বাঙালিও সোলোয় ষোলোআনা আছে। এদিক-সেদিক ছুটকো জায়গা পেলেই ঘুরে আসে। ছবিছাবাও দেয়। বেশ করে। জনান্তিকে বা জনারণ্যে বুক ফুলিয়ে বলতেও পারে, জায়গাটা ‘ভার্জিন’, আমারই আবিষ্কার, আমিই ভাস্কো দা গামা। সক্কলে মিলে যা হয় তা আসলে বেড়ানোর ঘ্যাঁট– ব্যাডভেঞ্চার, সোলোই হল গিয়ে অ্যাডভেঞ্চার। পদে পদে বিপদ। বন্ধুরা নেই, বন্ধুরতা আছে। কিন্তু ওই পথেই বাপু নবজীবন ক্লাবের সদস্য হওয়া যায়। অন্তরে বিকাশফুল ফোটে।
একসঙ্গে বেড়ানোর জবরদস্ত প্ল্যান করে বন্ধুরা অন্তিম ক্ষণে ল্যাং মেরেছে? আপনারই ছিল যত উদ? বেড়ানোর গ্রুপে আপনিই অ্যাডমিন, বাকি সব মিনমিনে? ভেবেটেবে রেখেছিলেন, কোথায় যাবেন, কী করবেন, কী খাবেন, কোন চুলোয় ছবি তুলে ছড়িয়ে দেবেন সোশাল পল্লিতে? জায়গাখানা নিয়ে এমন গবেষণা ফেঁদেছিলেন যে, সাম্মানিক ডক্টরেট অবধি পেয়ে যেতে পারতেন? দুগ্গাপুজোয় যত অস্ত্র, তাচ্চে ডবল বস্ত্র অর্ডার করে দিয়েছিলেন? অফিসের হাড়বজ্জাত ইমিডিয়েট বসের পর্যন্ত এ-ছুটিতে আপত্তি ছিল না, তবু বন্ধুরা, আপনারই সাধের বন্ধুরা, এমন ঘরবুনো, থুড়ি ঘরকুনো– যে প্ল্যানটাই মাটি! মাটির প্ল্যান শুধু প্রোমোটার বোঝে, কিন্তু প্ল্যান মাটির ব্যাপারে আপনিই সর্বজ্ঞ।
আগে হলে, এই পরিণতিতে ভেঙে-টেঙে পড়া যেত। মুখ বেজায় ব্যাজার করা চলত। বন্ধুদের মুখখারাপ করা যেত ‘বেআক্কেলে’– না, না, এর চাইতেও ভারি বাউন্ডারি-ওভার বাউন্ডারি শব্দে। কিন্তু এখন– আ মোলো যা! পাতি ‘সোলো’ যা! তোরা যাবি না তো যাবি না, ভারি বয়েই গেল। যাব ভেবেছি যখন, যাব। রবীন্দ্রনাথের গান, এই বদলানোর বাজারে খানিক গুনগুন করে বদলে গাইলেই হল– যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা সোলো রে। বন্ধুদের ডুবিয়ে দেওয়ার ফলশ্রুতি হোক, বা স্বেচ্ছায়– হাল আমলে, ‘সোলো’ খুব হিট বস্তু। ইউটিউব, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, এক্স হ্যান্ডেল হ্যাশট্যাগে ছত্রাকার। বাঙালিও সোলোয় ষোলোআনা আছে। এদিক-সেদিক ছুটকো জায়গা পেলেই ঘুরে আসে। ছবিছাবাও দেয়। বেশ করে। জনান্তিকে বা জনারণ্যে বুক ফুলিয়ে বলতেও পারে, জায়গাটা ‘ভার্জিন’, আমারই আবিষ্কার, আমিই ভাস্কো দা গামা। সক্কলে মিলে যা হয় তা আসলে বেড়ানোর ঘ্যাঁট– ব্যাডভেঞ্চার, সোলোই হল গিয়ে অ্যাডভেঞ্চার। পদে পদে বিপদ। বন্ধুরা নেই, বন্ধুরতা আছে। কিন্তু ওই পথেই বাপু নবজীবন ক্লাবের সদস্য হওয়া যায়। অন্তরে বিকাশফুল ফোটে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: লোকটা হেসেছিল বলে আত্মহত্যা স্থগিত সেইদিন
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
কিন্তু এ তো এআই-বাঙালি যাকে বলে ‘ট্রাভেল’ আর মরচে-বাঙালি বলে ‘ভ্রমণ’, তার কথা। এছাড়া তো নিত্যদিনের যাতায়াতের বেলায় আমবাঙালি ট্রামে-বাসে-ট্রেনে-টোটোয় যৌথভাবেই জীবন কাটায়। হ্যাঁ, মেলা দরকারে হলুদ ট্যাক্সি, অ্যাপ-ক্যাব ধরে। কিন্তু সে তো স্রেফ মাসের শুরুতে। এই রোজকার যে যাত্রাপথ, ধরুন বাড়ি থেকে সোজা অফিস, বা উল্টোটা, অফিস থেকে বাড়ি– এই পথে কি গণপরিবহণে, ধরা যাক, ওই ঝুরঝুরে বাসে একলা আসতে পেরেছে কেউ কখনও? অর্থাৎ, গণপরিবহণে সোলো? সিনেমা-টিনেমায়, ভূতের হলে তাও একটু চান্স থাকে। বাস-ডিপো থেকে না উঠে, মাঝরাস্তায় বাসে উঠতে গিয়েই হামেশাই নাজেহাল হয়েছে সক্কলে। কোন সময় কোন রাস্তায় সে রুটের বাসের দেখা মিলবে, তারই ঠিক থাকে না! বাসে সিট পাওয়া আর ব্লাড টেস্টের রিপোর্ট পুরোদস্তর ঠিকঠাক আসা, ব্যতিক্রম হে বাবাজীবন, অত আশা করতে নেই। তার ওপর আগুপিছু হয়ে দাঁড়াও। ঘাড়ে ঘাড়, পাছায় পাছা। এদিকে দু’হাত তুলে রড ধরে ব্যালান্স বজায় রাখা। ফলে গন্ধটা বড় দেহজনক। নিজের ও পরের। তাছাড়াও, বাস যদি-বা প্রখর রৌদ্রতপ্ত দিনে ফাঁকা-টাকা যায়, দু’ইঞ্চি পরপর বাস হেঁচকি তুলে থ! তারপর ধীরে ও ভিড়ে দশা এমনই হয় যে, যেদিকে টেরি কেটে যাত্রী ওঠে, নেমে দ্যাখে টেরি অন্যদিকে। ভাঁজ করা জামা পরে উঠলে ইস্তিরি করা, আর ইস্তিরি করা হলে উল্টোটা। দু’জন দু’মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকলেও কন্ডাক্টকর নিজেকে পোস্টকার্ডের ভাইরাভাই ভেবে কেমন করে যেন দু’জনের মধ্য দিয়ে এসপার-ওসপার করে। কখনও সিট পেলে, সহযাত্রী ঠ্যাং দু’খানা ব্যাঙের মতো ছড়িয়ে জানলার বাইরেটা গিলতে থাকে, কানে অবশ্যই ইয়ারফোন। আর নামার সময় দেখবেন, সব সময়ই আপনার থেকে আপনার ব্যাগখানি দু’হাত পিছিয়ে। তা টেনে-হিঁচড়ে নিজের কাছে নিয়ে আসাই আসলে দিনের আসল মোক্ষলাভ। এ-ই তো বেসিক ছবিখানা।
গণপরিবহণে এক্কেবারে একলাটি, মানে ভাবুন, কারও ঘাম-দুগ্গন্ধ নেই। চপ্পলের ওপর জাবদা শু-এর ধুলোছাপ নেই। সিগনাল এলেই সহযাত্রী জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বড় রাস্তায় নিষ্ঠীবন সাজিয়ে তুলছে না। দরজার গোড়ায় ব্যাগ কাঁধে ঝুলছে না কোনও মুশকো চেহারা। লেডিজ-জেন্টস-সিনিয়র সিটিজেন মায় প্রতিবন্ধী সিট নিয়ে একা একাই খেলতে পারছেন মিউজিকাল চেয়ার। কেউ ফুল ভলিউমে তার মোবাইল ফোনে বিচিত্র গান বাজাচ্ছে না। পাশের সিটের গোঁফঅলা কাকু আপনার কাঁধকে বালিশ ভাবছে না। পুরনো পাড়ার লোক এসে, সেই চিরকেলে বিরক্তিকর বেড়াভাঙা প্রশ্ন করছে না, ‘কী রে, বিয়েটা কবে সারছিস?’ কোনও বেয়াদব বাচ্চাই নিজের টিফিন বক্স খুলে ম্যাগি ছড়িয়ে ফেলছে না বাসের মেঝেতে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: বাঙালি পাঠক সাবালকত্ব হারাবে যদি তার সন্দীপন অপঠিত থাকে
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
কিন্তু গণপরিবহণে ‘সোলো’ ব্যাপারখানা তো কাঙ্ক্ষিতও নয়। দিনের পর দিন, এমনটা চললে তো ব্যবসা লাটে উঠবে! তাছাড়া এ কারণেও কাঙ্ক্ষিত নয় যে, আমাদের ছাপমারা যে বাসের ভেতরকার মধ্যবিত্ত চেহারাটা, চারপাশের যে মায়াপৃথিবীটা, তার যে তাড়াহুড়ো, মিলেমিশে যাওয়া, আনন্দ ও বিরক্তি, বাতিক ও উদাসীনতা– সেসবও দুম করে উবে যাবে। তাছাড়া ব্যাপারখানা বোরিং হয়ে যাবে না! কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। ক্রমে ভূতগ্রস্ত কিংবা ভূত হয়ে যাওয়া ছাড়া কোনও উপায় থাকবে না। স্বেচ্ছায় একা হওয়া আর একা করে দেওয়ার রাজনীতি তো এক হতে পারে না।
তবু, তবু আজ, এ লেখার শেষ পর্বে এসে গণপরিবহণে, বাসেই, একটা ‘সোলো’র কথা বলতেই হবে।
ঘটনাটা বেঙ্গালুরুর। এয়ারপোর্ট থেকে এক ভদ্রলোক– এস এস হরিহরণ ‘বিএমটিসি’র এক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে ওঠেন। কিন্তু বাস ছাড়ার নির্ধারিত সময়ে দেখা যায়, তিনিই একমাত্র যাত্রী। এটা ততটা অবাককর ব্যাপার নয়। কিন্তু অবশ্যই বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, একজন যাত্রী সত্ত্বেও বাসটা নির্ধারিত সময়েই ছেড়েছে। এবং যাত্রীকে সুসময়ে, নির্ধারিত ভাড়ায়, উষ্মাহীনভাবে পৌঁছে দিয়েছে গন্তব্যে। এমন ‘সোলো’ যাত্রার জন্য সোশাল মিডিয়ায় ড্রাইভার ও কন্ডাক্টরের সঙ্গে সেলফি দিয়েছেন এস এস হরিহরণ, জানিয়েছেন অফুরন্ত ধন্যবাদ।
গণপরিবহণে ‘সোলো’ ব্যাপারখানা জোলো বটে। কিন্তু বেঙ্গালুরুর ওই বাস ড্রাইভার ও কন্ডাক্টরের শৃঙ্খলা ও সময়ানুবর্তিতা ‘জোলো’ নয়। বরং জরুরি। জরুরি, সময়কে গুরুত্ব দিয়ে দেখা। সে মোটে একজন যাত্রীর সময় হলেও। যাত্রী পরিষেবার এহেন দৃষ্টান্ত কি মহানগরী কলকাতা দূর ভবিষ্যতেও, কখনও দেখাতে পারবে?