এ বছর যে ছবিটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতা বিভাগে শ্রেষ্ঠ ছবির ৫১ লাখ টাকার পুরস্কারটি ছিনিয়ে নিল, সেটি ইজরায়েলের ছবি। ‘চিলড্রেন অফ নোবডি’, পরিচালক এরেজ টেডমর। ইজরায়েলের ছবি এই ভয়ানক যুদ্ধ পরিস্থিতিতে প্রতিযোগিতায় জিতে যাচ্ছে, এটা স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিতে পারিনি। গাজার যা অবস্থা এখন, সেক্ষেত্রে আমাদেরও তো একটা অবস্থান নিতেই হয় বিশ্বনাগরিক হিসেবে। কিন্তু ভালো লাগল যখন আন্তর্জাতিক জুরি মেম্বাররা বললেন, তাঁদের এই ছবি ভালো লেগেছে শুধুমাত্র ছবির গুণে। এই জুরি বোর্ডের সবাই বিভিন্ন দেশের মানুষ, তাঁরাও যুদ্ধবিরোধী এবং গাজার প্রতি সহমর্মী, কিন্তু তবু এই ছবিটি তাঁদের বিশ্ব রাজনীতির বাইরে নিয়ে গেছে! এই সম্মান, জুরিদের মতে, এই ছবির প্রাপ্য আর তাই এই পুরস্কার।
ছবিটি দেখতে ঢুকলাম। খেয়াল করলাম অনেকেই বিরক্ত ইজরায়েলি ছবিটি পুরস্কার পাওয়ায়। ছবিটি শুরু হল আর প্রথমেই যে কথাটি আমি বুঝতে পারলাম, সেটা হল, ‘চিলড্রেন অফ নোবডি’ ছবিটির দৃশ্যগুলি, ইমেজগুলি, এই ছবির ভিজুয়াল গ্রাফ একদম আলাদা। কারও মতো নয়– না আমেরিকা, না ইউরোপ, না ইরান, ভারত বা জাপান, কোরিয়া– যাদের ছবির একটা বিশেষ ধারা এবং বিশ্বব্যাপী পরিচিতি আছে। দেখা যায়, সব ছবিই কোনও না কোনও ইনফ্লুয়েন্স বহন করছে শট টেকিংয়ে– একটা কোনও স্কুল বা ঘরানার কচ্ছপ বহন করছে। কিন্তু এই ছবিটির কোনও ঘরানা নেই। প্রথমবার মালয়েশিয়ান ছবি, এপিচ্যাক পং-এর ‘আঙ্কল বুমনি হু ক্যান রিকল হিস পাস্ট লাইফ’ দেখেও এমন লেগেছিল, একদম আনকোরা নিজস্ব চিত্রকল্প, ছবিটা তাই এত আলাদা।
এছাড়া আরেকটি ব্যাপার এই ছবিটির হাতিয়ার, তা হল অভিনেতাদের পারফরম্যান্স। এই ছবির অভিনয়ের মজাই হল কেউ-ই এখানে অভিনয় করছে না। প্রত্যেকটি চরিত্র তাই দর্শকদের মাইন্ড স্পেসে জায়গা করে নিতে পারে সহজেই। এসবের পরেও ছবিটি শ্রেষ্ঠ পুরস্কারের জন্য মনোনীত না-ও হতে পারত এত কঠিন প্রতিযোগিতায়, কিন্তু সেটা হওয়ার মূল কারণ একটি প্রথামাফিক বলা, নির্ভেজাল সুন্দর গল্প বলা; যে গল্প এই যুদ্ধ, অশান্তি আর খুনোখুনির আবহাওয়ায় ওয়েসিসের মতো ফিরিয়ে আনে ভরসা আর হাতে হাত ধরার গান। আপাদমস্তক মানবিকতার একটুকরো ছবি পরিচালক বুনে তুলেছেন তেল আভিভ শহরের উচ্চবিত্ত পাড়ার মধ্যে একটি খাপছাড়া বাচ্চাদের হোমকে ঘিরে।
ছেলেগুলো যথার্থই বাপে খ্যাদানো, মায়ে তাড়ানো, বাঁদর, বজ্জাত। অনেকেরই আছে পুলিশি রেকর্ড। অনেকে সুইসাইডাল, নিহিলিস্টিক। বদ খপ্পরে পড়ে যাওয়া, নেশার জালে ফেঁসে যাওয়া। বস্তুত এই পৃথিবী আর সমাজ কীভাবে ক্রমে ‘এ শিশুর বাসযোগ্য’ হয়ে উঠেছে, তার সত্যিকারের প্রতীক এই আঠারো অনুর্ধ্ব ছেলেগুলো– চিলড্রেন অফ নোবডি।
এদের এবং এরকম সব ছেলেদের দায়িত্ব বহু বছর ধরে নিয়ে আসছে এই হোম, যিনি বানিয়েছিলেন সেই মারগালিত। বর্ষীয়ান অভিনেত্রী তিকভা ডায়ান অভিনীত মারগালিতের চরিত্রটি মাত্র দশ মিনিটে বুঝিয়ে দেয় এই মহিলার নিঃশেষিত ভালোবাসা এই ছেলেদের প্রতি, বুঝিয়ে দেয় তার দাপট এই কাজ ঘিরে। সবাই তাকে এক কথায় চেনে, ডরায়, শ্রদ্ধা করে। তাই অবৈধ ভাবে দখল করা এই জমি নিয়ে কেউ কিছু করে উঠতে পারে না, মারগালিতের কথায় পুলিশ অবধি কেস দেয় না তার হোমের ছেলেদের, বিভিন্ন অর্গানাইজেশন গ্রান্ট দেয়।
মারগালিত যতদিন আছে, ততদিন এই হোম আর তার ছেলেদের ছুঁতে পারবে না কেউ, কিন্তু তারপর? তারপর কী হবে, সে গল্প আমরা জানি, জানে হোমের সবাই। মারগালিত ছবি শুরু হওয়ার মিনিট বারোর আশপাশে মারা যায়। হোমের পুরনো বাসিন্দা জ্যাকি, যে হোমের দেখভাল করতে সাহায্য করে মারগালিতকে, এক ভোরে মারগালিতের ঘরে গিয়ে দেখে ঘুমের মধ্যে চলে গেছে মারগালিত। জ্যাকির মনে হয়, মারগালিতের মৃত্যু বেমালুম চেপে যাওয়া ছাড়া এই হোম, এই ছেলেগুলোকে বাঁচানোর আর অন্য কোনও উপায় নেই। উটকো, আজগুবি সব গল্প বানাতে থাকে জ্যাকি মারগালিতকে নিয়ে। জ্যাকি-র ক্রিমিনাল পাস্ট, হোমের বাকি ছেলেদের প্রতি প্রথমদিককার বিরক্তি আর রাগ, তার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা এক কথায় জ্যাকিকে যাচ্ছেতাই অযোগ্য বলে দাগিয়ে দেয়। উপরন্তু মারগালিতের মৃত্যুর পর তার অসম্ভব বোকা বোকা, বুদ্ধিহীন প্রচেষ্টা মারগালিতকে জীবিত প্রতিপন্ন করার, তা দেখে হাসব না কাঁদব তা বুঝে উঠতে পারি না। কিন্তু এরই মধ্যে একের পর এক ঘটতে থাকা ঘটনাপ্রবাহে কখন যেন এই ক্ষ্যাপা, বুদ্ধির ঢেঁকি ছেলেটিকে বেজায় ভালোবেসে ফেলে দর্শক। আসলে ছেলেটিও যে নিজের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলছে মারগালিতের মিশন, এই হোম, হোমের ছেলেদের। মারগালিতের মতোই আশ্চর্য এক জেদ আর স্বপ্ন চেপে ধরছে তাকে, যার সঙ্গে সমঝোতা করতে সে নারাজ।
হ্যান্ডহেল্ড শট, ডকুমেন্টারি ফিল্মের শট টেকিং আর এডিটিং স্টাইল, যথাযথ সাউন্ড আর মিউজিক নিয়ে ‘চিলড্রেন অফ নোবডি’ একটি সুন্দর গল্পের বুনন। একফোঁটা বাড়তি কথা বা ছবি নেই এই ফিল্মে। ঝরঝরে ন্যারেটিভ– যেখানে পরতে পরতে উঠে এসেছে স্টেটের আর্থ-সামাজিক ছবি, ক্লাস-স্ট্রাগলের পুরনো এবং অনিবার্য চিত্র। এই ছবির ট্রিটমেন্টে সবচেয়ে ভালো লাগে ছবিটির হিউমার। যথেষ্ট গভীর একটি বিষয় ঘিরে ছবি, অথচ দারুন হিউমারাস। কখনও তা ভারতীয় ছবির মতো উচ্চকিত কমেডি পর্যায় যায় না, অথচ স্ল্যাপস্টিকও রয়েছে ছবিতে। ছবিটির মধ্যে এক ধরনের স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট রয়েছে, যা বোধহয় আমারা সকলেই মনে মনে পছন্দ করি।
‘চিলড্রেন অফ নোবডি’ দেখতে দেখতে মনে হল, দেশের শাসক বা সরকারের কীর্তিকলাপের দায়ভার তো বর্তাতে পারে না সমগ্র দেশবাসীর ওপর। শাসক যতবার বেছে নিয়েছে হিংস্রতার পথ, ততবার সেই শাসনকালেইই সেই দেশের মানুষের মধ্যেই গজিয়ে উঠেছে প্রতিরোধের চারাগাছ। মানুষ দাঁড়িয়েছে মানুষের পাশে। পৃথিবী সাক্ষী আছে, এদের দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে ‘অ্যান্টি ন্যাশনাল’ হিসেবে আর তারপরেও এরেজরা বানিয়েছেন এমন ছবি, যা শুধুই মনুষত্বের কথা বলে, সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে, জিতে যায় ‘সিনেমা’।
চিলড্রেন অফ নোবডি
পরিচালক: এরেজ টেডমর, ইজরায়েল