এই এলাকায় জবাগাছ নেই। তবে জবা আছে। সে হল পল্টুর বউ। চটকে ভরা রূপ, প্রবল চঞ্চল। ইদানীং তার এটা চাই, ওটা চাই– খরচ বেড়েছে। পল্টু আর সামলাতে পারছে না। তার ওপর জবা ঘনঘন টিলার নিচে গ্রামে যাতায়াত করছে। মাধাইদের দলের গোবিন্দ বলে ছেলেটা, তার সঙ্গে নাকি জবার পুরনো চেনা। পল্টু এই যাতায়াতটা পছন্দ করছে না। একবার জবাকে বলতে গেছিল লোকে কী বলবে, মানে লোকের কাঁধে বন্দুক রেখে নিজের কথা।
১৭.
পল্টু রানার দিব্যি ছিল। চাকরিটা সুখের। ডাকঅফিস থেকে চিঠিপত্তর সাগরটিলার ওপরে তোলা। কখনও এর-ওর চিঠি পোস্ট করে দেওয়া। মাঝেমধ্যে দু’-একজনের চিঠি লিখে দেওয়া। পল্টুর দর বাড়ত। প্রতিটা ঘরের সুখ-দুঃখের খবর রাখত।
টিলার ওপরের লোকগুলোকে তো নামতে হতই। কাজকম্মের জন্য। সবই গরিবগুর্বো, আদিবাসী, জঙ্গলের অধিকার যাদের। এদের মধ্যে পল্টুর সরকারি চাকরি, যতই চুক্তির হোক বা কম বেতনের; বাকিদের কাছে একটু মান্যিগুন্যি করার মতো। এই ঘরগুলোর কাজ বলতে খেতমজুরি আর পাতা কোড়ানো। এই পাতা কোড়ানো নিয়ে মাঝেমধ্যেই অশান্তি। কখনও যারা কেনে, ঠিকঠাক দাম দেয় না। কখনও আবার বনকর্মীদের সঙ্গে ঝামেলা। আর হাতি এসে জঙ্গলে ঢুকলে তো কাজকারবার বন্ধ! এভাবেই চলে এদের। মাঝেমধ্যে এদিক-ওদিক থেকে আত্মীয়বন্ধুরা এসে থাকে কোনও ঘরে। ক’দিন কাজ করে। পল্টু সব চেনে, দেখে।
ইদানীং দুটো সমস্যা হয়েছে তার।
প্রথম সমস্যা, জবা।
এই এলাকায় জবাগাছ নেই। তবে জবা আছে। সে হল পল্টুর বউ। চটকে ভরা রূপ, প্রবল চঞ্চল। ইদানীং তার এটা চাই, ওটা চাই– খরচ বেড়েছে। পল্টু আর সামলাতে পারছে না। তার ওপর জবা ঘনঘন টিলার নিচে গ্রামে যাতায়াত করছে। মাধাইদের দলের গোবিন্দ বলে ছেলেটা, তার সঙ্গে নাকি জবার পুরনো চেনা। পল্টু এই যাতায়াতটা পছন্দ করছে না। একবার জবাকে বলতে গেছিল লোকে কী বলবে, মানে লোকের কাঁধে বন্দুক রেখে নিজের কথা। জবা পাহাড়ি ঝরনাটার মতো খিলখিল করে হেসে বলেছে, ‘ও মা! ও তো গোবিন্দ।’ পল্টু ভেবড়ে গিয়েছে। এর তো দুটো মানে হয়। এক, ও গোবিন্দ, ওর সঙ্গে মেলামেশা নিয়ে প্রশ্ন তোলার মানেই হয় না। দুই, ও তো গোবিন্দ, ওর সঙ্গেই তো মেলামেশা স্বাভাবিক। কোন মানেটা নেবে, সেটা ভেবে পল্টু বিভ্রান্ত। তবে রাতের সোহাগে কোনও সমস্যা হচ্ছে না। পল্টু জবার পিছনে খরচ বাড়িয়ে ইদানীং এদিক-ওদিক হাত পেতে ফেলছে।
আর দ্বিতীয় সমস্যাটা খানিকটা এর সঙ্গে জড়িত। এই যে রসিকের ঘর, আর দু’-একটা ঘরে এর-ওর আত্মীয়া বলে দু’-একজন করে থাকছে, এটাকে স্বাভাবিক লাগেনি পল্টুর। যে মহিলা এসেছিল, সে যতই পাতা কুড়োতে যাক, তাকে আলাদা টাইপ মনে হয়। সঙ্গের লোকটাও। পল্টুকে দিয়ে দু’-একটা চিঠি পোস্ট করিয়েছে, ৫০ টাকা, ১০০ টাকার নোটে বকশিস। পল্টুর টাকা দরকার, তাই চোখ বুজে থেকেছে। মহিলার ব্যবহারও ভালো। এখন এরা উধাও হয়ে যাওয়ায় একটু ঘাবড়েছে। বিশেষ করে পুলিশি দৌড়ঝাঁপে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
কুসুমডিহার কাব্য। পর্ব ১৬: কমরেড ব্রহ্মা কতদিন পালিয়ে বেড়াবে?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
জবাও জিজ্ঞেস করেছে, ‘ও মেয়ে তোকে যে চিঠি ফেলতে দিত, তাতে গোলমাল নেই তো?’
পল্টু বলেছে, ‘চুপ থাক। ওসব কথা আর তুলিসনি।’
পুলিশের কাছেও ন্যাকা সেজেছে পল্টু। বলেছে সন্দেহজনক কিছু তো নজরে পড়েনি।
তবে সাবধান করেছে জবাকে। মাধাইদের দলের গোবিন্দর সঙ্গে মেশা যাবে না। দলটাই গোলমেলে। পুলিশ নজর রাখছে।
জবার এসব নিষেধাজ্ঞা পছন্দ নয়। তার আলাপ হয়েছে রেশমিদিদির সঙ্গেও। মাধাই আর রেশমি যখন কথা বলছিল, জবা গোবিন্দর সঙ্গে দাঁড়িয়েছিল। রেশমি নিজেই জিজ্ঞেস করল, ‘ও কে গো?’ গোবিন্দ বলেছে, ‘পল্টু রানারের বউ। টিলার ওপর থাকে।’ রেশমি বলেছে, ‘তোমাদের পোস্টমাস্টারবাবু তো এদিকে ঝামেলা দেখলেই টিলার উপর চলে যান।’
জবা বুঝেছে এটা দরদ মাখা খোঁচা।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
কুসুমডিহার কাব্য। পর্ব ১৫: প্রতিমাকে পাওয়া গেল কুসুমডিহায়, মিথ্যে ধর্ষণের মামলায় ফাঁসি হয়েছে তাঁর বরের
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সত্যিই তো, মাস্টারবাবু আসেন। লোকটাকে জবার ভালো লেগেছে। নানা গল্প করেন। সকলের সঙ্গে খান। খাটিয়া পেতে খোলা আকাশের নিচেও কখনও কখনও ঘুমিয়ে পড়েন। শহরের লোক, কিন্তু মাটির মানুষ। একদিন সকলকে মুরগির মাংস খাইয়েছিলেন নিজে রেঁধে। মানুষটার রান্নার হাতও ভালো।
গোবিন্দ জবাবে বলেছে, বাতাসের রটনা, মাস্টারবাবুর ওপর রেশমিদি ভারি দুর্বল। কিন্তু ওঁর ভিতুপনার জন্য ইদানীং একটু রেগে আছে।
পল্টুও জবাকে একই খবর দিয়েছে। এতে জবার কৌতূহল বেড়েছে আরও।
যাই হোক, পুলিশকে কিছু না বললেও পল্টু ঠিক করল রসিককে আলাদা ডেকে চাপ দিয়ে জিজ্ঞেস করবে, ওরা কারা ওখানে ছিল? পুলিশি চাপে রসিক আর ওপরের পরিবারগুলো আধমরা হয়ে আছে। আত্মীয়বন্ধুর উপকার করাও ঝকমারি।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
কুসুমডিহার কাব্য। পর্ব ১৪: এখন খবরের শীর্ষে কুসুমডিহায় মাওবাদী হামলা আর কমরেড ব্রহ্মা
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পল্টু জানে বাইরের ক’জন এখানে ছিল। পুলিশের কলকাতা থেকে আসা অফিসারকে সে বলেছে। কিন্তু সঙ্গে আরও বলেছে, এসব জায়গায় মাঝেমধ্যে কোনও চেনা আসে। হয়তো তাদের দিকে হাতি ঘুরছে, কাজকর্ম বন্ধ। এরাও কখনও-সখনও ওদিকে যায়।
গোবিন্দর সঙ্গে ফিরছিল জবা। কাচের চুড়ি কিনেছে। ফুরফুরে মেজাজ।
পুলিশের গাড়িটা পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল।
‘তুমি পল্টু রানারের বউ তো?’
জবা, গোবিন্দ দুজনেই থমথমে মুখে।
মহিলা পুলিশ বলল, ‘একটু থানায় যেতে হবে তো। উঠে পড় গাড়িতে।’
( চলবে)