‘এজেন্ট বিনোদ’, ‘বদলাপুর’, ‘অন্ধাধুন’ — এসবের স্ক্রিপ্ট, অরিজিৎ বিশ্বাসের। সামনেই মুক্তি পাবে তাঁর লেখা পরবর্তী সিনেমা, ‘মেরি ক্রিসমাস’। মুখ্য ভূমিকায়, বিজয় সেতুপতি আর ক্যাটরিনা কাইফ। কর্ণাটক ও তামিলনাড়ুর সীমান্তে, আত্তিবেলের নিরালা বাড়িতে, লেখকের সঙ্গে মুখোমুখি আড্ডায়, উদয়ন ঘোষচৌধুরি। আজ দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব।
একা লিখলে স্ক্রিপ্ট বেশি ভালো হয়, না একটা টিম-ওয়ার্ক দরকার?
মূলত আমি আর শ্রীরাম লিখি। মানে, আমাদের যা যা আইডিয়া আসে, সেগুলো একজন আরেকজনের মতামত নিয়ে লিখে রাখি। শ্রীরাম একটু ভুলোমনের, অনেককিছু বলে, আবার ভুলে যায়… তো, লিখে রাখার বেসিক লেগ-ওয়ার্কটা আমার…
পূজা (লাধা সুরতি) শ্রীরামের সঙ্গে আগাগোড়া থাকে, সব কাজে। গল্পের বীজ বেরনো থেকে, অ্যাসিস্ট করা, এডিট করা, অসাধারণ মিউজিক সেন্স… মানে, পূজা প্রায় শ্রীরামের ছায়া। আমাদের লেখার সব সেশনে হয়তো বসতে সময় পায় না। কিন্তু, আমরা ওর বক্তব্যের মর্যাদা দিই। এই তিনজন হল বেসিক টিম।
এবার, চতুর্থ কেউ মাঝে মাঝে ঢোকে। ধরো, কারওর মধ্যে দুর্দান্ত ট্যালেন্ট আছে। হয়তো এমন কোনও সিনের বা গল্পের আইডিয়া নিয়ে এল, যেটা খুব ইন্টারেস্টিং লাগল। তখন তাকেও দলে ডেকে নিই।
‘অন্ধাধুন’-এ পাঁচজন রাইটার ছিলেন…
হ্যাঁ, ‘অন্ধাধুন’-এ পাঁচ হয়ে গেল, কারণ হেমন্ত রাও ওই মূল শর্ট ফিল্মটা শ্রীরামকে দেখিয়েছিল। শ্রীরাম ওকে ওটা নিয়ে লিখতে বলল। হেমন্ত যেটা লিখেছিল, সেটা অল্পই… তারপর ও নিজের ছবি বানাতে চলে গেল… কিন্তু, যতটুকু লিখেছিল, তার মধ্যে কিছু জিনিস আমরা নিয়েছি।
তাহলে, আপনার মতে টিম-ওয়ার্কটা বেটার?
কালেক্টিভলি কাজ করলে অন্তত আমার কাছে ভালো লাগে। নভেলের একটা জার্নি আছে, একা, লম্বা– ওইভাবে একা বসে লিখছি, লিখছি, লিখে যাচ্ছি, এটা আমার একটু দমবন্ধ লাগে। আমাদের ওই নাটকের দলে, এক-একটা সিন লেখার পর ডিরেক্টর, অ্যাক্টর– প্রত্যেকে শুনছে, অংশগ্রহণ করছে, সাপোর্ট দিচ্ছে। মনে হয়, ওই সময় থেকেই কোলাবোরেটিভ রাইটিংটা আমার কাছে কমফোর্টেবল হয়ে গেছে। কন্টিনিউয়াস ফিডব্যাক আর ডিসকাসন ছাড়া এখন আর হয়তো লিখতে পারব না। নভেল লেখায় যে ডিসিপ্লিন লাগে, মনে হয়, এই বয়সে সেটা আর হবে না।
রাইটিং টিমের বাইরে আর কেউ হেল্প করেন, লেখার ব্যাপারে?
হ্যাঁ, লিখলাম আর সোজা শুটে চলে গেল– এ হয় না কি! স্ক্রিপ্ট, শুট, এডিট, মিউজিক, তবে তো ফাইনাল প্রোডাক্ট! বড় ফিল্মের শিডিউলও দু’-তিনটে থাকে, স্ক্রিপ্টেরও চেঞ্জ হয়– এই পুরো জার্নিতে অনেক মানুষের অনেক অভিমত থাকে, ফিডব্যাক থাকে। আমি সেটা পছন্দ করি। লেখার পর, চেনাজানা মানুষদের পড়তে দিই। বলি, যদি এটা ভীষণ ভালোও লাগে, সেটা ছেড়ে পাঁচটা পয়েন্ট বলো, যেগুলো ভালো লাগেনি। এই ফিডব্যাকটাই আমাকে হেল্প করবে। ওই পাঁচটার মধ্যে কয়েকটা হয়তো নিজেই ভেবেছি; কিন্তু যেটা ভাবিনি, সেটা নিয়ে কাজ করব।
একটা কথা মনে রাখা দরকার। ‘দারুণ’, ‘অসাধারণ’– এগুলো শুনে খুশি হওয়া যায়, লেখা বেটার হয় না, লেখার পর লেখাটা পড়াতে হবে। তাদের দিয়ে পড়াতে হবে, যারা কিছু জানে, যারা মুখের ওপর খুঁতগুলো লজিক দিয়ে বলবে।
অরিজিৎ বিশ্বাসের সাক্ষাৎকার। প্রথম পর্ব: রিভলভার থেকে সব গুলি বেরিয়ে গেলে সেটা একটা ফার্নিচার হয়ে যায়
স্ক্রিপ্ট ফাইনাল হওয়ার পর, কাস্টিং বা স্টারের সুবিধা মতো স্ক্রিপ্টে কখনও কিছু বদলেছেন?
না, সেরকম বদলাতে হয়নি। তবে, বড় স্টারের জন্য স্বাভাবিকভাবেই বড় রোল লেখা হয়। কারণ, তারা ওটা টেনে নিয়ে যেতে পারে, দর্শক তাদের বিশ্বাস করবে, দেখবে। এবার, যাকে ভেবে লেখা হয়েছে, তাকে পাওয়া গেল না। যাকে পাওয়া গেল, সে হয়তো অতটা নাম-করা নয়, টানতে পারবে না। তখন কিছু চেঞ্জ করতে হয়।
‘এজেন্ট বিনোদ’-এ নীল নিতিন মুকেশের একটা রোল করার কথা ছিল। বিভিন্ন কারণে তাকে পাওয়া গেল না। যাকে পেলাম তাকে ওই রেঞ্জে ট্রাস্ট করা যাবে না। তখন ওই রোলটা ছোট করতেই হল। ওখানে ধরমজিকেও (ধর্মেন্দ্র) একটা রোলে ভেবেছিলাম, ‘আঁখেঁ’-র রেফারেন্স রেখেছিলাম– তাকেও পেলাম না। সেটাও ছোট করতে হল। এগুলো করতেই হয়।
অনেকসময় অবশ্য আমরা চেঞ্জ করি না। যেমন, ‘অন্ধাধুন’-এর স্ক্রিপ্ট পড়ে রণবীর (কাপুর), বরুণ (ধাওয়ান), হৃতিক (রোশন)– এরা রাজি হননি। কিন্তু, আমরা শিওর ছিলাম ওই স্ক্রিপ্টটাই ফাইনালি হবে। তারপর, একদিন আয়ুষ্মান (খুরানা) শ্রীরামকে ফোন করল, আল্টিমেটলি ওকে নিয়েই হল।
বাংলা, হিন্দি — টিভি আর ফিল্ম মিলিয়ে দু’জায়গাতেই প্রায় ২৫ বছর কাজ করছেন। লেখককে সম্মান দেওয়ার ব্যাপারে কলকাতা আর বম্বের মধ্যে কোনও পার্থক্য নজরে পড়ে?
না, সম্মান দেওয়াতে কোনও পার্থক্য আছে বলে মনে হয় না। সমস্যাটা অন্য। বাজেট। বাংলায় যা বাজেট, তাতে কোনও লেখককে লিখে সংসার চালাতে হলে বছরে অন্তত ৬-৭টা প্রোজেক্টে কাজ করতে হবে। সেটা তো অমানুষিক ব্যাপার!
একটা প্রফেশনাল স্ট্রাকচার্ড স্ক্রিপ্ট লিখতে, বম্বেতে কেউ যদি বলে, দু’মাসে লিখে দেব, লোকে আশ্চর্য হয়ে তাকাবে। ভাববে, লোকটা জানেই না কী বলছে! হিন্দিতে একটা স্ক্রিপ্টে মিনিমাম এক বছর সময় দেওয়া হয়। ধরো, ‘ইক্কিশ’– জাস্ট শুট শুরু হয়েছে, লেখা হয়েছে গত চার বছর ধরে। হ্যাঁ, আমরা একটু এক্সট্রা সময় নিই বটে। বলছি না, সবাই এরকম, কিন্তু, শ্রীরাম ফ্যাক্টরটা বাদ দিলেও, ওখানে লেখককে সময় দেওয়া হয়।
বাংলার সমস্যা হচ্ছে, ওই সময়টার টাকা কে কোথা থেকে দেবে লেখককে? টাকা না পেলে লেখক খাবে কী? এখানে কার দোষ, কী করা উচিত– এসব ঘেঁটে কোনও লাভ নেই। কলকাতার একটা হাউজকে বলেছিলাম, স্ক্রিপ্টরাইটিং কম্পিটিশন করা হোক! যার স্ক্রিপ্ট ভালো হবে, তাকে দশ লক্ষ টাকা দেওয়া হবে। এই টাকাটা হিন্দিতে ভীষণই কম। কিন্তু, বাংলাতে এটাই যথেষ্ট বেশি। জানি না, আমার কথায় কিছু হবে কি না…
কলকাতায় কীভাবে স্ক্রিপ্ট লেখা চলছে বলে মনে হয়?
লিখতে গেলে প্রথমে রিসার্চ করতে হয়, অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে হয়। সেই সময়টা না পাওয়া গেলে, নিজেকে খনন করা ছাড়া কোনও উপায় থাকে না, কিন্তু সেটা করে কতদূর যাব? আমরা সবাই মধ্যবিত্ত পাতি শহরবাসী– কত গল্প বেরবে সেখান থেকে? তাই, ওই শহুরে ক্রাইসিসের চক্করে গল্পগুলো ঘুরতে থাকে…
এখন একটা ‘হু-ডান-ইট’ প্রোজেক্টের কথা চলছে। আমি আর শ্রীরাম মনে করি, ‘হু-ডান-ইট’ নিয়ে ভালো সিনেমা হতে পারে না, স্ট্রাকচারাল প্রবলেম আছে। কিন্তু, সেটাই একটা ক্রিয়েটিভ চ্যালেঞ্জ। ওটা যদি সাইন করি, তাহলে প্রথমে কী করব? ইউটিউবে অলরেডি হলিউডের ৫০-৬০টা পুরনো ‘হু-ডান-ইট’ সিনেমা মার্ক করে রেখেছি। ওগুলো দেখব। পাশাপাশি, ওই ধরনের অনেক বই পড়ব। হয়তো আগে পড়েছি বা দেখেছি, এবার ক্রিটিক্যালি অ্যানালাইজ করব– ওখান থেকে ভিজুয়াল ইমেজারি, ক্যারেক্টার, প্লট পয়েন্ট, এসব ডেটা পয়েন্ট মাথায় ঢুকবে। এসব করতেই ছ’-সাত মাস লেগে যাবে। তারপর, ওই ডেটা প্রসেস করে সেই কাঁচামাল থেকে যে প্রস্তুতি হবে, তাতে হয়তো চ্যালেঞ্জটা নেওয়া যাবে, কিন্তু এখনই লিখতে আরম্ভ করলে সেটা হবে না, তাই না? তাছাড়া, সাইন করলে বেসিক গল্পটা তৈরি করব এক বছর ধরে, স্ক্রিপ্ট তারপর! শর্ত হল, এতকিছু করেও বলতে পারি, সরি, ‘হু-ডান-ইট’ হল না… অবশ্যই এখানে অ্যাডভান্স নেব, কারণ পথটা বেশ দুর্গম।
এই রিসার্চ টাইমটাই বাংলায় পাওয়া কঠিন। তাই, ওখানে মোটামুটি সবই মধ্যবিত্ত শহুরেদের কাহিনি, ‘সোনচিড়িয়া’ লিখবে বলে সুদীপ শর্মা বুন্দেলখণ্ডে গিয়ে লোকাল ডায়ালেক্ট শিখল! কানাডার মাফিয়াদের নিয়ে লিখবে বলে ভ্যাঙ্কুভারে থাকল, সেই ফিল্মটা হয়ওনি! এগুলো কম বাজেটে হওয়া সম্ভব নয়।
স্ক্রিপ্টরাইটিং ছাড়া অন্য কোনও ফর্মের লেখা কখনও ট্রাই করেছেন?
না, নিজের সীমাবদ্ধতাটা জানি। আমার ওসব আসবে না, তাছাড়া ওই তাগিদটাও পাই না। নিজেকে সিম্পল ক্রাফটসম্যান মনে করি, চেষ্টা করলে হয়তো আবার নাটক লিখতে পারব, কিন্তু উপন্যাস বা গল্প লেখার ক্ষমতা বোধহয় আর নেই।
‘অন্ধাধুন’ না ‘বদলাপুর’– কোনটা বাছবেন?
‘অন্ধাধুন’ ছেড়ে দাও, ওটা একটা অ্যামিউজমেন্ট পার্ক। বুদ্ধির প্যাঁচ আছে, রুবিক’স কিউবের মতো… কিন্তু, গভীরতা কোথায়! আরেকদিকে, ‘বদলাপুর’ ইজ অ্যা হিউম্যান স্টোরি… এর যেসব ক্যারেক্টার, সেগুলোকে আমরা পুরোপুরি আত্মগত করে নিয়েছিলাম; প্রত্যেকটা চরিত্র আমাদের বছরের পর বছর হন্ট করেছে…
ইন ফ্যাক্ট, স্ক্রিপ্টটা লেখার আগে বা লেখার সময়ে, মূল বইটা আমি পড়িনি। শ্রীরাম আমাকে গল্পটার ব্রিফ দিয়েছিল। শুনেই বলেছিলাম, ‘মারাত্মক গল্প!’ নভেলটা পড়ে কার্লোটোর লেখা থেকে প্রভাবিত হতে চাইনি আমি।
‘অন্ধাধুন’-এর এত সাফল্য, পুরস্কার– সেসবের প্রভাব পড়েনি?
হ্যাঁ, অনেকেই বলেছিল, ‘অন্ধাধুন-২’ হোক! দর্শক জানতে চায়, তারপর কী হল! প্লাস, সহজেই অনেক টাকা পাওয়া যাবে। কিন্তু, শ্রীরাম বা আমি– কেউই ওটা আবার ঘাঁটতে চাইনি। যখন করেছিলাম, তখন নিজেদের আনন্দে করেছিলাম। এখন সেটাই প্রেশার হয়ে যাবে। রবীন্দ্রনাথ যেটা বলেছিলেন, ‘শেষ হয়ে হইল না শেষ…’, ওটা ধরতে পারা মস্ত বড় ব্যাপার… একটা কাজ কমার্শিয়ালি সাকসেসফুল হলে, সেটা নিয়েই থাকতে হবে এমন কোনও কথা নেই। হ্যাঁ, অনেকে করে, তারা হয়তো সেটা করতে পারে। আমাদের মাথায় আরও কত গল্প, সেগুলোকেও তো বলতে হবে!
আর, পুরস্কার পেতে কার-না ভালো লাগে! কিন্তু এসব ইন্সটিটিউশনাল অ্যাওয়ার্ড ছাড়াও অনেক কিছু থাকে… যেমন, ‘বদলাপুর’-এর স্ক্রিপ্ট পড়ে কার্লোটো বাহবা দিলেন! মেঘনাদদা’ (ভট্টাচার্য) ‘সায়ক’-এর জন্য নাটক লিখতে বললেন! ‘পুনা হর্স’-এর অফিসাররা বললেন, যুদ্ধের একদম গোড়ার কথাটা বলতে পেরেছি আমরা! এগুলোই তৃপ্তি…
এখন পর্যন্ত নিজের লেখা প্রিয়তম স্ক্রিপ্ট কোনটা?
‘ইক্কিশ’। এটা বায়োপিক, কিন্তু সেটা বড় কথা নয়– গল্পটায় ট্র্যাজেডি, নয়ার, যুদ্ধ সব মিলেমিশে, মানে, আমার জন্য আইডিয়াল! আর, ভালো ‘ওয়ার-ফিল্ম’ সেটাই, যেটা ‘অ্যান্টি-ওয়ার’– এটা ঠিক তাই-ই। আমার লেখা ইংরেজি ডায়লগগুলোই মোটামুটি অনুবাদ করে থাকছে, সেটাও ভালো লাগছে। আলাদা করে ডায়লগ লিখিয়ে দেখা গেল, খুব দাঁড়াচ্ছে না।
ও! ‘ইক্কিশ’-এর পর, অবশ্যই, ‘বদলাপুর’।
‘মেরি ক্রিসমাস’-এর পোস্টারে বেশ রেট্রো ফিল আছে… এটাও থ্রিলার?
হ্যাঁ, নয়ার-থ্রিলার, ক্রাইমের গল্প। বেসিক্যালি, হিউম্যান স্টোরি। তবে, শ্রীরামের সঙ্গে এখানে আমার একটা মতের অমিল হয়েছিল। মূল গল্পটা ছিল প্যারিসের সিক্সটিজে। সেটা আমরা এইট্টিজে রেখেছি। কারণ, শ্রীরাম ভেবেছিল, মোবাইল ফোন থাকলে গল্পটা দাঁড়াবে না। আমার যদিও সেটা মনে হয়নি, আমি আরেকটা ভার্সন ভেবেছিলাম, একদম কন্টেম্পোরারি। আমাদের সব লেখায় সবসময়েই মাল্টিপল ভার্সন থাকে। কিন্তু দিনের শেষে, ছবিটা শ্রীরামের, তাই সিদ্ধান্তটা অবশ্যই ওর।
‘মেরি ক্রিসমাস’, ‘ইক্কিশ’ – তারপর কী?
আমার আর শ্রীরামের খুব ইন্টারেস্টিং একটা গল্প আছে, সেটা এখন বলা যাবে না। সামনের বছর শ্রীরাম পুরোটাই ব্যস্ত থাকবে ‘ইক্কিশ’-এর শুটে। তো, আমার হাতে কিছুটা সময় আছে ওই গল্পটা নিয়ে ভাবার। এছাড়া, আমার নিজের দু’-একটা স্টোরি আছে…
সমসাময়িক কোন কোন স্ক্রিপ্টরাইটারের কাজ ভালো লাগে?
সুদীপ শর্মা। মারাত্মক লেখে, এক-একটা স্ক্রিপ্টে ভীষণ ডেডিকেটেড। ‘উড়তা পাঞ্জাব’, ‘সোনচিড়িয়া’, ‘পাতাল লোক’– কানাডার মাফিয়াদের নিয়ে যেটার কথা বললাম, ওরকম সাংঘাতিক স্ক্রিপ্ট খুব কম পড়েছি। ‘এনএইচ-টেন’– মুভির থেকে স্ক্রিপ্টটা অনেক অনেক বেটার। লোকাল ভাষা শিখে, ‘সোনচিড়িয়া’ এমন লিখল, শেষে হিন্দিতেই সাবটাইটেল করতে হল…
এখন সুদীপ ওয়েবের দিকে চলে গেছে। ওয়েব সিরিজে বোধহয় একটু বেশি টাকা পাওয়া যায়। কারণ, লিখতে হয় ফিল্মের থেকে অনেক বেশি। কিন্তু, ফিল্ম আর ওয়েব– দুটো সম্পূর্ণ আলাদা মেরু। ওয়েবে প্রচুর ক্যারেক্টার থাকে, প্রচুর সাব-প্লট থাকে। সেটা নিয়ে বিস্তারে খেলা যায়। ফিল্মে সবসময় প্রশ্ন ওঠে, এই ক্যারেক্টারটা কেন এল! এই সাব-প্লট কেন ঢুকল! এবার একটা মানুষ দু’দিকেই লিখতে পারে… কিন্তু, আমার আশঙ্কা হয়, ওর চিন্তা-ভাবনাটা যেন পালটে না যায়…
সুদীপ শর্মা ছাড়া?
চারুদত্ত আচারিয়া… শুরুর থেকেই টিভির রাইটার, এখন ওয়েবে চলে গেছে। রিসেন্টলি, ‘আরণ্যক’ লিখল…
এরা ছাড়াও অনেকে আছে… রীতেশ শাহ, প্রচুর লিখতে পারে! কিন্তু কয়েকটা ভালো লেখে, কয়েকটা ঝুলিয়ে দেয়! মনে হয়, ডিরেক্টর অনুযায়ী কাজ করে। ‘সর্দার উধম’ যেরকম লেখে, একটা মশালা ছবিতে ওরকম লেখে না।
আর, শ্রীরামের ভাই, শ্রীধর… ‘পাঠান’, ‘টাইগার থ্রি’, ‘ওয়ার’… একেবারে কমপ্লিট মেনস্ট্রিমের রাইটার! ওগুলো লিখেই ও ফুর্তি পায়।
শ্রীরাম আর শ্রীধর– দুই ভাইয়ের মধ্যে কোনও তুলনা করা যায়?
দু’জনের সমান পড়াশোনা, সমান পাণ্ডিত্য। থ্রিলার-ফিলার নিয়ে দু’ভাইয়ের পড়াশোনা সাংঘাতিক! শ্রীরামকে যদি জিজ্ঞেস করো, নিৎশে পড়েছ? পড়া তো দূর, হয়তো দেখলেই পালিয়ে যাবে! কিন্তু, শ্রীধর পড়েছে। ওদের প্রিয় সাবজেক্ট থ্রিলার, নয়ার, অ্যাকশন– এসবের এমন কোনও বই বোধহয় নেই, যেটা ওরা পড়েনি। কিন্তু, যে গল্পটা নিয়ে শ্রীরাম ডিপ ডাইভ করবে, শ্রীধর সেটাই নিয়ে হার্ডকোর কমার্শিয়ালে চলে যাবে।
নতুন যারা স্ক্রিপ্ট লিখছে, তাদের কী পরামর্শ দেবেন?
প্রচুর পড়তে হবে। সব ধরনের বইপত্র ছাড়াও ভালো ভালো স্ক্রিপ্ট পড়তে হবে। সেগুলো পড়ে ভিজুয়ালাইজ করার চেষ্টা করতে হবে। থ্রি-অ্যাক্ট ধরতে হবে। কোথায় ডায়লগ দেব, কতটা দেব; মনোলগ দেব কি না; ক্যারেক্টার আর্ক– এগুলো মাথায় গেঁথে ফেলতে হবে।
ব্যাকরণ জানার আগে ব্যাকরণ ভাঙতে গেলে মুশকিল। যে ব্ল্যাঙ্ক ভার্সে কবিতা লেখে, সেও যদি মিটার জানে, ছন্দ বোঝে– অবশ্যই আরও ভালো কবিতা লিখবে। স্ক্রিপ্টেরও ছন্দ থাকে, সেটা বুঝতে হবে। থ্রি-অ্যাক্ট মানতেই হবে এমন নয়, কিন্তু বুঝে ভাঙতে হবে।
আপনার পরিচালনায় একটা সিনেমা এল ২০১৯-এ। স্ক্রিপ্টরাইটিং না ডিরেকশন– কোনটা বাছবেন?
অবশ্যই স্ক্রিপ্টরাইটিং একটা ইন্টারেস্টিং জার্নি– কিন্তু, দিনের শেষে, ডিরেক্টর হতেও সাধ জাগে। অনেকসময় ফাইনাল এডিটে বসে মনে হয়, ইস! ডিরেক্টর ঠিক ধরতে পারেনি কী বলা হচ্ছে! তখন ইচ্ছেটা জাগে।
এই যে ছবিটা বানালাম, ‘সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে’, খুব খারাপ রেসপন্স ছিল না। কলকাতা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘বেস্ট ডিরেক্টর’ অ্যাওয়ার্ড পেলাম। আরও কিছু অ্যাওয়ার্ড, বিভিন্ন ফেস্টিভ্যালে। সকলে খুব ভাল কাজ করেছে। চিরঞ্জিৎদা’, অঞ্জন দত্ত, মেঘনাদ ভট্টাচার্য– প্রত্যেকেই দুরন্ত অভিনয় করেছে। কিন্তু, বেশি মানুষের কাছে ছবিটা পৌঁছয়নি। চেষ্টা করছি, ওটিটি রিলিজ করতে… দেখি…
আসলে, ছোটবেলা থেকে মেনস্ট্রিম ছবি দেখে দেখে ভালোবাসাটা তৈরি হয়েছে। তাই, এইদিকে এসেছি। আমি চাই, আমার ছবিও মূলধারার হোক, লোকে দেখুক। ছবিতে গভীরতা থাক, কোনও অসুবিধে নেই। সত্যি কথা, আর্ট ফিল্মটা… নট মাই কাপ অফ টি… আর্ট ফিল্মমেকার বা আর্টহাউজ দর্শক, কাউকে অন্য কিছু বলছি না… এটা জাস্ট আমার লিমিটেশন।
স্ক্রিপ্ট লেখার পাশাপাশি ভবিষ্যতে ডিরেকশনেও আসছেন?
হ্যাঁ, কয়েকটা বাংলা, কয়েকটা হিন্দি স্টোরি মাথায় আছে। ভাবছি, ২০২৪ থেকে বেশিরভাগ সময়টা বম্বেতেই থাকব। দু’-একটা ডিম পেড়ে রেখেছি, প্রোডিউসারদের সঙ্গে কথা চলছে। তবে, সব ডিম থেকে ছানা বেরোয় না, তা দিতে দিতে কয়েকটা ডিম সেদ্ধ হয়ে যায়, দেখি, কী হয়!
এতদিন ধরে চাকরি সামলে স্ক্রিপ্ট লিখছেন, অসুবিধা হয়নি?
অসুবিধা তো হবেই, এটা আমাদের সময়ের একটা ট্র্যাজেডি বলতে পারো। আটের দশকে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার না হলে, সর্বনাশ টাইপের ব্যাপার! আর, সেসব হওয়ার পর ছেড়ে দিতেও সাহস লাগত। এখনকার জেনারেশনে সেই চাপটা বোধহয় নেই– বম্বেতে দেখি, আইআইএম, ইউপিএসসি, ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ-আউট ছেলে-মেয়েরা এসে সিনেমায় কাজ করছে।
আপাতত এখানে থামি। আপনার নিজের যদি কিছু বলার থাকে, হয়তো সেই প্রশ্নটা আমার মাথায় আসেনি, সেরকম কোনও কথা…
একটা দুঃখ হয়। আমাদের দুই বাংলার বাইরেও বাঙালি ডায়াস্পোরাটা বিশাল! ওটা ধরতে গেলে দুই বাংলাকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। হয়তো তাহলে ঠিকঠাক পারিশ্রমিক দিয়ে বড়সড় ছবি বানাতে পারব।
বাংলার ইতিহাস দেখো, ভীষণ ভায়োলেন্ট একটা জাতি! আজও ভোটের সময় কী পরিমাণ মারামারি হয়! হয়তো ফর্মেশন ব্যাটেলটা আমাদের আসে না, বাংলার নরম মাটিতে ভালো কেল্লাও হয় না… কিন্তু গুপ্তঘাতে, গেরিলা যুদ্ধে, নদী-পথের যুদ্ধে বাঙালির মতো সিদ্ধহস্ত কমই আছে। আর্য, মুঘল, পাঠান– সব বাংলায় এসে আটকে গেছে! ‘বাহুবলী’-র স্কেলে আমাদের শশাঙ্ক, কেদার রায়, ঈশা খাঁ, চৈতন্যদেব– এগুলো হতে পারে না?
প্রত্যেকটা জাতি তাদের ইতিহাসের স্পেকটেকেল ডিজার্ভ করে। দুই বাংলা একসঙ্গে কাজ করলে সেটা হতে পারে, মনে হয়। তখন হায়দ্রাবাদের ‘আনন্দ মঠ’-এর জন্য আর অপেক্ষা করতে হবে না, অবশ্য এটার মধ্যে একটা ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণের ব্যাপার আছে, তবে সেটা অন্য গল্প।
(সমাপ্ত)