্দি গান ‘The Beat Never Goes Off’.
৪. থিয়েটার
নাট্যশিল্পী জো লাফার্টি ২০১০ সালে ফিলিস্তিনের জেনিন রিফিউজি ক্যাম্পে পৌঁছন ইজরায়েলি-ইহুদি তথ্যচিত্র-পরিচালক, অভিনেতা ও নাট্য-পরিচালক জুলিয়ানো মের-খামিস-এর সঙ্গে দেখা করতে। চার বছর ধরে এই রিফিউজি ক্যাম্পে তিনি নাকি নাট্য অ্যাকাদেমি তৈরি করে চালাচ্ছেন– ‘ফ্রিডম থিয়েটার’। সেখানেই সহ-ডিরেক্টরের পদে দায়িত্ব পেয়েছেন লাফার্টি। ইতিমধ্যেই ক্যাম্পের কিশোর-কিশোরী ও যুবদের নিয়ে পাঁচটি প্রযোজনা হয়ে গেছে। ফ্রিডম থিয়েটারে নাটকের সঙ্গে সঙ্গে চলে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত শিশু-কিশোরদের নিয়ে ‘কেয়ার অ্যান্ড লার্নিং প্রোজেক্ট’, পারফরম্যান্স ওয়ার্কশপ, ফোটোগ্রাফি ওয়ার্কশপ/প্রোজেক্ট ইত্যাদি। “মিট ইজরায়েল’স মোস্ট ওয়ান্টেড ম্যান”– লাফার্টি-কে জুলিয়ানো পরিচয় করিয়ে দেন ফ্রিডম থিয়েটারের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এ-কে-ফর্টি সেভেন চালানো দুর্ধর্ষ ‘টেররিস্ট’ জাকারিয়া জুবেইদির সঙ্গে, এবং বলেন– ‘এ আমার ডান হাত। একে ছাড়া এই নাট্যশালায় কিছুই সম্ভব নয়।’ ‘জঙ্গি’ চালায় নাট্যশালা!
প্রথম ইন্তিফাদায় (১৯৮৭-’৯৩) জুলিয়ানোর মা ইজরায়েল কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ও স্যোশাল অ্যাক্টিভিস্ট আরনা মের-খামিস জেনিন রিফিউজি ক্যাম্পে আসেন ইজরায়েল থেকে। নিরন্তর ভায়োলেন্স, হত্যা, কারফিউ, মিলিটারি শাসনের মধ্যে বাস করা অজস্র শিশু-কিশোরদের মধ্যে দেখতে পান মানসিক বিকলন এবং PTSD-এর (Post-traumatic stress disorder) উপসর্গ। এই শিশু-কিশোরদের জন্য তিনি শিল্প ও শিক্ষাকে একত্র করে এক বিশেষ শিক্ষাপদ্ধতি শুরু করেন– ‘কেয়ার অ্যান্ড লার্নিং’। তিনি শিশু-কিশোরদের জন্য একটি থিয়েটার খুলতে চান ক্যাম্পেই। জেনিন ক্যাম্পেই বন্ধুত্ব হয় সামিরা জুবেইদি-র সঙ্গে। তাঁর বাড়ির উপরের ঘরে শুরু হয় এই কমিউনিটি থিয়েটার– ‘স্টোন থিয়েটার’। সামিরা জাকারিয়া জুবেইদির মা, ফলে সেও ১২ বছর বয়সেই থিয়েটার ক্লাসের প্রথম ব্যাচে যোগ দেন এবং মূল সদস্যদের অন্যতম হয়ে ওঠেন। অভিনয় করা তাঁর অন্যতম প্রিয় নেশা হয়ে যায় আর এখানেই বন্ধুত্ব হয় আরনা-র ছেলে জুলিয়ানোর সঙ্গে। দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় ২০০২ সালে ইজরায়েল সশস্ত্রবাহিনী হামলা করে জেনিন ক্যাম্পে। ইজরায়েলি স্নাইপারের গুলিতে খুন হন মা সামিরা, ভাই তাহা আর বেশ ক’জন থিয়েটারের বন্ধুরা। সঙ্গে অনেকের বাড়ির মতো ওদের বাড়ি সমেত ‘স্টোন থিয়েটার’-কেও বুলডোজার দিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়। জাকারিয়া সশস্ত্র বিপ্লবী দল আল-আক্কসা যোগ দেন। তাঁর সফল গেরিলা জীবন, বেঁচে থাকার শৈলী তাঁকে ক্রমে দলের নেতা বানিয়ে তোলে। দ্বিতীয় ইন্তিফাদা শেষ হলে গেরিলা যুদ্ধ ছেড়ে দেওয়ার শর্তে ইজরায়েল তাঁকে রাজক্ষমা (Amnesty) করে। শরীরে ন’টা বুলেটের ক্ষত এবং গ্রেনেডে প্রায়-অন্ধ চোখ ও ক্ষত-বিক্ষত মুখে তিনি বাল্যবন্ধু জুলিয়ানোকে ডেকে পাঠান ক্যাম্পে একটা প্রস্তাব নিয়ে– দু’জনের মায়ের অসমাপ্ত কাজ পুনরায় তাঁদের শুরু করতেই হবে। তৈরি হয় ‘ফ্রিডম থিয়েটার’। তাঁর ভাষ্যে, ‘স্বাধীনতার জন্য আমাদের বন্দুক চাই। কিন্তু শিল্প-সংস্কৃতি ছাড়া বন্দুক নিরর্থক। শেষে ভাই ভাইকে খুন করবে।’
ক্লাসিক টেক্সট-কে আইরনি, মেটাফোর আর ডার্ক কমেডির সৃষ্টিশীল মিশ্রণে আঞ্চলিক এবং সমসাময়িক করে তোলে ফ্রিডম থিয়েটারের প্রযোজনাগুলো। তার উপর প্রতিটা নাটক ভায়োলেন্টলি পলিটিকাল। জুলিয়ানোর ভাষায়– ‘ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার লড়াইয়ে আমাদের থিয়েটার প্রতিরোধের বিকল্প বা অল্টারনেটিভ হতে চায় না, বরঞ্চ তার উল্টোটা হতে চায়। এটা পরিষ্কার বুঝতে হবে। …ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার লড়াইয়ে আমরা সর্বতোভাবে অংশগ্রহণ করি কারণ এটা আমাদের স্বাধীনতার লড়াই। আমরা সাধু-সন্ত নই, আমরা শান্তির মলম লাগাতে আসিনি। আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামী।’ ২০১১ সালে নাট্যশালার গেটের সামনে আততায়ীর হাতে খুন হয়ে যান জুলিয়ানো। আর জাকারিয়া-র ‘রাজক্ষমা’ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়, তাঁরও খুনের হুমকি আসতে থাকায় ফিলিস্তিনের জেলে স্বেচ্ছা-নির্বাসন নেন তিনি। তাঁর সহকর্মীরা স্মৃতিচারণে বলেন, জাকারিয়া নাটকের জন্য কীভাবে রাত জেগে আলোচনা করতেন স্টেজ-ডিজাইন নিয়ে, তর্ক করতেন ডায়লগ অথবা দৃশ্য-বিন্যাস নিয়ে, শিল্পের জন্যে প্রতিরোধের সঙ্গে আপোস বা প্রতিরোধের জন্য শিল্পের সঙ্গে আপোস– দুটোই প্রতিহত করতেন তিনি। কারণ একই লক্ষ্যের জন্য দুটোই প্রয়োজনীয়, দুটোই হাতিয়ার। কোনও চিত্তাকর্ষক ঘটনা বা কোনও ক্লাসিক টেক্সট পড়লেই তাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়া হত– এটাকে নাট্যরূপ দেওয়া যায় না? এমনকী, নির্বাসনে থেকেও নিজের নাট্যদলের রেকর্ডেড ভিডিও মন দিয়ে দেখতেন এবং তারপর মন্তব্য পাঠাতেন। ফ্রিডম থিয়েটারের লন্ডন শো দেখে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রশংসা পাঠান এবং তার সঙ্গে জুড়ে দেন স্নেহের কটাক্ষও, ‘বেশ কিছু অভিনেতাকে দেখলাম, যাদের দেখেই বোঝা যাচ্ছে তারা জীবনে কখনও বন্দুকই ধরেনি।’ ২০১৯-এ মাস্টার্স ডিগ্রি করতে নির্বাসন থেকে বেরলে ইজরায়েল স্পাই-এজেন্সি তাঁকে গ্রেপ্তার করে এবং সবচেয়ে সুরক্ষিত জেলখানায় পাচার করে। আড়াই বছর বিনা বিচারে জেলে থেকে অদম্য জাকারিয়া জেলের পাঁচ সঙ্গীকে নিয়ে শুধুমাত্র চামচ দিয়ে দীর্ঘ টানেল খুঁড়ে জেল থেকে পালান ২০২১-এ। এরকম সাহসী পদক্ষেপের সামনে হলিউডি ‘সসাঙ্ক রেডেম্পশন’ নেহাতই সাজানো পপকর্ন। যদিও তার পাঁচদিন বাদে ধরা পড়েন, তাঁদের উপর নামিয়ে আনা হয় পৈশাচিক টর্চার, তবুও এই খবর ফিলিস্তিনের কাছে তাঁকে জাতীয় নায়ক বানিয়ে ফেলে। দেওয়ালে দেওয়ালে তাঁর মুখের গ্রাফিত্তি ফুটে ওঠে, শ্রমিকরা সলিডারিটিতে ধর্মঘট ডাকে, রাস্তায় উৎসব হয় মিষ্টি বিতরণ করে, আর ‘চামচ’ বাজিয়ে উচ্ছ্বাস দেখানো প্রতিরোধের নতুন সিম্বল হয়ে যায়। ভারতের সঙ্গেও ফ্রিডম থিয়েটারের একটা সম্পর্ক রয়েছে– ২০১৬ সালে আরেক ভারতীয় প্রতিরোধের শহিদ শিল্পী সফদর হাসমির বানানো ‘জন-নাট্য-মঞ্চ’-র সঙ্গে কোলাবরেশনে তাদের নাটক নিয়ে আসে। ভারতের ১১টা শহরে ট্যুর করে ফ্রিডম থিয়েটারের ফিলিস্তিনি নওজোয়ানরা।
ফ্রিডম থিয়েটার আজও লড়ে যাচ্ছে রিফিউজি ক্যাম্পে। শারীরিক ও অর্থনৈতিক আক্রমণের সামনে ক্যাম্পের শিশুরা শিখছে শোষণের সমাজে শিল্পের মানে কী। ২০১৮ সালে ফ্রিডম থিয়েটার জানায়, ‘ইউনাইটেড নেশনস’-এর কালচারাল ফান্ড বন্ধ হয়ে গিয়েছে, কারণ ফ্রিডম থিয়েটার ‘অ্যাপলিটিকাল’ হওয়ার দালালির সঙ্গে আপোস করেনি। প্রতিষ্ঠাতাদের একজন বেঁচে আছেন– জাকারিয়া জুবেইদি, এই মুহূর্তে তিনি ইজরায়েলের জেলে। কী করছেন এই আক্রান্ত সময়ে? হয়তো পরবর্তী প্রযোজনার প্রপ নিয়ে ভাবছেন– গোলাপ থাকবে না এ-কে-ফর্টি সেভেন কিংবা শুধু চামচ– নিশ্চিত নই, তবে এটা নিশ্চিত যে, সেটা হবে ভায়োলেন্টলি পলিটিকাল– জনপ্রিয় প্রতিরোধের শিল্প।
পরিশেষ
ভারতের সঙ্গে ফিলিস্তিনেরও বহু পুরনো সম্পর্ক রয়েছে। দু’টি শোষিত কলোনি, দু’টি দেশই একে অপরের স্বাধীনতার পক্ষে। অন্তত দু’-দশক আগে পর্যন্ত তাই ছিল, কিন্তু সেই ভারত আজ আর নেই, ইজরায়েলের অস্ত্র-ব্যবসায় অন্যতম বড় খদ্দের সে। আমার-আপনার টাকায় ফিলিস্তিনের অকুপেশন চলছে, গাজার প্রতিটা শিশুর লাশ আমরাই স্পনসর করছি। জাকারিয়ার ভাষায়, আমাদের হাতে শিল্প-সংস্কৃতি ছাড়া বন্দুক এসেছে। আমরা এখন ভাতৃহন্তক! আমরা যারা এই মুহূর্তে হামাসের ইজরায়েল আক্রমণে জেগে উঠেছি, তারা হয়তো জানি না এ বছরের শুরুতেই (জানুয়ারি-মে) ইজরায়েল সেনা ফিলিস্তিনের জেনিন ক্যাম্পে ভয়ানক আক্রমণ শুরু করে। ইউ.এন-এর হিসাবে, তিন মাসে শুধু খুন হন গত বছরের তুলনায় তিনগুণ। বুলডোজারে ভাঙা ফিলিস্তিনি বসতির রাবিশ ডাই করে ফ্রিডম থিয়েটার তার গেট অবরুদ্ধ করে এই জুলাই মাসে। ২০২২ সালে খুন হন ২০৪ জন ফিলিস্তিনি। ১৪২ জন গাজায়, ৩৭ জন ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে। ২০২১ সালে খুন হন ৩১৩ জন ফিলিস্তিনি। তার মধ্যে নাবালক নাবালিকা ৭১ জন। ২০০৮ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৫,৬০০ জন ফিলিস্তিনি খুন হয়েছেন আর আহত হয়েছেন ১ লাখ ১৫ হাজার মানুষ।
কিন্তু সাম্রাজ্যের শাসকের ও তার দালালদের চোখে এই চলমান অত্যাচার স্বাভাবিক, বরঞ্চ প্রত্যাঘাত-প্রতিরোধই অস্বাভাবিক, তাই তো হামাসের আক্রমণে আমি-আপনি-সবাই ফিলিস্তিন-ইজরায়েল নিয়ে শব্দ-গরম চর্চায় মেতে উঠেছি। হামাসের প্রত্যাঘাত যদি না হত, তাহলে নিশ্চিন্তে গণহত্যা চলতেই থাকত সবার অলক্ষ্যে। আর ঠিক এই কারণেই প্রতিরোধ, প্রতিরোধের শিল্প পরাধীনতার বিরুদ্ধে হাতিয়ার। শিল্পে প্রতিরোধের প্রকাশ ঘটে, স্পেক্টাকেল তৈরি হয়, সবাই তাকায়, কথা বলে, খুঁজতে শুরু করে। কোনওভাবেই আর তা অগ্রাহ্য করা যায় না।
পড়ুন মৃত্যু উপত্যকায় শিল্পীরা-র তৃতীয় পর্ব: যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ: প্রতিরোধ শিল্পের বর্তমান (১৯৮৭-২০২৩)
শ্রেণিবিভক্ত শোষণের দুনিয়ায়, সাম্রাজ্য ও কলোনির দুনিয়ায়, শোষক ও শোষিতের সমাজে শিল্পী কে? তাকে কি এই দু’-পক্ষের মধ্যে একটা পক্ষ নিতেই হবে, সে কি নিরপেক্ষ থাকতে পারে না? অন্তত দু’পক্ষই দোষী বলে নিরাপদ দূরত্বে? রাজনৈতিক দার্শনিক আন্তোনিয় গ্রামসি শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের সমসত্ত্ব মনে করেন না, বরঞ্চ আড়াআড়ি দু’ভাগে ভেঙে দেন। প্রথম ভাগ– ট্রাডিশনাল, অর্থাৎ যারা শোষকের প্রতিষ্ঠান থেকে বা শোষকের পক্ষে সমাজে হেজেমনি তৈরি করেন ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধার্থে, যেমন হীরক রাজার সভাকবি। এবং দ্বিতীয়– অরগ্যানিক, যারা শোষিতের প্রতিরোধে কাউন্টার-হেজেমনি তৈরি করেন সমস্ত সম্ভাব্য রাজরোষ উপেক্ষা করেই– হীরক দেশের বাউল/গুরুমশাই। এখন জ্ঞানত বা অজ্ঞানে প্রতিটি শিল্পী-বুদ্ধিজীবী হয় প্রথম শ্রেণিতে পড়েন অথবা দ্বিতীয়তে। এই দুয়ের মাঝে বা বাইরে কোনও অবস্থান হয় না। ঋত্বিক ঘটকের বয়ানে ‘শ্রেণীহীন শিল্প বলে এখনো পর্যন্ত কিছু তৈরী হয়নি। কারণ শ্রেণীহীন সমাজ বলে এখনো কিছু নেই।’ তাই ধর্ষক ও ধর্ষিতার মধ্যে নিরপেক্ষ অবস্থান বলে কিছু হতে পারে না। এখানে নিরপেক্ষতা মানে আসলে ধর্ষকের পক্ষই নেওয়া। শোষিত বা ধর্ষিতার জন্য ন্যায়-বিচার না হওয়া পর্যন্ত তার বিজয় না হওয়া পর্যন্ত এই সংঘর্ষের কোনও পরিশেষ নেই। লড়াই চলবেই এবং স্বাধীনতার বিপ্লব দীর্ঘজীবী হবেই। এটাই শেষ কথা।
(সমাপ্ত)