সকালে জোরগলায় ইংরেজি খবরের কাগজ পড়তেন, বিকেলে বিবিসি শুনতেন, এবং, যাকে বলে ফ্রম ‘জেন্ডার টু আলেকজেন্ডার’ সব বিষয়েই তর্কাতর্কি হাতাহাতি মারামারি অবধি করতেন নিজের বক্তব্যের সমর্থনে। তিনি বলেছিলেন, ‘তুই পাশাপাশি মুরগির ব্যবসাটাও শুরু করে দে অবনি, ওতেই ফিউচার।’ হবি তো হ, পাশ দিয়ে তখন আমাদের জেঠিমা যাচ্ছিলেন। কথাটা কানে গেছিলই কি না সে বিষয়েও তর্কাতর্কি মারামারি হয়েছিল, তবে যে বিষয়টি আমরা প্রত্যেকেই দেখেছি তা হল, উনি ফট করে মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা নাই বার্তা নেই অবনিদার উদ্দেশে বলে উঠেছিলেন, ‘বুঝলি অবনি, ভাবছি ভেজিটেরিয়ানই হয়ে যাবো।’
১৮.
অবনীদাকে মাংসের দোকান দেওয়ার বুদ্ধি যাদবজিই দিয়েছিল। সামনে নেপাল, পাঁঠা হেবি সস্তা– আনা-নেওয়ার খরচা নেই, শিলিগুড়ি থেকে সবটাই ওয়াকিং ডিস্টান্স। ‘লাইক মাইন্ডেড পিপুলদের সঙ্গে থাকবি, পিঠে খুজলি হলে চাটিয়ে দিবে, কিলো প্রতি দেড়শো গিরাম বেশি পাবি।’ বাক্যের শেষ অংশটা এখনও ক্লিয়ার হয়নি। অবনীদা এক দৌড়ে নেপাল চলে গেল। পাঁঠা বিক্রি করতে রাজি একটা লোককে পেল, এবং সাড়ে তিন বছর পর হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরেও এল। ‘এত দেরি হল কেন’ জিজ্ঞেস করায় বললে ‘সব পিত্থিরাজের দোষ।’ আমরা ভাবলেম, জাঁদরেল কোনও রাজা-মহারাজা টাইপের কেউ হবে। অবনীদা একটা তাগড়াই উটের সমান পাঁঠা এনে সাইড মেরে দাঁড় করালে– সামনে দাঁড়ালে নাকি ঢুঁসিয়ে দেবেই দেবে! ‘এ পিত্থিরাজ?’ আমরা বিস্ময়ে হতবাক! অবনীদা খৈনি ডলতে ডলতে বললে, ‘না, এ সেলুকাস। পিত্থি বেকফাস্ট সারছে।’ মোদ্দা কথা হল, বেশ কয়েকটা পাঁঠা কিনে ফেরার সময় অবনীদার একেবারে জেরবার অবস্থা। ‘আর বলিসনি ভাই, চাদ্দিকে শুদু পাহাড়, এই ঢাল দিয়ে উঠি তো জানোয়ারগুলো ওই ঢাল দিয়ে নেমে যায়, নেপাল, ভুটান, আসাম, হাজারিবাগ অবধি দৌড় করিয়ে ছেড়েছে। লিডার ওই পিত্থিরাজ। একেবারে জাত খচ্চর মাইরি। ঠিক বিকেলের আগে এক দৌড়ে অন্য পাহাড়ের ঢালে গিয়ে ওঠে। কোনও মতে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে সেখানে গিয়ে দেখি সে ব্যাটা ঘুরপথে ফিরে এসে পাতা চিবুচ্ছে। দেব একদিন মায়ের নাম…।’ আমরা শুধোলাম বাকিদের মতো গাড়িতে এলে না কেন? তাতে অবনীদা বললে, ওখানে সবাই নাকি সাজেস্ট কললে শুধু শুধু গাড়ি ভাড়া দেবে কেন? পথের ধারে মাঠে কচি কচি ঘাস খেতে খেতে ওরা অমনি একদিন পৌঁছে যাবে। তুমিও প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখবে, গাছের তলায় বিশ্রাম করবে, ঝরনার ঠান্ডা জল, গাছের ফল খাবে, পল্লিরমনি আঁচল দিয়ে মেষপালকের কপালের ঘাম কেমন মুছিয়ে দেয় দেখো– তাছাড়া তারাভরা আকাশের তলায় ঘুমোনো যে কী মনোরম… ইত্যাদি প্রভৃতি।
‘‘একবেলা না কাটতে শালাদের পিছনে দৌড়ে জিভ বেরিয়ে গেল মাইরি। বিভিন্ন সময়ে ১৫০ জন নানাভাবে পিটিয়েছে পাঁঠার বাচ্চারা ওদের বাগানে ঢুকে পড়ায়। পল্লিরমনিদের মতো খচ্… ইয়ে মানে, এই যে তোদের বউদি। রাস্তায় দেখা হল, তারপর বিয়েটা করেই ফেললাম বুঝলি। কদ্দিন আর পথে প্রান্তরে বিবাগি হৃদয় লিয়ে… ঝন্নার জলের মতো বিষ এই পিথিবিতে দু’টি নেই… তোরা চা খেয়ে যাস, আমি ঝট করে…।’’ পিছনে তাকিয়ে দেখি দরজার চৌকাঠ ধরে এক বিশালদেহী মহিলা আমাদের দিকে কটমট করে চেয়ে ‘এক, দো, তিন, সওয়া তিন’ ইত্যাদি গুনছে। অলক ফিসফিস করে বললে, ‘এ পিত্থিরাজ না হয়েই যায় না।’ পরে বুঝলাম কৃশানু আকারে ছোট বলেই মহিলাটি সওয়া ধরেছিলেন– তবে চা ও এককাপ পুরোই পেল। শুনলাম কোনও এক গাঁয়ে পাঁঠা-সমেত একরাত, দু’রাত এবং পর পর বেশ কয়েক রাত কাটানোর পর মেয়েটির বাবা নাকি একরকম জোর করেই বিয়ে দিয়ে দেন– ‘হাম আউর ইতনা পাঁঠাকো খিলানে নেহি সাকতা, তুম দোনো মিলকে খিলাও, যো খুশি করো, লেকিন নিকলো হিঁয়াসে’ ইত্যাদি অশ্রুসজল, হৃদয়বিদারক, মর্মস্পর্শী ইসেটিসে বলে দু’জনকে বের করে দেন। বিমল চা খেয়ে ফেরার সময় বললে, ‘হ্যাঁ রে, মেয়েটা মহিলা তো? হাতপাগুলো দেখেছিস? অবনীদাটা যা ভোদাই, হয়তো একটা জ্যাঠতুতো ভাই গছিয়ে দিয়েছে সিঁদুর লেপে।’ সে নিয়ে পরে প্রচুর গন্ডগোল হয়েছিল, পরে বলা যাবে। জেঠিমা বাঙালি মতে বিয়ের দিন সকলকে ডাইল ভাজা থেকে মাছ মাংস দই মিষ্টি অবধি ভরপেট ভোজ খাইয়ে বলেছিলেন ‘কী করব, যেমন আমার অদৃষ্ট, বউমাকে নিয়ে এসেছে, ফেলে তো আর দিতে পারি না।’
আমাদের ছেলেবেলায় ওসব হত। ফেলে দিত না কেউ। সুখে ঘরসংসারও করত সবাই মিলে। মাঝের থেকে একবাল বেশ কয়েকটা পাঁঠা বেশ সস্তায় পেয়ে ওর ভাইকে পুর্ণিয়া থেকে আনিয়ে থানার পাশে একটা মাংসের দোকান দিলে। তখন এসবের জন্য পার্টিকে পয়সা দিতে হত না। একটা মোটকা মতো গুঁফো লোক নরেন জেঠাদের সঙ্গে দিনরাত আড্ডা মারতো। সে বললে ‘‘নাম দাও ‘ঘ্যাঁচ দেম ইয়ং’ – নাইন্টি পারসেন্ট ক্লায়েন্টই তো অবাঙালি।’’ লোকটা এর আগে পাল ডাক্তারকে বুঝিয়েছিলো যে ওর নামের পর (উইদিন ফার্স্ট ব্র্যাকেটস) ‘হবি হাকিম’ বা ‘সখের ডাক্তার’ কথাটা লিখে দেওয়া উচিত। কাদের প্ররোচনায় সেই যুগান্তকারী অভিধা (উইদিন ফার্স্ট ব্র্যাকেটস) বর্জিত হয়েছিলো মনে নেই, তবে বাঙালি কি আদৌ জানে তালেগোলে সে কী হারাইয়াছে?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পড়ুন ভয়বাংলা-র আগের পর্ব: বাঙালি জীবনের ভেজিটেরিয়ান হওয়ার ভয়
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সে যুগে রোববার দুপুরে মাংস ভাত ছিল মধ্যবিত্তর বেঁচে থাকার প্রমাণ। আর্মি ক্যান্টনমেন্টেও তার ব্যত্যয় ছিল না। মাংস আনতে যেতাম খোট্টার দোকান থেকে ডানদিকে স্টেশন পানে বাঁক নিয়ে মিত্তিরদের বাড়ির আগে খানিকটা ঢালের পিছনে বড় কাঁঠাল গাছের ঠান্ডা ছায়ায় ঘেরা চত্বরের শেষ মাথায়। চাকুরে বাবুরা সকলেই যেতেন, অতএব অবনীদাকে সে ব্যবসায় নামতে বলে যাদবজি কিছুমাত্র অন্যায় করেনি। তাছাড়া লোকসংখ্যা কেবল বেড়েই চলছিল একটানা। সে সময় নরেন জেঠা ছিলেন সর্বজ্ঞ টাইপের মানুষ। সকালে জোরগলায় ইংরেজি খবরের কাগজ পড়তেন, বিকেলে বিবিসি শুনতেন, এবং, যাকে বলে ফ্রম ‘জেন্ডার টু আলেকজেন্ডার’ সব বিষয়েই তর্কাতর্কি হাতাহাতি মারামারি অবধি করতেন নিজের বক্তব্যের সমর্থনে। তিনি বলেছিলেন ‘তুই পাশাপাশি মুরগির ব্যবসাটাও শুরু করে দে অবনি, ওতেই ফিউচার।’ হবি তো হ, পাশ দিয়ে তখন আমাদের জেঠিমা যাচ্ছিলেন। কথাটা কানে গেছিলই কি না সে বিষয়েও তর্কাতর্কি মারামারি হয়েছিল, তবে যে বিষয়টি আমরা প্রত্যেকেই দেখেছি তা হল, উনি ফট করে মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা নাই বার্তা নেই অবনিদার উদ্দেশে বলে উঠেছিলেন, ‘বুঝলি অবনি, ভাবছি ভেজিটেরিয়ানই হয়ে যাবো।’ তারপর ওর বিয়েতে ক’হাতা মাছের মাথা দেওয়া ডাইল, ক’পিস মাছ, ক’টুকরো মাংস – ‘আমি তো আবার ব্যাশি ঝুল পসোন্দো করিনা’ – খেয়েছেন, এবং পরদিন সকালে বড় ডেগচি ভর্তি ‘বেঁচে যাওয়া’ বাসি মাংস পাঠানোয় লুচি দিয়ে সেই অমৃত সাঁটিয়েছেন বুড়ো বুড়ি মিলে দু’দিন ধরে, সেই গল্প করে গেলেন পাশে বসে দু’কাপ চা আর খানতিনেক বিস্কুট সহযোগে। প্রতি দেড়, বা বড়জোর দু’টি বাক্যের পর ‘মুরগি আমরা কেউই খাইটাই না’, ‘মন্ডলবাবুদের গুরুদ্যাব মুরগি খাইতে না করসে’, ‘অনন্তের শালিটা স্যাবার মুরগি খাইয়া ফিট হইয়া পরলো’ ইত্যাদি জরুরি ‘ইনফরম্যাশন’ স্ট্রেস দিয়ে যোগ করার যে আর্ট সেদিন প্রত্যক্ষ করেছিলেম, তা আজও স্মৃতিপটে জ্বলজ্বল করছে। নরেন জেঠাকে বাক্যিহারা হতে দেখেছি ওই একবারই। বাঙালির পাত থেকে মটন ছিনিয়ে নেওয়া চক্রান্ত বানচাল করতে এক নির্ভীক বাঙালি রমণির বুক দিয়ে গোটা জাতিকে আগলানোর ব্রতে ঝাঁপিয়ে পড়ার অমন নিদর্শন আর আছে? নেই।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
পড়ুন ভয়বাংলা-র অন্য পর্ব: বাঙাল হওয়া সত্ত্বেও যারা রাবীন্দ্রিক বাংলায় কথা কইত, তারা মুসলমানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে না
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
অবনিদা বউয়ের কথায় পাঁটার ব্যবসাই ছেড়ে দিলে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি একবাল ডাইভার্সিফাই করলে। একটা চাউ, রোল, মাগলাইয়ের দোকান দিলে – নাম ‘মনের মটন’, ওই মোটকা গুঁফো লোকটারই দেওয়া।