চিকিৎসা-পরিষেবা আর বাজারচালিত পণ্যের বিজ্ঞাপনকে একই সারিতে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। কারণ এই পরিষেবার সঙ্গে একজন রোগীর জীবনমৃত্যুর প্রশ্ন জড়িয়ে রয়েছে। আইনের নির্দিষ্ট অনুসাশন মেনে একজন চিকিৎসক তার ক্লিনিক বা হাসপাতালের সুযোগ-সুবিধা, চিকিৎসা-সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি আর পরিষেবা ইত্যাদির বিজ্ঞাপন বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার করতেই পারেন। বিজ্ঞাপন দেওয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসককে অনেক বেশি সতর্ক আর দায়িত্বশীল হতে হবে।
সম্প্রতি কোনও এক সংবাদপত্রে ‘চিকিৎসা তো পণ্য নয়! তাহলে বিজ্ঞাপন কেন’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদন অনেকেরই নজরে এসেছে। যেখানে বিভিন্ন কর্পোরেট হাসপাতাল কিংবা প্রাইভেট চিকিৎসকদের নানা প্রচার বিজ্ঞাপনীর কথা উল্লেখ করে সেগুলির আইনগত ও সামাজিক দিকগুলি নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বিভিন্ন গণমাধ্যমে ডাক্তারেরা নিজের ছবি দিয়ে এমন অবাধ বিজ্ঞাপন কি আদৌ করতে পারেন?
এই প্রশ্নের নেপথ্যে রয়েছে দু’টি শব্দ, পণ্য ও পরিষেবা, যা অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পণ্য একটি জড়বস্তু যা দেখা যায়, স্পর্শ করা যায়, অন্যকে হস্তান্তর করা যায় এবং চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদনও করা যায়। যেমন টেলিভিশন, ঘড়ি, গাড়ি, তেল, আনাজপাতি, মোবাইল ফোন ইত্যাদি।
পরিষেবা হল কোনও ব্যক্তির জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও বিচার ক্ষমতার প্রকাশ যার দ্বারা ভোক্তা বা ক্রেতার নির্দিষ্ট কিছু চাহিদা পূরণ করা হয়। পরিষেবা নিরাকার এবং অ-ভৌত। অর্থাৎ তাদের দেখা যায় না, হাতে ধরা বা স্পর্শ করা যায় না, কিন্তু ভোক্তা সেগুলি দ্বারা নিজের চাহিদা পূরণের দিশা খুঁজে পান। পরিষেবাগুলি এক ব্যক্তির থেকে অন্যের কাছে হস্তান্তর করা যায় না। পণ্যের মতো বাজারের প্রয়োজন অনুসারে সেগুলি উৎপাদন করাও সম্ভব নয়। একজন ডাক্তার, উকিল কিংবা স্কুলমাস্টার তাঁর জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা দিয়ে যখন মানুষের (ভোক্তার) চাহিদা পূরণ করেন, সেটাকেই পরিষেবা বলা হয়।
আরও পড়ুন: দরাদরির দিন ফুরলো, বন্ধুবিচ্ছেদ হলুদ ট্যাক্সি ও মিটারের
‘পণ্য’ এবং ‘পরিষেবা’– দু’টিই নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করতে হয়। নির্মাতারা ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার জন্য তাদের পণ্যের গুণমান ব্যাখ্যা করে পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন, সোশাল মিডিয়া ইত্যাদিতে নানা ধরনের আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন প্রচার করে থাকে। সেই সঙ্গে আনুষঙ্গিক পরিষেবাগুলিও (ওয়ারেন্টি, মেনটেনেন্স, আপৎকালীন সহায়তা ইত্যাদি) যথাযতভাবে বিজ্ঞাপিত হয়। এবং সেটি আইন অনুযায়ী স্বীকৃত।
একজন ডাক্তার, যিনি অর্থের বিনিময়ে ক্রেতাকে তার দক্ষতা এবং জ্ঞান (পরিষেবা) বিক্রি করছেন, তা তিনি দীর্ঘদিনের পড়াশোনা, পরিশ্রম আর নিষ্ঠার দ্বারা অর্জন করেছেন। পণ্য-উৎপাদকেরা অধিক বিক্রি আর লাভের জন্য যদি বিজ্ঞাপন করতে পারে, তাহলে ডাক্তারেরা পরিষেবা বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপন করতে পারবেন না কেন? যখন দু’-ক্ষেত্রেই উদ্দেশ্য একই– জীবিকা ও জীবনের স্বার্থপূরণ।
অনেক ক্ষেত্রেই বিক্রেতা তাঁর পণ্যের গুণগত মানকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বিজ্ঞাপিত করে থাকেন। এর ফলে বিভ্রান্ত ক্রেতার আর্থিক ক্ষতি এবং প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। আগে এ বিষয়ে অভিযোগ জানানোর কোনও উপায় ছিল না। কিন্তু ১৯৮৬ সালে আমাদের দেশে প্রথম চালু হওয়া ‘ক্রেতা সুরক্ষা আইন’ উপভোক্তাদের কিছুটা আশ্বস্ত করেছিল। মিথ্যা প্রতিশ্রুত-ভরা নিম্নমানের ত্রুটিযুক্ত পণ্যের জন্য এখন তাঁরা বিক্রেতার কাছ থেকে উপযুক্ত পরিমাণে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারেন। বর্তমানে চিকিৎসা-পরিষেবাকে ক্রেতা সুরক্ষা আইনের আওতায় নিয়ে এসে তাকে ‘পণ্য’র তকমা দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসকের ভুল কিংবা অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য কোনও রোগীর শারিরীক এবং মানসিক ক্ষতি কিংবা মৃত্যু হলে রোগীর পরিবার নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসাবে দাবি করতে পারেন। অনেক ক্ষেত্রেই আদালত তাদের বিচার অনুযায়ী সেটা মঞ্জুর করে থাকেন। অর্থাৎ আইনের যে ধারায় একজন পণ্য-বিক্রেতা দোষী সাব্যস্ত হন, সেই একই ধারায় একজন চিকিৎসা পরিষেবাকারীকেও দায়ী করা হয়। বলা হয় সমস্ত পণ্য পরিষেবা, কিন্তু সমস্ত পরিষেবা পণ্য নয়। তাই যেদিন থেকে ডাক্তারি পরিষেবাকে ক্রেতা সুরক্ষা আইনের বেড়াজালে বেঁধে ফেলা হয়েছে, সেদিন থেকেই চিকিৎসকরা তাঁদের পরিষেবা বা পণ্যের বিজ্ঞাপন দেওয়ার অধিকার অর্জন করেছেন।
আরও পড়ুন: একলা চলো-য় জুড়ল না ভারত, জোটে জুড়ে থাকা কি শিখবেন রাহুল?
মুষ্ঠিমেয় কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বেশিরভাগ ব্যবসায়ীই অতিরঞ্জিত আর মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ছাড়াই তাদের পণ্য-বিজ্ঞাপনে সঠিক এবং যথাযথ তথ্য উল্লেখ করেন। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ক্রেতা পণ্যটির বিষয়ে জানতে পারেন, সেটির চাহিদা বাড়ে। ক্রেতা সুরক্ষা আইনে চিকিৎসা-পরিষেবাকে পণ্যের আওতায় নিয়ে আসার পর, চিকিৎসকের পক্ষে প্রচার মাধ্যমে নিজের পরিষেবা সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন দেওয়ার কোনও বাধা থাকা উচিত নয়। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিকাঠামোয় বিক্রয়যোগ্য পণ্য আর স্বাস্থ্য-পরিষেবাকে সমান দৃষ্টিতে দেখা হয়। দোকান থেকে পছন্দের জিনিস কেনবার আগে ক্রেতা সেটির উপকারিতা, ব্যবহারবিধি, স্থায়িত্ব, গ্যারান্টি ইত্যাদি বিষয়গুলি খুঁটিয়ে জেনে নেওয়ার সুযোগ পান। কিন্তু চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার আগে রোগীর সেই সুবিধা থাকে না। তিনি আদৌ জানতে পারেন না যে, চিকিৎসায় তার অসুখ সারবে কি না, কতদিন চিকিৎসা চলবে কিংবা খরচই বা কত হবে।
তাই মনে রাখতে হবে যে, চিকিৎসা-পরিষেবা আর বাজারচালিত পণ্যের বিজ্ঞাপনকে একই সারিতে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। কারণ এই পরিষেবার সঙ্গে একজন রোগীর জীবনমৃত্যুর প্রশ্ন জড়িয়ে রয়েছে। আইনের নির্দিষ্ট অনুসাশন মেনে একজন চিকিৎসক তার ক্লিনিক বা হাসপাতালের সুযোগ-সুবিধা, চিকিৎসা-সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি আর পরিষেবা ইত্যাদির বিজ্ঞাপন বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার করতেই পারেন। বিজ্ঞাপন দেওয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসককে অনেক বেশি সতর্ক আর দায়িত্বশীল হতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যে বিজ্ঞাপনের চমকে রোগী যেন বিভ্রান্ত না হন। কোনওভাবেই রোগীকে প্রতারিত করা ক্ষমাহীন অপরাধ। তাই গণমাধ্যমে চিকিৎসা-সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন প্রচার করার আগে স্থানীয় ‘চিকিৎসক সংগঠন’ থেকে আইনের নিয়মকানুনগুলি জেনে নিতে হবে।
চিকিৎসা-বিজ্ঞাপনে নীচের বিষয়গুলি উল্লেখ করা যাবে না।
• বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে চিকিৎসার ফলাফলের ওপর কোনও গ্যারান্টি বা প্রতিশ্রুতি দেওয়া।
• বিজ্ঞাপনের ভাষায় ‘বিশ্বমানের’, ‘আমরাই সেরা’, ‘আমরা অন্যদের থেকে আলাদা’ ইত্যাদি শব্দবন্ধের ব্যবহার।
• চিকিৎসার খরচপাতি-সহ আর্থিক বিষয়গুলি উল্লেখের ক্ষেত্রে কোনওরকম গোপনীয়তা বা অস্বচ্ছতা।
• রোগী সংক্রান্ত কোনও তথ্য ছবি বা পরিসংখ্যান পরিবেশন।
• চিকিৎসকের ছবি, বায়োডাটা বা প্রশংসামূলক বর্ণনা।
এই প্রসঙ্গে এটাও উল্লেখ করা দরকার যে, শুধুমাত্র ডাক্তার বা কর্পোরেট হাসপাতালগুলিকেই সতর্ক করলে চলবে না। জ্যোতিষী, তান্ত্রিক, টিউটোরিয়াল হোম ইত্যাদি পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা, যারা দিনের পর দিন সংবাদপত্র, টেলিভিশন, হোর্ডিং ইত্যাদির মাধ্যমে ভ্রান্ত এবং অনেকাংশে অসত্য বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে বিপথে চালিত করে চলেছেন, তাদেরও আইনের আওতায় এনে প্রয়োজনে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে ।