গঞ্জের নাম কুসুমডিহা। বাংলার শেষদিক। জঙ্গলমহলের একটু বড় গ্রাম। সেখানে এসেছেন নতুন পোস্টমাস্টার সুমিত। সুদর্শন যুবক, জনপ্রিয়। তরুণদের প্রিয় ‘মাস্টারদা’ কাজ করতে চান এলাকার জন্য। তবে শত্রুরও তো অভাব নেই। জলে থেকে কি কুমিরের সঙ্গে লড়াই করে পারবে সুমিত! আর রেশমি? এলাকার মেয়েদের স্কুলের বড়দির মেয়ে সে। চোখে-মুখে সুমিতের জন্য অপার মুগ্ধতা। ওদিকে ব্যবসায়ীর ছেলের নজরও যে রেশমীর দিকে। কোনদিকে বইবে তবে কুসুমডিহার হাওয়া?
পড়ুন কুণাল ঘোষের উপন্যাস ‘কুসুমডিহার কাব্য’। আজ প্রথম পর্ব।
হারান ভটচায বললেন, ‘এমন একজন ভাল মাস্টারবাবু এখানে এসেছেন, টিকলে হয়। আগে সকলের মুখে শুনছিলাম। সেদিন, ওই পঁচিশে বোশেখের অনুষ্ঠানে দেখলাম।’
শিবনাথ সোরেন বললেন, ‘কী সুন্দর কবিতাটা বলল। আর আমাদের, মানে বুড়োদের কত সম্মান করল! ছেলেটার ব্যবহার ভারি ভাল।’
নারায়ণ মাহাতো চশমা মুছতে মুছতে বললেন, ‘শুনলাম তো আবার টিউশনিও শুরু করেছে। তা ভাল। দুম করে চলে যাবে না। শহরের ছেলে। আমাদের এসব জায়গায় টিকলে হয়। আমি সেদিন ওর আপিসে গেছিলাম, যেতে হল, আমি অতশত বুঝি না খাতার। হেসে করে দিল।’
গঞ্জের নাম কুসুমডিহা। বাংলার শেষদিক। জঙ্গলমহলের একটু বড় গ্রাম। বাজারের ওপাশে বটতলার চায়ের ঠেকে আলোচনা চলছে।
আলোচ্য চরিত্রটি এখানকার নতুন পোস্টমাস্টার সুমিত কর। কিছুদিন হল এসেছে। মোটামুটি সুদর্শন যুবক। ইতিমধ্যেই জনপ্রিয়। ছোট জায়গা। মুখে মুখে রটে বেশি। মোবাইল ফোন, ইন্টারনেটের যুগে পোস্ট অফিসের চাপ কমেছে, তবে আছে। সুমিত একটু ঝাঁ চকচকেও করে ফেলছে। কর্মী খুব কম। ডাকপিওন দু’জন। তবে হ্যাঁ, একজন রানার আছে। ওপাশের পাহাড়ের উপরের তিনটে গ্রামের জন্য। জিন্স আর টি শার্ট পরা রানার। হাতে বল্লম, যদি ভাল্লুক বা কোনও জন্তু-জানোয়ার বের হয়।
সুমিত একা মানুষ। পাশের কোয়ার্টারে থাকে। তার নতুন চাকরির জায়গা মাঝেমধ্যে দু’তিনজন করে বন্ধু দেখতে আসে। একটু আড্ডা, হইহই, ঘুরে দেখানো। এর বাইরেও সুমিত বেশ গুছিয়ে নিচ্ছে। টিউশনি শুরু করেছে, ইংরেজি পড়ায়। নামমাত্র টাকায়। সময় কাটানোটা বড় কথা। সঙ্গে বাংলাও ঢুকে গিয়েছে। ছাত্রছাত্রী কিছু বাঙালি পরিবার থেকে, তবে আদিবাসী বেশি, ইংরেজি শেখার চাপ। আগে একসময় মাওবাদী সমস্যা ছিল তীব্র, রোজ রক্তারক্তি। এখন শান্তি। তবু, কোথায় যেন আশঙ্কার একটা শীতল স্রোত দৃশ্যমানতার আড়ালে বয়ে চলেছে।
শিবনাথ সোরেন বললেন, ‘মাস্টারের তো শুনলাম এর মধ্যেই নানারকম শত্রুও তৈরি হয়ে গিয়েছে। ও ছেলে শান্ত টাইপ। জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করে পারবে?’
হারান ভটচায বললেন, ‘আরে মাস্টার তো ভুল কিছু করেনি। কেউ কেউ যদি এলাকায় কোনও ভদ্রলোক দেখলেই ভাবে তাদের মৌরসিপাট্টা চলে গেল, তাহলে কে কী করতে পারে? তবে হ্যাঁ, এমন একটা ভাল ছেলে কুসুমডিহাতে টিকতে না পারলে সেটা আমাদের জন্যে খারাপ হবে। শুনলাম তো কোন ক্লাবের সঙ্গে মিলে একটা দাতব্য চিকিৎসালয়ও করবে বলছে। কলকাতা থেকে ওর ডাক্তার বন্ধুদের নাকি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে মাসে একদিন করে বসাবে।’
সুমিত নামেই পোস্টমাস্টার। এর মধ্যেই নামটা মুখে মুখে শুধু ‘মাস্টার’, কমবয়সিদের কাছে ‘মাস্টারদা’ হয়ে গিয়েছে। চালচলন, হাসি, ব্যক্তিত্ব, পোশাকআশাক, কাজের স্টাইল, কুসুমডিহার যেন নতুন হিরো।
আর শত্রু?
কুসুমডিহা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভূতের বাড়ির হাল। অথচ সেই সরকারি ডাক্তার বসেন পঞ্চায়েতবাবুর নার্সিংহোমে। গরিব মানুষ বিরক্ত। বলে বলে কাজ হয় না। সুমিত একদিন সটান রোগী নিয়ে নার্সিংহোমে ঢুকে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলে তাঁকে ধরে এনেছিল স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। কড়া করে বলেছিল, ‘এরপর কলকাতায় নালিশ যাবে আর এখানে ঘেরাও চলবে।’ পঞ্চায়েতবাবু সেই থেকে চটে লাল, তাঁর ধারণা সুমিত থাকলে তাঁকে আর জিততে হবে না।
তারপর শত্রু বলতে ওই মেঘনাদ বিশ্বাস, নামে শিক্ষক, আসলে এম এল এর চামচে। এইসব টিউশনি থেকে মোটা টাকা পেতেন। এখন নামমাত্র টাকায় দারুণ পড়াচ্ছে সুমিত। টাকা, সম্মান, সব গিয়েছে মেঘনাদের। তার বাহিনীর চক্ষুশূল সুমিত।
শত্রু আরেকজন হল মাধাই। জঙ্গলেরই উঠতি তরুণ। তথাকথিত বড় দলের রাজনীতি করে না। সামাজিক সংগঠন করে। ওদের থিওরি হল শহর থেকে এসে কেউ জঙ্গলের মানুষের উপকার করবে না। এসব শখের কথা আর কাজ। সুমিতকে এড়িয়েই চলে মাধাই। এলাকায় অনেকেই সেটা বোঝে।
আর একটি অতি স্পর্শকাতর বিষয়। এলাকার দু’-একটি অনুষ্ঠানে সুমিতকে পুষ্পস্তবক দিয়ে বরণ করতে দেখা গিয়েছে রেশমিকে, ভূগোলের স্নাতক, এখানকার মেয়েদের স্কুলের বড়দির মেয়ে, নিজেও ওখানেই পড়াচ্ছে। রেশমির চোখ-মুখের ভাব দেখে অনেকেই অনেক কিছু নাকি বুঝেছে। তারপর থেকে নাকি তাকে একাধিকবার পোস্ট অফিসে দেখা গিয়েছে। এ নিয়ে রটনা তো হাওয়ার গতিতে ছুটেছে ক্রমশ রঙিন হয়ে উঠতে উঠতে। এখন সমস্যা হল এই যে, এখানকার বিরাট ব্যবসায়ী বাঁশরীলাল দাসের ছেলে বিদ্যুতের নজর রেশমির দিকে। বাঁশরীর বৈধ, অবৈধ সব ব্যবসার যুবরাজ বেয়াড়া টাইপের বিদ্যুৎ একগাদা বদ ছেলে নিয়ে ঘোরে, কাঁচা টাকা ওড়ায়, রেশমিকে দেখলেই উৎপাত করে। ভয়ে কেউ কিছু বলে না। এড়িয়ে যায়। থানা পুলিশও এদের ঘাঁটায় না বা পুজো পেয়ে খুশি থাকে। ফলে কলকাতা থেকে ঢের দূরের জঙ্গলমহলে আপাতশান্তির আড়ালে কুসুমডিহার এক অন্য কাব্য চলতেই থাকছে। তার মধ্যেই পোস্টমাস্টার হয়ে গ্রামে এসে সকলের সঙ্গে মিশে দু’-চারটে ভাল কাজ করতে চাইছে সুমিত।
রেশমি তাকে বলেছিল, ‘‘ক’দিনের হুজুগ। তারপর তো গ্রামে দমবন্ধ লাগবে। ফিরে যাবেন কলকাতা।’
সুমিত বলেছিল, ‘কলকাতাটাই কেন মনে হয় বলুন তো? আমার তো দিব্য ভাল লাগছে এখানে। মনে হচ্ছে কত কাজ করার আছে।’
হারান, শিবনাথ, নারায়ণদের আড্ডা এ দিনের মতো প্রায় শেষ, উঠি উঠি ভাব; হঠাৎ বাজারের দিক থেকে হল্লার আওয়াজ; দু’-একজনের একটু দৌড়।
–ওরে, কী হল? কী হল? হারান উদ্বিগ্ন।
–আর বোলো না। তোলা নিতে এসে বাড়তি চেয়েছিল বিদ্যুৎবাবুর ছেলেরা। রহিমদা দেয়নি। ওকে মারছিল। সেই সময় রেশমিদি দুই বান্ধবীকে নিয়ে যাচ্ছিল। ওরা বাধা দেয়। রেশমিদিকেও ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে গালাগালি করছে একজন বলে গেল।
–আর তোরা পালিয়ে যাচ্ছিস?
–তো কী করব? ওদের গুন্ডা বেশি। ছোরা ছুরি আছে। পুলিশ ওদের কথা শোনে। আমি মাস্টারদাকে খবরটা দিয়ে আসি।
(ক্রমশ)