একান্নবর্তী পরিবার ভাঙতে ভাঙতে ‘হাম দো হামারে এক’-এ এসে ঠেকেছে। সাহিত্য সমাজের দর্পণ, ফলে সমষ্টি থেকে ব্যষ্টির দিকে যাওয়ার প্রবণতা সাহিত্যেও উঠে এসেছে। একা কোনও জিনিস করলে সব আলোটুকুই এককের দিকে ধাবমান হয়, সমাহারে তা ছড়িয়ে পড়ে। হালের সমাজ কেন্দ্রের দিকে ছুটতে চায়, সাহিত্য স্রষ্টারা সমাজেরই উপাদান। ফলে তাঁরাও হয়তো এককেই ভরসা পান, একক হতে চান।
সৌভিক রায়
দরবেশের আলখাল্লা তৈরি হয় বাহারি রঙের কাপড়ে, আদত উদ্দেশ্য ছিদ্রাচ্ছাদন। কিন্তু ‘কোলাজ’-এর গুণ, হাজারও রং মিলেমিশে জন্ম নেয় নয়া এক সৃষ্টি। বারোয়ারি উপন্যাসও ঠিক তাই, একাধিক কলমচি মিলে একটি ক্যানভাসকে রাঙিয়ে তোলেন। যেন রিলে রেসের দৌড়বিদ, এক একজন নিজের দৌড়টুকু দৌড়ন। ব্যাটন তুলে দেন অপরের হাতে, ফিনিশিং লাইন ছোঁয়া হয়। সম্মিলিত চেষ্টায় জয় আসে। এক প্লট, নানান মগজের ভাবনার ভিড়, কাহিনির নানা মোড়, কিন্তু মূলত ধারাটি অক্ষত। এভাবেই জন্ম হয় যৌথ উপন্যাসের।
ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের উপাখ্যানগুলিতে উপন্যাসের উপাদান ছিল। প্যারীচাঁদ মিত্রর ‘আলালের ঘরের দুলাল’ হয়তো উপন্যাস হয়ে উঠতে পারত। ১৮৬৫ সালে ‘দুর্গেশনন্দিনী’ হয়ে উঠল বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম সার্থক উপন্যাস। তার প্রায় সাড়ে পাঁচ দশক পর ১৯২১ সালে লেখা হল প্রথম যৌথ উপন্যাস। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, নরেন্দ্র দেব, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, চারু বন্দ্যোপাধ্যায়, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এবং প্রমথ চৌধুরী; বারোজন লেখক মিলে লিখেছিলেন উপন্যাস। নাম ছিল ‘বারোয়ারি উপন্যাস’। প্রকাশক ‘ইন্ডিয়ান পাবলিশিং হাউজ’। ‘ভারত’ পত্রিকায় (১৯২০-১৯২১ সাল) বৈশাখ থেকে চৈত্র পর্যন্ত প্রতি মাসে এক একজন করে লিখেছিলেন। পরবর্তীতে তা উপন্যাস আকারে বের হয়। পরবর্তী আড়াই-তিন দশকে একাধিক যৌথ উপন্যাস রচিত হয়। ‘ঝড়ের দোলা’, ‘বাঁকালেখা’, ‘রাসচক্র’, ‘ভালমন্দ’, ‘অষ্টমী’, ‘বিসর্পিল’, ‘বনশ্রী’, ‘সাগর রহস্য’, ‘আজগুবি জানোয়ার’, ‘মীনকেতুর কৌতুক’, ‘মহিলা মজলিশ’, ‘টাকা গাছ’, ‘বান্ধবী’, ‘সবুজ মানুষ’– এগুলো সবই যৌথ উপন্যাস। কোনওটি হয়তো পাঁচজন লেখক মিলে লিখেছেন, কোনওটিতে হয়তো দশজন কলম চালিয়েছেন। সকল রচয়িতাই ছিলেন তদানিন্তন সময়ের প্রথিতযশা সাহিত্য স্রষ্টা। ‘মহিলা মজলিশ’ উপন্যাসটি মহিলা সাহিত্যিকরা লিখেছিলেন। শিশুসাহিত্যের প্রথম যৌথ উপন্যাস ছিল ‘অজানার উজানে’। ক্ষিতীশচন্দ্র ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় ‘মাস পয়লা’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল, পরে ১৯৩৫ নাগাদ উপন্যাস রূপে প্রকাশ পায়।
কল্লোল যুগে যৌথ উপন্যাস সাহিত্যের রীতিমতো ‘ট্রেন্ড’ হয়ে গিয়েছিল। ওই সময়টাতেই সর্বাধিক সংখ্যক যৌথ উপন্যাস ছাপাখানার মুখ দেখেছে। বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি যৌথ উপন্যাস সম্ভবত প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছিলেন। ‘বাঁকালেখা’, ‘বিসর্পিল’, ‘বনশ্রী’, ‘সাগর রহস্য’, ‘অজানার উজানে’, ‘আজগুবি জানোয়ার’, ‘বান্ধবী’, ‘মহাকাশযাত্রী বাঙালি’, ‘নাগরিকা’, ‘সবুজ মানুষ’, ‘হীরে মতি পান্না’– সবক’টিতেই ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র।
সাত-আটের দশক থেকে ক্রমেই যৌথ উপন্যাস কমতে শুরু হয়। হোমসিয়ানা ক্লাবের উদ্যোগে ১৯৮৭ সালে ‘পাঞ্চজন্য’ রচিত হয়েছিল। লেখক ছিলেন পাঁচজন। একুশ শতকেও যৌথ উপন্যাস লেখা হয়েছে, তবে সংখ্যা খুবই কম। ‘কিছু মেঘ, কিছু কুয়াশা’ ২০১৬ সালে পত্রভারতী থেকে প্রকাশিত হয়, তারপর ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায় ও হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্তের যৌথ উপন্যাস ‘প্রথম সূর্য শশাঙ্ক’ প্রকাশ করে পত্রভারতী। করোনাকালে যৌথ উপন্যাস ‘পানিঝোরা কটেজ’ প্রকাশ করে পত্রভারতী। এ সময়ের ১৬ জন খ্যাতনামা লেখক কলম ধরেছিলেন। বিগত কয়েক বছর ‘জয়ঢাক’ প্রকাশনীও বেশ ক’টি যৌথ উপন্যাস প্রকাশ করেছে। যেমন ‘ইতি রুদ্রট’, ‘অঘোরী’, ‘ধুম্রজাতক’।
ক্রমেই যৌথ থেকে এককের দিকে এগোচ্ছে সমাজ। একান্নবর্তী পরিবার ভাঙতে ভাঙতে ‘হাম দো হামারে এক’-এ এসে ঠেকেছে। সাহিত্য সমাজের দর্পণ, ফলে সমষ্টি থেকে ব্যষ্টির দিকে যাওয়ার প্রবণতা সাহিত্যেও উঠে এসেছে। একা কোনও জিনিস করলে সব আলোটুকুই এককের দিকে ধাবমান হয়, সমাহারে তা ছড়িয়ে পড়ে। হালের সমাজ কেন্দ্রের দিকে ছুটতে চায়, সাহিত্য স্রষ্টারা সমাজেরই উপাদান। ফলে তাঁরাও হয়তো এককেই ভরসা পান, একক হতে চান। দল হলেই অধিনায়কের প্রয়োজন পড়ে, যৌথ উপন্যাসের ক্ষেত্রে যে লেখকের খ্যাতি পাঠকসমাজে বেশি, তিনিই উঠে আসেন কেন্দ্রে। বাকিরা খানিক আড়ালে, এটিও যৌথ উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে লেখক-লেখিকাদের আগ্রহ কমার কারণ হতে পারে। আরও একটি জিনিস নিবিড় পর্যবেক্ষণে লক্ষ করা যায়। যৌথ উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে লেখকদের এক সূত্রে গাঁথতে এগিয়ে এসেছিলেন সম্পাদকরা। এ যুগে সে জায়গাটি নিয়েছে কিছু প্রকাশনী। নির্দিষ্ট করে বললে প্রকাশনীর কর্ণধাররা। অর্থাৎ, কোনও একজন পাচক হয়ে উপাদান জড় করছেন। রান্না হচ্ছে। তৃপ্ত হচ্ছে পাঠক। সাহিত্যিকদের এক ছাতার তলায় আনার কারিগরদের অপ্রতুলতা সম্ভবত যৌথ উপন্যাসের ঘরানাটিকে অবলুপ্তির পথে ঠেলে দিচ্ছে।
ভ্রু-পল্লবে ডাক দিলে, এ শহরে সব দেখা হয় সিঙ্গল স্ক্রিনে। সিনেমাই সিঙ্গল আর যুগলকে এক হলে বেঁধে রাখে। ক’দিন আগেই বাসে শুনেছি এক ভদ্রলোক বলছেন ‘যুগলসের সামনে বেঁধে দেবেন’। ভাবি, অবাক হয়ে, যুগল তো এমনিই বহুবচন, আবার যুগলস কেন!