সেই আমলের হরেক কিসিমের পোলাও, কাবাব, কোর্মা আজ বাউন্ডারি হাঁকালেও সময়ের সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছে বাদশাদের বেশ কিছু ভীষণ প্রিয় পদ। দিল্লি থেকে কানপুরের মাঝের এক শহরে সেরকম এক পদ খাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। সুজির চেয়ে গাঢ় বাদামি রঙের হালুয়াটা মুখে দিতেই তার অনবদ্য স্বাদের দৌলতে আনন্দে আর আরামে চোখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে জিজ্ঞেস করল, ‘এটা কীসের হালুয়া জানো?’ হালুয়া এতরকমের হয় যে নিজের জ্ঞান জাহির করতে এই হালুয়াকে অবহেলা করা সমীচীন হবে না বলে অজ্ঞতা স্বীকার করলাম। উত্তর শুনে বিষম খেলাম– এটা নাকি ‘গোস্ত কা হালুয়া’!
১৯.
হালুয়ার মতো এত উদার খাবার হয় না– সবজি থেকে বাদাম প্রত্যেককেই আপন করে নেয়। আজকে হালুয়ার হাওয়াবদলের গল্প।
হালুয়া কিন্তু আদপে এদেশের খাবার নয়। ‘হালুয়া’ শব্দটা এসেছে আরবি ‘হালু’ শব্দ থেকে– যার অর্থ ‘মিষ্টি’। আদপে এই হালুয়া বানানো হত খেজুর বেটে দুধে ফুটিয়ে– আরব থেকে পারস্য হয়ে হালুয়া ভারতবর্ষে পৌঁছেছে। আজ থেকে হাজার বছর আগে মহম্মদ বিন হাসান আল-বাগদাদি’র লেখা কিতাব আল-তাবিখ্ বইয়ে আট রকমের হালুয়ার রেসিপি লেখা আছে। অটোমান সাম্রাজ্যের দশম সম্রাট সুলেমানের হালুয়া এতই প্রিয় ছিল যে, তার জন্য আলাদা একটা রান্নাঘর বানিয়ে ফেলেছিলেন। যেহেতু প্রথম তিন মোঘল সম্রাটের সমসাময়িক, আর যেহেতু হুমায়ুন শের শাহ্র কাছে তাড়া খেয়ে পারস্যে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন, হুমায়ুন ফেরত আসার সময় হালুয়াকে নিয়ে ফিরেছিলেন– এটা ভাবা স্বাভাবিক। কিন্তু হালুয়ার প্রবেশ-কাহিনি এর চেয়ে অনেক জটিল, কারণ এর মতো আক্রমণকারী ভারতবর্ষের ইতিহাসে দুটো নেই। আলেকজান্ডার থেকে ভাস্কো দা-গামা– প্রত্যেকে যেখানে এক জায়গায় আক্রমণ করেছে, হালুয়া ভারত আক্রমণ করেছে করাচি আর কোচিন– দুই প্রান্ত থেকে। যার জন্যে কেরলের কারুত্থা হালুয়া নারকোল আর গুড় দিয়ে, কর্ণাটকের কাশি হালুয়া চালকুমড়ো দিয়ে–স্থানীয় উপাদান দিয়ে তৈরি। ঠিক যেমন আফগানিস্থান আর পাঞ্জাব থেকে গাজরের হালুয়ার উৎপত্তি।
হালুয়া শুধু ভারতবর্ষেই আক্রমণ করেনি, তার সঙ্গে আফ্রিকাকেও কবজা করেছিল। সোমালিয়ার জ্যাল্হো থেকে শুরু করে কিনিয়ার লোজি, তিল দিয়ে তৈরি মিশরের হালাওয়া– সব জায়গাতেই হালুয়া পৌঁছেছিল। সুজি দিয়ে তৈরি গ্রিক হালোয়া আবার সেখানকার গোঁড়া খ্রিস্টানদের বুধবারের খাবার– যেদিন তারা মাংস খাওয়া এড়িয়ে চলে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ভাজারদুয়ারি ১৯: আরে, এ তো লিট্টির বৈমাত্রেয় ভাই!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে এসেছিল ব্যবসা করতে। তারা আমাদের কাছ থেকে নিয়ে গিয়েছে অনেক কিছু– আমাদের খিচুড়ি ওদের দেশে কেডিগ্রি হয়েছে। আমাদের পায়েস সেখানে নাম বদলেছে। শুধু কারি নিয়ে যাওয়ার সময় প্লেজারিজম ব্যাপারটা ভুলে আর নাম বদলায়নি। আমাদের কারি সংস্কৃতির মোঘলাই হেঁশেল মানেই কোর্মা, পোলাও আর কাবাবের সম্ভার। অন্যদিকে মোঘলরা এই দেশে থাকতে এসেছিল, তাই সঙ্গে করে অনেক কিছু নিয়ে এসেছিল। মোঘল হারেমের বেগমরা কেউ এসেছে সুদূর পারস্য থেকে, আবার কেউ এই দেশের কোনও রাজ্য থেকে। আর এই বেগমদের সঙ্গে এসেছিল রান্নার বিভিন্ন উপাদান, রেসিপি আর মশলা। জাফরান, বাদাম, ড্রাই ফ্রুট, এলাচ-লবঙ্গ-দারচিনি-মেওয়া একসঙ্গে রান্নার সঙ্গে মিশে গিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে এই দেশের কোনায় কোনায় আর তৈরি হয়েছে এক নতুন ঘরানা, যাতে মেন কোর্স, সাইড ডিশ থেকে শেষ পাতের মিষ্টি– সবই আছে। আর সাধারণ মানুষের কাছে ঘরানার জনপ্রিয়তা রাস্তার মোড়ে কাবাবের দোকানে ভিড় দেখে টের পাওয়া যায়। মোঘল আমলের অনেক কিসিমের পোলাও, বিভিন্ন মাংসের পদ আজকে পাওয়া গেলেও সময়ের সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছে কিছু অত্যন্ত জনপ্রিয় পদ।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ভাজারদুয়ারি ১৮: ল্যাদের সঙ্গে খিচুড়ির অবৈধ সম্পর্ক
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সেই আমলের হরেক কিসিমের পোলাও, কাবাব, কোর্মা আজ বাউন্ডারি হাঁকালেও সময়ের সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছে বাদশাদের বেশ কিছু ভীষণ প্রিয় পদ। দিল্লি থেকে কানপুরের মাঝের এক শহরে সেরকম এক পদ খাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। সুজির চেয়ে গাঢ় বাদামি রঙের হালুয়াটা মুখে দিতেই তার অনবদ্য স্বাদের দৌলতে আনন্দে আর আরামে চোখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। চোখ খুলে দেখি বন্ধু মিটমিট করে হাসছে। হালুয়া নিয়ে উচ্ছ্বাস কমলে সে জিজ্ঞেস করল, ‘এটা কীসের হালুয়া জানো?’ হালুয়া এতরকমের হয় যে নিজের জ্ঞান জাহির করতে এই হালুয়াকে অবহেলা করা সমীচীন হবে না বলে অজ্ঞতা স্বীকার করলাম। উত্তর শুনে বিষম খেলাম– এটা নাকি ‘গোস্ত কা হালুয়া’! একটু সামলে নিয়ে জানতে পারলাম বেশ কিছু মোঘল বাদশার নিরামিষ খাবারের নাম শুনলেই ভিরমি খেতেন, তাঁরা শেষ পাতেও মাংস ছাড়তেন না! মাংসের কিমার সঙ্গে সমপরিমাণ দুধ দিয়ে বানানো মোঘল আমলের অত্যন্ত জনপ্রিয় এই পদ রান্নার কায়দা মোঘল খানসামাদের জানা ছিল। কিন্তু অন্য মোগলাই খানার মতো এই পদ ব্রিটিশদের আনুকূল্য পায়নি, কারণ গোস্ত হালুয়া দেখতে একেবারে ব্রিটিশ শেফার্ড’স পাইয়ের মতো। তাই এই হালুয়া থেকে গিয়েছিল খানসামাদের পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
গোস্ত হালুয়া খেতে খেতে মোহনভোগের কথা মনে পড়ে গেল, যাকে ঠাকুরের ভোগের ঘরে অন্যতম প্রধান চরিত্রে দেখা যায়– সে জন্মাষ্টমী হোক কি লক্ষ্মীপুজো! সুজি, চিনি, ঘি আর সম্ভব হলে কাজুবাদাম, কিসমিস, এলাচ দেওয়া এই হালুয়া নাকি দেবতাদের প্রিয়।
‘লে হালুয়া’ বলে এক গান আছে না!